সেলিম আহমেদ

২৭ জুন, ২০২০ ১৫:০৪

সামনে ঘোর অন্ধকার

প্রিয় বাংলাদেশ আজ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। অদৃশ্য এক ভাইরাসের সঙ্গে গত মার্চ মাস থেকে যুদ্ধ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে দেশ। কিন্তু কোনো ভাবেই পেরে উঠা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মানুষ চিকিৎসার জন্য ঘুরছে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। মৌলিক অধিকার চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে পথেঘাটে। শুধু তাই নয় এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। করোনার ধাক্কায় চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। নিদারুণ অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছে অনেক মানুষ। সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে করোনা পরিস্থিতি প্রকট হয়েছে বলে দাবি করছেন সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। শুক্রবার (২৬ জুন) পর্যন্ত দেশে করোনায় মারা গেছেন এক হাজার ৬৬১ জন আর শনাক্ত হয়েছেন এক লাখ ৩০ হাজার ৪৭৪ জন। আর করোনার উপসর্গ নিয়ে কত মানুষ মারা গেছেন তার কোনো হিসেব নেই কারো কাছে।

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে উৎপত্তি হওয়া ভাইরাসটি খুবই দ্রুত বিশ্বেও অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়েছিল। কিন্তু ভাইরাস রুখার ও প্রস্তুতি নেয়া মতো যথেষ্ট সময় পেলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে তার করতে পারেনি বাংলাদেশ। প্রতিটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চরম খামখেয়ালিপনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এর কঠিন ফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে।

বাংলাদেশের প্রথম ভুল হলো— যখন চীন থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়ছিল তখন আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ না করা। বিভিন্ন মহল থেকে বার বার বলা হচ্ছিল আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো বন্ধ করা কিন্তু নানা অজুহাত দেখিয়ে ফ্লাইট বন্ধ করতে অনেকটা বিলম্বিত করা হয়েছে। তখন বিদেশ থেকে যারা ফিরেছিল তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রাখতে পারেনি সরকার। তাদের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে শুরু করলেও কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ উপেক্ষা করে নমুনা পরীক্ষায় শিথিলতা দেখানো হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে দ্রুত ছড়িয়েছে ভাইরাসটি।

দ্বিতীয় ভুল হলো— করোনার সংক্রমণ রোধ করতে সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। অতি সংক্রমিত এলাকাগুলোতে লকডাউন করা হয়েছিল। কিন্তু তাও ঠিকমতো কার্যকর করতে পারেনি।

তৃতীয় ভুল হলো— লকডাউন শিথিল করা। দেশের অর্থনীতির কথা চিন্তা করে সরকার লকডাউন শিথিল করেছিল। এতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগ জনক হারে বাড়ছে শুরু করে। ফলে ফের জোনভিত্তিক লকডাউন নীতি গ্রহণ করে সরকার। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে জোনভিত্তিক লকডাউনকে এখনো কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। হয়তো কিছু দিনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন হবে।

বিশ্বে যখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় তখন থেকেই পেশাগত কারণে ফলোআপ করতে হয় করোনাকে। প্রতিদিন করোনার খোঁজখবর নিতে নেই, কাগজের পাতায় লিখি। করোনার লোমহর্ষক সব কাহিনী লিখতে লিখতে এখন অনেকটা দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় যখন দেখি মানুষ চিকিৎসার অভাবে পথেঘাটে মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীরা কোনো চিকিৎসাই পাচ্ছেন না। অবশ্যই বিশ্বের কোনো দেশেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনো করোনার কার্যকর কোনো ঔষধ কিংবা ঠিকা আবিষ্কার করতে পারেনি। করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের কাছেই আসতে চান না চিকিৎসকরা। দূর থেকেই তাদের কিছু ঔষধ কিংবা পরামর্শ দেন। জটিল করোনায় আক্রান্ত রোগীরা আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরে জন্য হাহাকার করতে করতে মারা যাচ্ছেন। ফলে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক বিশিষ্টজনকেও হারাতে হয়েছে অকালে।

করোনা আক্রান্ত ছাড়াও অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরাও কোনো চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চিকিৎসকরা বন্ধ রেখেছেন প্রাইভেট চেম্বার। ফলে ক্যান্সার, লিভারের সমস্যা, কিডনি সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের রোগীরা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে তারা হাসপাতালে যেতেও পারছেন না। অন্য রোগীদের তুলনায় সংক্রমিত হলে এ ধরনের রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। অনেকে অসুস্থতা চেপে অপেক্ষা করছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার। শারীরিক জটিলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা আতঙ্ক। আর বেশির ভাগ হাসপাতালে করোনা নেই এমন সার্টিফিকেট ছাড়া সাধারণ রোগের রোগীদেরও ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।

করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে চলছে লেজেগোবরে অবস্থা। করোনার উপসর্গ থাকার পরও অনেকে দীর্ঘ চেষ্টা করেও করাতে পারছেন না নমুনা পরীক্ষা। যেখানে ৭২ ঘণ্টার বেশি এই ভাইরাস জীবিত থাকে না। সেখানে চার থেকে পাঁচ দিন পর সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। নমুনা দেয়ার পর উপসর্গ থাকা রোগীকে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ৮-১০ দিন। এমনকি রিপোর্ট পাওয়ার আগেই মারা যাচ্ছেন অনেকে। এখন পর্যন্ত অনেক জেলাতেই নেই করোনা পরীক্ষার পিসিআর মেশিন। কিট সংকট, নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি ও মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। অন্যদিকে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। করোনার ধাক্কায় বন্ধ হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। চাকরি হারিয়েছেন লাখ লাখ শ্রমিক। দীর্ঘ বেকারত্বের কারণে জমানো সঞ্চয়ও শেষ হয়ে গেছে অনেক। আয় ও সঞ্চয় হারিয়েছে নিঃস্ব অবস্থায় দিন পার করছেন তারা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলছে, দেশে করোনার প্রকোপে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। আর করোনার আগে যারা দরিদ্র ছিল তাদের অবস্থা একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশে দরিদ্রতার সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলছেন, চলতি বছরের শুরুতে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনার প্রকোপে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। বছরের তৃতীয় ও শেষ প্রান্তিকে মানুষের আয় কাঙ্ক্ষিত হার যদি ফিরে আসে তাহলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। তার পরও বছর শেষে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ ছাড়াতে পারে।

রাজধানী ঢাকা শহরের এমন অনেক মানুষ আছে যারা দীর্ঘ বেকারত্ব ও ও আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় বাসাভাড়া দেয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন। অনেক পেশা পরিবর্তন করে ফুটপাতে বসেছেন বিভিন্ন পণ্য দিয়ে। ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে দেশে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইট-পাথরের শহর ঢাকায় আসা লোকজন এবার দুর্ভাগ্য নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন বাড়িতে। প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা যায়, মালপত্র ভর্তি বাহনে করে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। তাদের মধ্যে কেউ দিনমজুর, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউ গার্মেন্টস শ্রমিক, ছাত্র-প্রাইভেট শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশার মানুষ। যারা এখনো আছেন তাদের চোখমুখে হতাশার চাপ।

বিআইডিএসের পরিসংখ্যানটি বলছে, করোনার আগে মোট বেকার ছিল ১৭ শতাংশ। করোনার কারণে নতুন করে ১৩ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে। ফলে বেকার মানুষের সংখ্যা এখন ৩০ শতাংশ। সেসব পরিবারের সদস্যদের চাকরি আছে এবং একজন সদস্যের মাসিক আয় ৫ হাজার টাকার নিচে সেই পরিবারের আয় কমেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে একজন সদস্যের আয় ১৫ হাজার টাকার নিচে এমন পরিবারের আয় কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া একজন সদস্যের আয় ৩০ হাজার টাকার নিচে এমন পরিবারের আয় কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়েছেন সেশন জটের কবলে। সরকারি চাকরি প্রত্যাশীরা হারাচ্ছেন চাকরির বয়স। ক্ষুদ্র ও মধ্যম শ্রেণীর উদ্যোক্তা হারাচ্ছেন শেষ সম্বল। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ মিলবে তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এমনকি বাংলাদেশ এখন সংক্রমণের কোন পর্যায়ে আছে? কিংবা সংক্রমণের চূড়ায় (পিক) পৌঁছেছে নাকি এখনও পৌঁছেনি? অথবা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছতে আর কতদিন লাগতে পারে? এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই কারো কাছে। তারপরও বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখছে একদিন এই ঘোর অন্ধকার কেটে আলো আসবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ঘুরে দাঁড়াবে প্রিয় বাংলাদেশ।

সেলিম আহমেদ : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত