মুক্তাদীর অাহমদ মুক্তা

১০ জুলাই, ২০২০ ০১:৪৬

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী: এক উন্নয়নকামী রাজনীতিবিদ

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী একজন অার্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও কুটনীতিবিদ। অার্ন্তজাতিক পরিসরে তাঁর মতো গ্রহণযোগ্যতা খুব কম রাজনীতিবিদ ও কুটনীতিবিদের ছিল। তিনি একজন মহৎপ্রাণ প্রশাসক, দূরদর্শী জনপ্রতিনিধি, প্রজ্ঞাবান কুটনীতিবিদ ও উন্নয়নকামী রাজনীতিবিদ।

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশের এক বিরলপ্রজ নাম। তিনি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছেন। অাপন অালোয় অালোকিত করেছেন তাঁর চারপাশকে। মেধা, দায়িত্বশীলতা, উদারতা, বাগ্মীতা, সৌজন্যবোধ অার প্রখর ব্যক্তিত্ব তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এক সম্মোহনী সুপুরুষে।
 
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালের ১১ নভেম্বর সিলেট শহরের দরগা গেইটস্থ রশিদ মঞ্জিলে। তাঁর অাদি নিবাস সুনামগঞ্জের দরগাপাশা গ্রামে। পিতা আব্দুর রশিদ চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় বিধান সভার সদস্য এবং মাতা সিরাজুন নেছা চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য।কসবে সিলেটের সন্তান হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মর্যাদাকে করেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার হাই মাদ্রাসা সেকশনে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পরবর্তীতে শিলং এ ভর্তি হন। আসামে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৪৭ সালে ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইংলিশ বারে অধ্যয়ন করেন এবং লন্ডনের ইনার টেম্পলের একজন সদস্য হন। লন্ডনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি তিনি অর্জন করেন। এছাড়া ম্যাসাচুসেটসের ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসি থেকে স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন তিনি। গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপে পাকিস্তান ছাত্র সংসদের সভাপতি ছিলেন। সে সুবাদেই তিনি যুক্তরাজ্যে প্রথম এশিয়ান স্টুডেন্টস কনফারেন্স আয়োজনে সক্ষমতা দেখান।

১৯৫৩ সালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তৎকালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ইংরেজি-বাংলা ছাড়াও উর্দু, ফরাসি ও ইতালিয়ান ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। আরবি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, জার্মান ও ভাষা ইন্দোনেশিয়াতেও তার গ্রহণযোগ্য ব্যুৎপত্তি ছিল। পাকিস্তান সরকারের অধীনে তিনি বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করেন। তারমধ্যে রোম, বাগদাদ, প্যারিস, লিসবন, জাকার্তা এবং নয়াদিল্লী অন্যতম।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে কূটনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযোদ্ধা কূটনৈতিক হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ অধিবেশনে ভাষণ দেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে ৪০টিরও অধিক দেশের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেন। ১৯৭২ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত হন। ১৯৭৬ সালের পর সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং ভ্যাটিকানেও একই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ এবং জাতিসংঘের শিল্পাঞ্চল উন্নয়ন সংস্থা বা ইউনিডো’র প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি তিনি ছিলেন । ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই তিনি জাতিসংঘের ৪১তম সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে  হত্যা করার পর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার জার্মানীর বাসায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, জামাতা ড. ওয়াজেদ ও দুই নাতি-নাতনিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার অনুরোধে জার্মান সরকার তার বাসার সামনে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁদেরকে ভারতে রাজনৈতিক অাশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন।

স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি একাধারে রাষ্ট্রদূত,পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, পররাষ্ট্রসচিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য এবং সব শেষে মহান জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সিলেট-১ ও সুনামগঞ্জ -৩ আসন থেকে ১৯৮৬ সালে  সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে সিলেট ১ অাসন থেকে ১৯৮৮ সালে ৪র্থ সংসদ এবং ১৯৯৬ সালে ৭ম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৪ জুলাই তিনি সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি সিলেটের অঞ্চলের এখন পর্যন্ত প্রথম ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রের অন্যতম সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

তিনি সত্যিকার অর্থে ছিলেন একজন দায়বদ্ধ জনপ্রতিনিধি ও উন্নয়নকামী রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি নয় টেকসই উন্নয়নে ছিল তাঁর বিশেষ অাগ্রহ। সিলেটের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য লালনে তিনি ছিলেন যত্নশীল। শিক্ষার প্রতি বিশেষ অাগ্রহী হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সবচেয়ে বড় অবদান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। সিলেটকে বিভাগীয় শহরের উপযোগী করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন তিনিই শুরু করেছিলেন। সিলেট শিক্ষা বোর্ড, সিলেট টিচার্স ট্রেনিং  কলেজ, অাধুনিক রেলওয়ে ষ্টেশন, পূর্ণাঙ্গ অার্ন্তজাতিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে রানওয়ে সম্প্রসারণ তাঁরই উদ্যোগ। সিলেট শহরের  বাইপাস সড়ক, টুকেরবাজার এলাকায়  সুরমা নদীতে সেতুসহ বাইপাস সড়ক, বাদাঘাট সেতু এগুলো তাঁর দূরদর্শী উনয়ন পরিকল্পনার অংশ। সিলেটে সুরমা নদীতে তিনি একটি ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। যা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন হয়ে অন্যভাবে কাজীরবাজার সেতু নামে বাস্তবায়ন হয়েছে।

তাঁর নির্বাচনী এলাকার পশ্চাৎপদ  কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাকে তিনি উন্নয়নের অাওতায় নিয়ে এসেছিলেন। সুনামগঞ্জ ৩ অাসনের সংসদ সদস্য থাকার সময় জগন্নাথপুর কলেজ স্থাপন, দুটি উচ্চ  বিদ্যালয়কে সরকারিকরণসহ সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি গ্রহণ করেছিলেন মহাপরিকল্পনা। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কৌশলের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

১৯৯৬-২০০১ সালে তিনি জাতীয় সংসদের স্পীকারের দায়িত্ব পালন করার সময় দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশে পালন করেন যুগান্তকারী ভূমিকা। তাঁর সময়েই সংসদ সদস্যদের সংসদীয় কমিটির সভাপতি করার রেওয়াজ চালু হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু হয়।

খ্যাতিমান কূটনীতিক হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী প্রবাসে বিশেষ করে সৌদি অারবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার চালু করতে অসামান্য অবদান রাখেন। অান্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত করতে তিনি যে মেধা ও বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা সুবিদিত। জাতীয় সংসদের স্পীকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রী,পররাষ্ট্র সচিব,রাষ্ট্রদূতসহ জীবনের প্রতিটি  ক্ষেত্রে রেখেছেন যোগ্যতার স্বাক্ষর। জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে তিনি তাঁর জীবদ্দশায়ই দলমত নির্বিশেষে সকলের অাস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন।  নিজের কর্মদক্ষতায় হয়ে উঠেছিলেন একজন জাতীয় নেতা।

তিনি বিভিন্ন সময় দেশের জন্য নিয়ে এসেছেন  বিভিন্ন অার্ন্তজাতিক স্বীকৃতি। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারি থেকে ১৯৮৪ সালে 'মহাত্মা গান্ধী শান্তি পুরস্কার' পান। বিশ্ব শান্তিকল্পে অনবদ্য কূটনৈতিক ভূমিকার জন্য তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি 'উ থান্ট শান্তি পদক' লাভ করেছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

২০০১ সালের ১০ জুলাই ৭২ বছর বয়সে মহান এ কর্মবীরের জীবনাবসান হয়। ক্ষণজন্মা এই খ্যাতিমান কুটনীতিক ও সফল রাজনীতিবিদের অাকস্মিক মৃত্যুতে সিলেটে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। সিলেটের মানুষ দলমত নির্বিশেষে তাঁকে কতটুকু অাপন করে নিয়েছিল তা তাঁর অন্তিম যাত্রায় প্রমাণিত হয়েছে। সিলেট অন্তঃপ্রাণ এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে  হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

সিলেট দরদী এই মানুষটি ছিলেন একজন উন্নত রুচির মানবিক পুরুষ। তাঁর পৌরুষদীপ্ত ভরাট গলায় তিনি গানও গাইতেন।ছাত্র জীবনে অভিনয়ও করেছেন। অাধুনিক ও সৃজনশীল ভাবধারায় তিনি ছিলেন  পরিশীলিত ভদ্রলোক। অত্যন্ত সজ্জন এ বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন একজন খাঁটি সিলেটবন্ধু। মহান এ কর্মীপুরুষের ১৯ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

মুক্তাদীর অাহমদ মুক্তা : সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত