১৬ জুন, ২০২০ ১৩:০৮
বৃষ্টির শহর, সবুজের শহরে কি বৃষ্টি ছিল? না কী হাহাকারের আগুনে পুড়েছে দারুণ খরায়! এই শহরের নামের সাথে যার নাম মিশে গিয়েছিল ওতপ্রোতভাবে। তিনি সিলেটের কামরান। এই একটা নামেই তাকে চিনতো সারা পৃথিবীর বাংলাদেশিরা।
সেই মানুষটি এই শহর ছেড়ে, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দেশে-বিদেশে দল-মত নির্বিশেষে আপনার শূন্যতায় মাতম করছে আজ। যার প্রতিটি বক্তব্য শুরু হতো শ্রী চৈতন্য, শাহজালাল ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি আমার সিলেট বলে। অসাম্প্রদায়িক এই লাইন দুটি আমার মনে হয় কামরান ভাইয়ের মধ্য দিয়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ তিনি... যাকে সবাই ডাকে কামরান ভাই। সিলেটের কামরান নামে ব্রান্ডিং হয়ে গিয়েছিল। জননেতা বলতে যে বিশেষণ আজকাল বহুল ব্যবহৃত, কামরান ছিলেন প্রকৃত অর্থেই জননেতা। সত্যিকারের জননেতা।
বিজ্ঞাপন
লাখো পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছেন বাংলাদেশে, কিন্তু কামরান হয়েছেন একজনই। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পরই ১৯৭৩ সালে তিনি সিলেট পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখান থেকে পৌর চেয়ারম্যান, সিলেটের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই দীর্ঘ যাত্রা পথে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান।
নানা অপবাদ, অভিযোগ, সত্য, মিথ্যা, চরিত্র হনন, বোমা হামলা নানাভাবেই তাকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সব জয় করেই তিনি সামনে এগিয়ে গেছেন। সিলেটে যেকোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন অনুষ্ঠান বা বিয়ে যেখানে তাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে, কোন বিশেষ কারণ ছাড়া তিনি সেখানে উপস্থিত থেকেছেন। আমরা বন্ধুদের আড্ডায় এইটা নিয়ে মজাও করেছি অনেক সময়।
খুব কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়তো হয়নি আমার। রাজনীতিতে যখন পথচলা তখন নিতান্তই ক্ষুদ্র এক কর্মী। কিন্তু যখনই কোথাও দেখা হয়েছে সালাম দিয়েছি হাসি মুখে বলতেন ''ভালা আছনি''? হাসির জাদুকরের সেই ম্যাজিকাল হাসিতেই সব জয় হয়ে যেত। ভাবতাম আমাকে তো কামরান ভাই চিনেন! শহরের প্রতিটা মানুষকে মনে হতো তার পরিচিত।
সংস্কৃতিমনা মানুষটি নিজেও গান গাইতেন। আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, তালতলা গুলশান হোটেলের সেন্টারে একবার তা০র একক সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়েছিল অথবা অন্য কারো অনুষ্ঠানে তিনি অনেকগুলো গান গেয়েছিলেন। আজ এই দিনটাকে স্মৃতির খাতায় লিখে রাখো, আমায় পড়বে মনে কাছে দূরে যেখানেই থাকো। সত্যি দিনটা আজ স্মৃতির খাতায় লেখা হয়ে গেল!
সর্বশেষ কামরান ভাই ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় যখন জেলে থেকে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই নির্বাচনই ছিল সিলেটে আমার শেষ নির্বাচন। আনারস মার্কার প্রচার প্রচারণায় নানাভাবেই অংশ নিয়েছিলাম। সেই নির্বাচনে বালাগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ, আরেক ধীমান পুরুষ আমার শিক্ষক মহিউদ্দিন শীরু স্যার ছিলেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান। স্যারও আমাদের মাঝে আর নেই।
পড়ালেখা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের কারণে, পিছনের সারির কর্মী হিসেবেই রাজনীতির সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। সহযোদ্ধা যারা তারা উঠে আসেন রাজনীতির সামনের কাতারে। তাদের অনেকেই কামরান ভাইয়ের খুব কাছাকাছি থেকে, তার ছায়ায়, মায়ায়, বেড়ে উঠেছেন আগামীর নেতা হিসাবে। তাই কামরান ভাইকে অনেকটা তাদের চোখ দিয়েই দেখা আমার। কারণ বন্ধুদের সাথে যোগাযোগে যেহেতু কখনো ভাটা পড়েনি।
সেই জমানায় একজন কর্মী হিসাবে যখনই দেখা হয়েছে সালাম দিয়েছি, হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করতেন 'ভালা আছনি" আমার মনে হয় পরিচিত অপরিচিত সবাইকে তিনি এইভাবেই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতেন। তার সেই জিজ্ঞাসায় মনে হতো তিনি মনে হয় খুব ভালো করে আমাকে চিনেন! তাই কখনো পরিচয় দেয়া বা জিজ্ঞাসা করা হয়নি তিনি আমাকে চিনেন কী না?
সর্বশেষ বছর দুয়েক আগে লন্ডনে একবার দেখা হয়েছিল, সেই চিরচেনা হাসি দিয়ে আগেই জিজ্ঞাসা করলেন "কিতা বা ভালা আছনি"? আমি ২০ বছর আগের মতোই জিজ্ঞাসা করতে পারিনি কামরান ভাই আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
না আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি, আর কোনদিন জিজ্ঞাসাও করতে পারবো না। তিনি আমাকে চিনেন বা না চিনেন তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা তাকে চিনতাম তিনি আমাদের কামরান ভাই। আমাদের ভরসাটুকু অন্তত ছিল কামরান ভাই জিজ্ঞাসা করবেন "কিতা বা ভালা আছনি"। সেই ভরসার জায়গাটুকুও শূন্য হয়ে গেল।
সিলেট থেকে যেদিন কামরান ভাইকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়, করোনা ভয় উপেক্ষা করে শত শত নেতাকর্মী সেদিন, হাসপাতালে, রাস্তায় ভিড় করেছিল।
আমার দুই বন্ধু নতুন প্রজন্মের নেতা, দেবাংশু দাশ মিঠু এবং জাহাঙ্গীর আলম খুব কাছে কাছে ছিল কামরান ভাইয়ের। আমি মিঠুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, করোনার স্বাস্থ্যবিধি তারা কীভাবে পালন করেছে। তার আবেগী উত্তরটি আমাকে আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করার অবকাশ দেয় নি।
সে বলেছিল, বন্ধু এইটাই তো আমাদের আওয়ামী লীগ। নেতার জন্য কর্মীদের মৃত্যু ভয় থাকে না। কামরান ভাইয়ের জন্য শুধু আমি না হাজার মানুষ এই মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করেই বাইরে এসেছে। কামরান ভাইকে সিলেটের মানুষ কতোটা ভালবাসে, বন্ধু তুই চোখে না দেখলে সেটি বিশ্বাস করতে পারবি না।
আমি চোখে না দেখলেও সেটি বিশ্বাস করি। সাত সাগর তেরো নদীর ওপারে রাত ১১টায় যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মৃত্যুর সংবাদটি আসে আমি তখন রাস্তায়, বাসায় ফিরছি। বাসা থেকে আমার বউ প্রথম ফোন করে সংবাদটা দেয়। বাসায় ফিরে বারবার সে আফসোস করছিল! কামরান ভাইকে খুব কাছে থেকে সে জানে বা দেখেছে তাও কিন্তু নয়। সিটি করপোরেশনের বাইরে তবুও দুর্গাপূজায়, প্রায়ই ওদের পূজায় না কী যেতেন তিনি। আর এইভাবেই অনেকের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
আপনাকে নিয়ে নানা ব্যক্তিগত সমালোচনা ছিল, অভিযোগ ছিল কিন্তু সব পিছনে ফেলে আপনার জন্য মানুষের ভালবাসার পাল্লাটাই ছিল ভারী।
আজ সব কিছুর ঊর্ধ্বে আপনি। এতো দ্রুত চলে যাবেন ভাবনায় ছিল না। আপনাকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন সিলেট পেরিয়ে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়েছিল। সিলেটের কামরান আরও বড় কিছু হবেন।
এক জীবনে অনেক কিছুই হয় না কামরান ভাই। আবার অনেক কিছুই হয়। কিন্তু মানুষের ভালবাসা সবাই পায় না। আপনি সেটা পেয়েছেন। সেই ভালবাসার প্রতিদান আরও অনেক কিছু দেয়ার বাকী ছিল আপনার......
কি অদ্ভুত রকমের কিছু ঘটনা থাকে সে কাকতালীয় হোক কিংবা অন্য কিছু। আজ থেকে ৭ বছর আগে ১৫ জুন তারিখে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। ৭ বছর পর সেই ১৫ জুন তারিখে জীবনের কাছেই পরাজিত হয়ে গেলেন তিনি!
মানুষের ভালবাসায়, প্রার্থনায় অন্য আলোয় ভাল থাকুন হাসি মুখের জাদুকর....
আপনার মন্তব্য