মিখা পিরেগু

৩১ জুলাই, ২০২০ ২১:০০

দলই চা বাগান সংকট : বাগান কর্তৃপক্ষের শাস্তি কেন জরুরী?

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সীমন্তবর্তী মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত দলই চা বাগান ২৭ জুলাই একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে চা বাগান ইজারাদার কর্তৃপক্ষ দলই টি কোম্পানি লিমিটেড। এতে মজুরিবিহীন অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন চা বাগানের প্রায় ৬০০ চা শ্রমিকসহ তিনসহস্রাধিক শ্রমিক পরিবার। কর্তৃপক্ষের দেয়া বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায় শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩ ধারা অনুসারে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাগান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করেছে।

এর আগে গত ২৩ জুন বাগানে ৯ নম্বর লাইনে গাছ কাটার অভিযোগ তুলে গত বড় লাইনের রাধেশ্যাম ভরের ছেলে চা শ্রমিক হীরা ভর (২২) কে সেকশন থেকে ধরে পিতার সামনেই মারধোর করে গুরুতর আহত করেন বাগান ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম ও তার লোকেরা। আহত চা শ্রমিককে প্রথমে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ওইদিন বিকালে ব্যবস্থাপক কর্তৃক নির্যাতিত হীরা ভরের বাবা চা শ্রমিক রাধে শ্যামের নিকট থেকে জোরপূর্বক মুচলেখা নিয়ে ২৯ জুনের মধ্যে সপরিবারে চা বাগান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। এঘটনায় চা বাগান শ্রমিকরা আহত শ্রমিকের চিকিৎসাসেবা ও আমিনুল হকের অপসারন দাবি করলে কালক্ষেপন করে সময় অতিবাহিত করেন কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে ২৯ জুন চা শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে কারখানার সামনে ধর্মঘট শুরু করলে অভিযুক্ত ব্যবস্থাপক নিরাপত্তাহীনতায় বাগান ত্যাগ করেন। এরপরে ২৯ জুন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় বৈঠকে আমিনুল ইসলাম কোনো সমাধানের আগেই বৈঠক থেকে বেড়িয়ে যান। আবার ৫ জুলাই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ইজারাদার কোম্পানী শ্রমিক নির্যাতনে অভিযুক্ত বাগান ব্যাবস্থাপক আমিনুল ইসলামকে কোম্পানীর সদর দপ্তরে সাময়িকভাবে বদলির সিদ্ধান্ত দেন।

এরকম একটি পরিস্থিতির পরে গত ২৭ জুলাই আকস্মিকভাবে চা বাগানের শ্রমিকদের উশৃঙ্খল আখ্যা দিয়ে বাগান বন্ধের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাগান ইজারাদার। শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায় বাগান বন্ধের দিন অন্যান্য দিনের চেয়ে ৩ গুন কাজ তাদের দিয়ে করানো হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের গত ৯ মে চা বাগানের গাছ চুরি, শশ্মান ভূমিতে চারা রোপন, চা বাগান বাংলোয় কর্মরত নারী শ্রমিকদের হয়রানিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে দলই চা বাগানের শ্রমিকেরা ব্যাবস্থাপক আমিনুল ইসলামের অপসারণ চেয়ে কর্মবিরতি পালন করেন। আবার জানুয়ারি মাসেও একই দাবিতে শ্রমিকেরা প্রতিবাদী কর্মসূচী নিলেও বার বার পরবর্তীতে এসব না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমিনুল ইসলাম পার পেয়েছেন।

এসব ঘটনায় একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে আসে পার্শ্ববর্তী হোসেনাবাদ চা বাগান এলাকার একটি সংঘবদ্ধ গাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই ব্যবস্থাপকের গোপন সম্পর্ক রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাগানের দুর্গম এলাকার গাছ বিক্রি করে অবৈধ সম্পদ বানাচ্ছেন। তাই বাগান ব্যাবস্থাপক আমিনুল ইসলাম নিয়োগ পাওয়ার পর দীর্ঘসময় ধরেই শ্রমিক নীপিড়ন নির্যাতনসহ নানান অপকর্মের মাধ্যমে বাগান ধংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাছাড়াও আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে আগের কর্মস্থলে রাজনগর উপজেলার বাগানে নানান অনিয়মের পাশাপাশি একজন সিনিয়র সাংবাদিককে মোবাইল চুরির অভিযোগে ফাঁসানোর অভিযোগ আছে।
 
এসকল দুর্নীতি-অনিয়ম-নিপীড়ন সহ্য করে হলেও উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে চা বাগানের শ্রমিকেরা মহামারীর সময়েও জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করেছেন।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল বিনা উস্কানীতেই আকস্মিকভাবে বাগান বন্ধ করে ৩ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরে চা শ্রমিক ইউনিয়নের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৯ জুলাই কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার  ত্রিপক্ষিয় বৈঠকে বাগান ইজারাদার কর্তৃপক্ষ জানায় শ্রমিক নীপিড়ক ব্যাবস্থাপক আমিনুল ইসলামকে বাগানে ফিরিয়ে নিলে বাগান খুলবে না হলে বাগান বন্ধ থাকবে। পরের দিন বাগানে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি দিলেও সাপ্তাহিক রেশন আটকে দিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ। এসকল ঘটনা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় দলই চা বাগানের নীরিহ চা শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে একপ্রকার জিম্মি করে বাগান ইজারাদার কর্তৃপক্ষ ব্যাবস্থাপক আমিনুল হককে বাগানের দায়িত্বে বহাল করবেন। যার ফলে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে ব্যাবস্থাপক আমিনুল ইসলামের সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির মদদ খোদ ইজারাদার কর্তৃপক্ষই দিত। কাজেই কেবলমাত্র একজন বাগান ব্যাবস্থাপকের অপসারণ নয় বরং শ্রমিকদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের সাপেক্ষে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে বাগান ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের লিজ বাতিল করতে হবে।

গত ২৭ জুলাই বাগান কর্তৃপক্ষের জারিকৃত নোটিশে দেখা গেছে শ্রম আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী বাগান বন্ধ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন চা বাগানের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি বাগান বন্ধের ক্ষেত্রে বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রম আইনের ১৩ ধারা প্রয়োগ করে থাকেন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এ প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ব্যাপারে এই ১৩ ধারায় বলা হয়েছে "(১) কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বা বিভাগে বে-আইনী ধর্মঘটের কারণে মালিক উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন, এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকগণ কোন মজুরী পাইবেন না। (২) যদি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোন শাখা বা বিভাগ বন্ধের কারণে প্রতিষ্ঠানের অন্য কোন শাখা বা বিভাগ এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে উহা চালু রাখা সম্ভব নহে, তাহা হইলে উক্ত শাখা বা বিভাগও বন্ধ করিয়া দেওয়া যাইবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগণকে তিন দিন পর্যন্ত লে-অফ এর ক্ষেত্রে প্রদেয় ক্ষতিপূরণের সমপরিমাণ মজুরী প্রদান করিতে হইবে, তবে এই মেয়াদের অতিরিক্ত সময়ের জন্য তাহারা আর কোন মজুরী নাও পাইতে পারেন। (৩) উক্তরূপ বন্ধের বিষয়টি মালিক যথাশীঘ্র সম্ভব সংশ্লিষ্ট শাখা বা বিভাগের নোটিশ বোর্ডে বা প্রতিষ্ঠানের কোন প্রকাশ্যস্থানে নোটিশ সাঁটিয়া বা লটকাইয়া দিয়া সংশিষ্ট সকলকে অবহিত করিবেন এবং কাজ পুনরায় শুরু হইবার বিষয়ও উক্তরূপে বিজ্ঞাপিত করিবেন।"

এখানে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য বিষয় হল শ্রম আইন ২০০৬ এর এই ১৩ ধারা কেবলমাত্র যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকের প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লিজ নিয়ে কোন চা বাগানের ইজারাদারের এই ধারা ব্যাবহারের এখতিয়ার নেই।  তাই দলই চা বাগান বন্ধ ঘোষণায় শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা কোনো ভাবে কার্যকর নয়। বরং বাগান বন্ধের সিদ্ধান্ত লিজ চুক্তি লঙ্ঘনসহ  শ্রম আইন ২০০৬ এর ২২৭ ধারা অনুসারে বেআইনি ভাবে লকআউট ঘোষণার শামিল এবং ২৯৪ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চা বাগান কোনো প্রাইভেট প্রোপার্টি না এটা চা বাগানের ইজারাদারদের বোঝতে হবে। না হলে এদেশে চা শিল্পে তাদের টিকে থাকা সম্ভব না।  চা বাগানের ইজারাদারদের মালিকভাবার মনোভাবের অবসান ঘটাতে হবে।

চা শিল্পে ব্যাবসা করতে হলে চা বাগানের ইজারাদারদের ইজারাচুক্তি, শ্রম আইন ও বিধিমালা মেনে ব্যাবসা করতে হবে। চা বোর্ডের মাধ্যমে বেআইনিভাবে বাগান পরিচালনাকারি ইজারাদারদের তালিকাভুক্ত করে লিজ বাতিল করে লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করতে হবে। পরবর্তীতে অভিযুক্ত ইজারাদার কর্তৃপক্ষ চা শিল্পে যেন ব্যাবসা না করতে পারে সে ব্যাপারে নজরদারি করতে হবে।  অবিলম্বে দলই চা বাগানের  লিজ বাতিল করে আপাতত চা বোর্ডের অধীনে উৎপাদন কাজ চালু করার পাশাপাশি ইজারাচুক্তি ভঙ্গ ও বেআইনি লকআউট এর জন্য দায়ী দলই চা বাগানের ইজারাদার কর্তৃপক্ষ দলই টি কোম্পানী লিমিটেডকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাহলেই চা বাগানের ইজারাদারেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ করতে আন্তরিক হবে আর দলই চাগান সংকটে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

মিখা পিরেগু : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ এবং যুগ্ম সদস্য সচিব, চা শ্রমিক-ছাত্র-যুব মঞ্চ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত