হাসান মােরশেদ

২৩ জুন, ২০২০ ১৪:৩২

আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন অথবা ঘৃণা করেন- অস্বীকার করতে পারবেন না

আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন অথবা ঘৃণা করেন- অস্বীকার করতে পারবেন না। ’৭১ বছর ধরে এই যে টিকে থাকা, প্রবল ভাবে ও প্রাসঙ্গিক রূপে টিকে থাকা- এটাই আওয়ামী লীগের শক্তির জায়গা।

মুসলিম লীগের মতো জাঁদরেল দল নাই হয়ে গেছে, কমিউনিস্ট পার্টির মতো তুমুল সংগঠন প্রায় ফুরিয়ে গেছে অথচ আওয়ামী লীগ কিন্তু আছে। যে পরিমাণ ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগের টিকে থাকা- সেটাও ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে।

এই দীর্ঘ ৭১ বছরের মধ্যে দুই- তৃতীয়াংশ সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে বা ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে বেশীর ভাগ সময়েই ষড়যন্ত্র ও হত্যার মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ বিরোধী হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি যেমন সমগ্র রাজনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তেমনি ক্ষতি করেছে স্বয়ং আওয়ামী লীগের।

ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগ মধ্যপন্থী, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আওয়ামী লীগ ’খেলতে পারে’ এমন নিয়মতান্ত্রিক বিরুদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠেনি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে এমন সগঠনগুলো যখন শক্তিশালী ছিলো তখন তারা বিরোধী না হয়ে আওয়ামী লীগের মিত্র ছিলেন, আর যখন বিরোধী হয়েছেন তখন শক্তিহীন,তখন আর বিরোধিতার কোন গুরুত্ব নেই- আওয়ামী লীগের আর তাদেরকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন নেই।

এর বাইরে যারা আওয়ামী লীগের বিরোধী হয়েছে তারা কেউই নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি নয়- তারা হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করেছে, তারা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে কিংবা ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছে। ’৭০ এর পশ্চিম পাকিস্তান শক্তি, ’৭৫ এর খুনি চক্র, ২০০৪ এর খালেদা- নিজামী সরকার, ২০১৩ এর আগুন সন্ত্রাস- আওয়ামী লীগ এর গোটা জীবনই অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মোকাবেলা।

একটা দুষ্টচক্রকে ক্রমাগত মোকাবেলা করে টিকে থাকা- আওয়ামী লীগকে, বিশেষ করে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে সে আওয়ামী লীগকে একাধারে আপোষকামী ও উদ্ধত করে তোলে। আপোষ সে করে, যাতে কিছু ক্ষতিকর উপাদান অপরপক্ষকে শক্তিশালী করতে না পারে। উদ্ধত সে হয়ে উঠে কারণ কাউকে তার পাত্তা দেয়ার দরকার নাই- সে আপাত: নিরীহ বিরোধিতার মধ্যেও ষড়যন্ত্র ও হত্যার ইন্ধন দেখে তার ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়।

এই যে এতো দীর্ঘ বছর ধরে আওয়ামী লীগ প্রবলভাবে টিকে থাকলো অথচ আওয়ামী লীগ বিরোধী একটা শক্তিশালী সত্যিকারের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠলোনা যারা ক্যান্টনমেন্ট, সাম্প্রদায়িক, কর্পোরেট শক্তির ভরসায় নয়- জনগণের ভরসায় স্পষ্ট ও সরাসরি রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করবে।

এই গড়ে না উঠার দায় অন্তত: আওয়ামী লীগের না। আওয়ামী লীগ একটা রাজনৈতিক দল, প্রভু যীশু নয়। সে নিজ হাতে নিজের বিরোধী দল তৈরি করে দেবেনা, এটা কেউ করেনা। আওয়ামী লীগকে রাজনীতির মাঠে দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করার নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল রাজনীতি থেকেই উঠে আসতে হবে- হত্যা, ষড়যন্ত্র, এনার্কিজম দিয়ে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করা যাবেনা সেটা এখন বুঝে নেয়া উচিত।

ক্ষমতাসীন ’আপোষকামী ও উদ্ধত’ আওয়ামী লীগ সরকার নয়- ৭১ বছর ধরে টিকে থাকা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমার নিজের সবচেয়ে বড় অভিযোগ অন্যত্র। এতো দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্য যে রাজনৈতিক দলের, তার তাত্ত্বিক কাঠামো এখন পর্যন্ত গড়ে উঠলো না কেনো?

’৫০ ’৬০ এর প্রজন্ম জানতো তারা কেনো আওয়ামী লীগ করতো। ’৭০ ’৮০ এর প্রজন্ম জানতো। ’৯০ এর পরের প্রজন্ম কি জানে কেনো সে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে? ঐতিহ্যবাহী অতীত আর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়। উন্নয়ন সরকারের দায়িত্ব। আওয়ামী লীগ মানে কেবল সরকার নয়, আওয়ামী লীগের রাজনীতিটা কী, তার থিওরোটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট করা জরুরী।

একটা উদাহরণ দেই, আওয়ামী লীগের মূলনীতিতে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আছে। এই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বলতে কী বুঝানো হয়েছে সেটা কি আওয়ামী লীগ স্পষ্ট করতে পারে? ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ নাকি বাংলাদেশ মানচিত্রের ভেতরের জাতীয়তাবোধ? ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত অন্তত: চারবার বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা কি প্রচলিত সংজ্ঞামতো নাকি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলতে তাঁর একটা নিজস্ব ধারনা ছিলো? তিনি কি এই অঞ্চলের সকল মানুষকে বুঝিয়েছিলেন?

আওয়ামী লীগের অনিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতা করতে গিয়ে যেমন একটা তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল অরাজনৈতিক দুষ্টচক্র ক্রিয়াশীল তেমনি এই চক্র মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ ও পাল্টা প্রতিক্রিয়াশীল মেধাশূন্য গণসম্পৃক্ততাহীন শক্তিতে পরিণত হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।

এই পরিণতি মেনে না নেয়ার জন্যই আওয়ামী লীগের নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তোলা জরুরী।

হাসান মোরশেদ: লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত