প্রণবকান্তি দেব

০১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ২১:৫৩

‘সবারে আমি প্রণাম করে যাই’

ভারতের প্রাক্তন রাস্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে যে হাহাকার, স্মৃতি ও শ্রদ্ধার্ঘ্যের যে নিরুপম তর্পন, কর্ম ও জীবন নিয়ে যে আলোঝরা বিশ্লেষণ চলছে তাতে তাকে সমাজ ও রাজনীতির এক কিংবদন্তি বলতে দ্বিধা নেই।

৩১ আগস্ট, সোমবার রাতে অভিজিৎ মুখার্জির টুইট বার্তা "সমগ্র ভারতবাসীর দোয়া ও প্রার্থনার পরও আমার বাবা শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এইমাত্র পরলোকগমন করলেন"- ভারত উপমহাদেশসহ পুরো পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির মনে ছড়িয়ে দেয় এক গভীর দুঃখ। এমনই এক জীবন তিনি যাপন করে গেছেন যে, শেষ নিঃশ্বাসটি নেয়ার সাথে সাথেই লক্ষ-কোটি মানুষ প্রিয়জন হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়লেন। কেবল  রাজনীতি নয়, জ্ঞান, প্রজ্ঞার দীপ্তি দিয়ে তিনি আলোকিত করে গেছেন যে জনসমাজ -তার সবখানে নেমে এলো বিষাদ-বেদনা ভরা এক নিশ্চুপ রাত। মুহূর্তেই তাঁর বর্নাঢ্য জীবন,জীবনের পলে পলে জমা হওয়া গৌরব-কীর্তি আলোচনায় উঠে আসতে থাকে।

একজন সাধারণ শিক্ষক থেকে ভারতের রাস্ট্রপতির আসন অলংকৃত করা প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন সে কথা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমৃত্যু শ্রদ্ধাবোধ, বাংলাদেশের সমাজ-মানস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উন্নয়নে তার আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রভৃতি বিষয়গুলো আমাদের কারো অজানা নয়। হতে পারে সেজন্য এই জনপদে তিনি অন্যরকম এক শ্রদ্ধার আসন গেড়েছিলেন।

আমি তার মৃত্যুকে দেখি এক স্বাপ্নিক যোদ্ধার জীবনাবসান হিসেবে, এ যুগের চাণক্যের বিদায় হিসেবে; তার মৃত্যু বস্তুতপক্ষে এক আদর্শিক রাজনীতির বটবৃক্ষের বিদায়, একজন পন্ডিত-উদারনৈতিক হৃদয়বান মানুষের প্রস্থান।

মানবিক সংকটের বর্তমানকালে প্রণব মুখার্জির মতো মানুষের চলে যাওয়া নীতি ও নন্দনের জগতজুড়ে তাই এক অপার শূন্যতা তৈরি করে দেয়।

প্রণব মুখার্জির জীবন ও কর্ম অনুশীলন নতুন প্রজন্মকে উদ্ধুদ্ধ করতে পারে বহুমাত্রিক চিন্তা চেতনায়। সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম নিয়ে জীবনকে ঘিরে তিনি যে অসাধারণ স্বপ্ন বুনেছিলেন, জীবনভর জ্ঞান তৃষ্ণায় নিমজ্জিত থেকে  শিক্ষকতা দিয়ে যে জীবনের সূচনা, রাজনীতির ময়দানে নানা চড়াই উৎরাই-প্রতিটি পদক্ষেপে ধৈর্য্য, বুদ্ধিদীপ্ততা, সততা, নীতিবোধ দিয়ে সাফল্যের চূড়ায় পৌছে যাওয়া- সংগ্রামমুখর এ জীবন পাঠে পরবর্তী জীবন আলোকিত হতে পারে নিঃসন্দেহে।

যারা স্বপ্ন দেখে জীবনকে ঘিরে, তাদের বলি প্রণব মুখার্জির গ্রন্থগুলো পাঠ করুন। এগুলোই তাকে চেনার উত্তম ব্যবস্থা। মিডটার্ম পল, বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল, ইমারজিং ডাইমেনশনস অব ইন্ডিয়ান ইকোনমি, অফ দ্যা ট্র‍্যাকঃ সাগা অফ স্ট্রাগল এন্ড সেক্রিফাইস, চ্যালেঞ্জ বিফোর নেশন, দ্যা ড্রামাটিক ডিকেডঃ ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস, কোয়ালিশন ইয়ারস ইত্যাদি গ্রন্থগুলোতে প্রণব মুখার্জিকে পাওয়া যাবে অনন্য এক মহিমায়। জ্ঞান তাপস এ মনীষার জীবন ও জীবনের অলিগলিকে দেখার এক আশ্চর্য জাদুকরী চোখ যে ছিল তা তার রচনা সম্ভার পাঠ শেষে নিঃসংকোচে বলা যায়। তাঁর সৃষ্টি কর্ম অনুশীলন মানে তো এ উপমহাদেশীয় রাজনীতির এক নিপুণ পাঠই।

সুচিন্তা আর মনন চর্চার এ-ই দুর্ভিক্ষকালে প্রণব মুখার্জির জীবন অধ্যয়ন আমাদেরকে আলোর সন্ধান দিতে পারে। এক জীবনে কতো ভাঙাগড়ার যে খেলা চলে, এক জীবনে স্বপ্ন ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকলে সাফল্য কিভাবে ধরা দেয়, ক্ষমতার উচ্চাসনে বসেও কিভাবে গনমানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা যায়, ইতিহাসের পথ পাড়ি দিতে দিতে নিজেই কী করে হওয়া যায় ইতিহাস-প্রণবের জীবন অনুশীলনে এ শিক্ষাগুলো পাওয়া যাবে। তার চরিত্র থেকে যদি ধৈর্য্য, বিচক্ষণতা, উদারনীতি, অসাম্প্রদায়িকতা, মোহমুক্ততার শিক্ষা আমরা গ্রহণ করতে পারি তবেই হবে তার প্রতি সত্যিকারের প্রণতি নিবেদন। ৮৫ বছরের জীবনে ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে তিনি যা দিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তার যে রাজনৈতিক জীবনের উত্থান, সমগ্রজীবনভর বাঙালিত্বকে বুকে ধারণ করে এদেশের সুখে,দুখে পাশে থাকার যে নির্মোহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন-সেই প্রতিটি অব্যয়, অক্ষয় অধ্যায় আমরা পাঠ করতে পারি নিজেদের সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে। কেন না প্রণব মুখার্জিদের মতো মানুষ বারে বারে পৃথিবীতে আসেন না। তারা আসেন শত বছরের সাধনায় সময়কে আলোকিত করার প্রয়াসে। এসে নিজ কর্মগুনে মহিমান্বিত করে দিয়ে যান চারপাশকে।

প্রণব মুখার্জির মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে তার মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন উল্লেখ করে টুইটারে লিখেছেন, ‘সবারে আমি প্রণাম করে যাই’ : বাবা, আপনার প্রিয় কবির একটি চরণ উদ্ধৃত করে সবার প্রতি আপনার বিদায়বাণী তুলে ধরছি। দেশ ও জাতির সেবায় আপনার জীবন ছিল পূর্ণাঙ্গ, অর্থবহুল। আপনার কন্যা হিসেবে জন্ম নিয়ে নিজেকে আমি ভাগ্যবতী মনে করছি।’ ভাগ্যবান আমরাও, ভাগ্যবান উত্তর প্রজন্ম।

প্রণবকান্তি দেব: লেখক, শিক্ষক, সংগঠক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত