আমিনুল ইসলাম রোকন

০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:১০

সালমান শাহ : সে এক মুগ্ধকর

বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে গান গাইছেন সালমান শাহ – শাবনূর। ছন্দে ছন্দে নাচছেন।

সালমান আহবান জানাচ্ছেন-  
“বৃষ্টিরে বৃষ্টি আয়না জোরে
ফিরে যাবোনা আজকে ঘরে”…
বিপরীতে শাবনূর বলছেন-
“বৃষ্টিরে বৃষ্টি থেমে যারে

ভেজা শাড়িতে লজ্জা করে”..
সালমানের খুব ইচ্ছে হচ্ছে প্রিয়জনকে একটু ছুঁয়ে দেবেন।  বলছেন-
“লজ্জাবতী পাতার মতো
ছুঁলে কেন গুটিয়ে যাও”
শাবনূর জবাব দিলেন-
“তুমি কেনো পাগল এত
যখন তখন জ্বালাও আমায়
এখন যেতে দাও, দাওনা বিদায়”
কিন্তু সালমান বিদায় চাচ্ছেন না।  একটু ছুঁয়ে  দেখার ইচ্ছা নিয়ে বলছেন- এই মন তোমাকে ছাড়তে না চায়!
সালমান যেন স্নায়ুর সকল ইচ্ছা দিয়ে প্রিয় মুখকে কাছে পেতে চাইছেন। আকুতি জানাচ্ছেন-

“কাছে এসো আরো কাছে
তুমি আরো আপন হয়ে।”
শাবনূর এবার সারা দিয়েছেন। কথা দিলেন-
“সময় হলে আসবো কাছে
এখন তুমি দূরেতে রও..”

শাবনূর কথা রেখেছিলেন। একদিন হৃদয়ের খুব কাছাকাছি এসেছিলেন সালমানের। বুকে মাথা রেখে বললেন –

“প্রথম প্রেমের ছোঁয়া তুমি
তুমি যে মান-অভিমান
তোমায় নিয়ে লেখা যেন
সারা পৃথিবীর গান।”

সালমানও তখন কি করলেন? তিনিও গেয়ে উঠলেন-

“হাজার তারের বীণা তুমি
তুমি সুরের ঝংকার
তুমি আমার আষাঢ়-শ্রাবণ
তুমি বসন্ত বাহার
রাগ-রাগিনীর ফুল-কলিতে
কন্ঠে পড়াবো মালা
ফুসফুসের সমস্ত শক্তি দিয়ে শাবনূর তখন নিশ্বাস ছাড়েন –
“তুমি মোর জীবনের ভাবনা
হৃদয়ে সুখের দোলা
নিজেকে আমি ভুলতে পারি
তোমাকে যাবে না ভোলা”

হ্যা, “স্বপ্নের নায়ক খ্যাত” সালমমান শাহকে কেউই বুলতে পারেনি আজো। সুন্দর মুখশ্রি, প্রাণবন্ত অভিনয় আর দৃষ্টি কাড়া স্টাইল – মৃত্যুর পরেও যেন মানুষের হৃদয়ে সজীব উপস্থিতি তৈরী করে নিয়েছেন সালমান।

নব্বইয়ের দশকের বাংলা রূপালি জগতের এক ধুমকেতুর মতোই আবির্ভাব তার। দেশের সিনেমার ইতিহাসে যে ক’জন নায়ক সর্বমহলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন সালমান নামটি এর এক অনবদ্য ইতিহাস।

লাইট ক্যামেরা একশনের জগতে সালমান তৈরি করতে পেরেছিলেন এক অমলিন নিজস্বতা। রাজ্জাক-ববিতার সেই সাদাকালো দুনিয়ায় হুট করে সালমান এসে যেন রঙ ছড়িয়ে ছিলেন। কি যেন একটা ছিলো সালমানের মধ্যে, যে কারণে- দেশের পূর্ণদৈর্ঘ্যরে পুরো দৃশ্যই পাল্টে দিতে পেরেছিলেন তিনি। আর তারুণ্যের জুয়ার সৃষ্টি করে সালমান নামটি ঘিরে তৈরী করতে পেরেছিলেন এক মাত্রাহীন উন্মাদনা। প্রথম ছবি-কেয়ামত থেকে কেয়ামত দিয়েই মাত করে দিয়েছিলেন। দেশে হিন্দি সিনেমার রিমেক যেখানে রীতিমত হাসির খোরাক- সেখানে সালমান ছাপিয়ে গিয়েছিলেন মূল ছবির কুশীলব আমির-জুহি চাওলাকেও। যে কারনে বলিউডের খ্যাতনামা সিনামা স্টাররাও ফলো করতে শুরু করেন “সালমান স্টাইল”।

খরায় তপ্ত ঢাকাই সিনেমায় যেন আর্শিবাদের বৃষ্টি হয়েই আবির্ভাব তাঁর। তাইতো প্রথম সিনেমার প্রথম গানের মতোই মঞ্জিল ভালোবাসায় দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন সালমান। মেধাবী আর বৈচিত্রময় অভিনয় দিয়ে বাংলা সিনেমাকে যেন নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্নের ঠিকানায়।

সালমান ছিলেন সময়ের চেয়েও আধুনিক। দেশের মানুষ যেখানে ছিলো সিনেমা বিমুখ সালমান এসেই এই দৃশ্যের ‘ইউ টার্ন’ করতে পেরেছিলেন। জাদুর মতো সব ক্যারিশমা ছিলো তার মাঝে। অভিনয় দক্ষতার অনন্যতা দিয়ে সিনেমায় তোলেছিলেন ‘সালমান ঝড়’। সিনেমায় এক সরল যুগের শুদ্ধতাও এনেছিলেন তিনি। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে সোরগোল ফেলে দেওয়ার পর টানা ‘হিট’ ছবি উপহার দিয়ে অল্প সময়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন স্বপ্নের নায়কে। তাই সবকিছু ছাপিয়ে সালমান নামটি এখনো মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে মানুষকে।

সালমানের হাত ধরে সোনালি সময়ের পথে এগুচ্ছিল ঢাকাই সিনেমা। কিন্তু হঠাৎ পাল্টে যায় সব। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎই এক বজ্রপাত। দেশের সিনেমাকে সোনালি সময়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে সালমান, সিনেমায় মানুষকে হাসাচ্ছেন-কাদাচ্ছেন যে সালমান, মানুষকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখাচ্ছেন যে সালমান, যে সালমান স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, হৃদয়ে দিচ্ছেন প্রেম-হঠাৎ সেই সালমানই চলে গেলেন অন্তহীন শূন্য জগতে।

পৃথিবীতে খুব কম খ্যাতনামা আছেন- মৃত্যুর পরও যাদের জনপ্রিয়তা ছিলো তুঙ্গে। সালমান নামে খ্যাত সিলেটর ছেলে ইমন সেই ক্ষণজন্মাদেরই একজন। যিনি মৃত্যুর দীর্ঘ সময় পরও আরো বেশী জনপ্রিয়। তার মৃত্যুও এক অন্তহীন রহস্য। যে মৃত্যুকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে সর্ব বিনাশী এক দুঃখও। সালমানশাহ হত্যা মামলা নিয়ে এখনো দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এই মহানায়কের মা নীলা চৌধুরী। অস্বাভাবিক এ মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে বছরের পর বছর ধরেই। তদন্ত ঘুরছে দপ্তরে দপ্তরে।

পুলিশ থেকে র‌্যাব অতঃপর পিআইবি কেউ সুরাহায় আনতে পারছেননা রহস্যের এ মৃত্যু। ২০১৭ সালমানের হত্যা মামলার আসামী রুবী নামের এক মহিলার ভাইরাল ভিডিওতে সারা দেশে ঝড় ওঠে। হত্যা না আত্মহত্যা-নতুন করে দোলা দেয় পুরনো সেই প্রশ্ন। কিন্তু কিছুদিন পরই সব নিঃশব্দ হয়ে যায়। সর্বশেষ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিআবির রিপোর্টেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে হত্যা নয় আত্মহত্যাই করেছিলেন সালমান।  যা মানছেননা সালমানের পরিবার। এমনকি তার অগণিত ভক্তরাও। দিনে দিনে মৃত্যু রহস্যটি আরো রহস্যময় হয়ে উঠছে তাদের কাছে। পিআইবির এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে রিট পিটিশনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন সালমান শাহ’র মামা কুমকুম। পিআইবির পূর্ণাঙ্গ  প্রতিবেদন তাদের হাতে আসলেই এর বিরুদ্ধে রিট করা হবে।

সালমান শাহ’র মৃত্যু নিয়ে হয়তো রহস্যের শেষ হবে না। কিন্তু যুগের পর যুগ সালমান তরুণদের হৃদয়ে দোলা দেবেন। কেয়ামত থেকে কেয়ামত, স্বপ্নের পৃথিবী, সত্যের মৃত্যু নেই, সালমান অভিনীত এমন ২৭টি সুপার হিট সিনেমা দর্শকদের আপ্লুত করবে অনন্ত কাল। পথহারা ঢাকাই সিনেমাকেও আঙুল তুলে জানিয়ে দিবে সিনেমার স্বর্ণযুগ। আর এভাবে সালমান শাহ বেঁচে থাকবেন প্রাণ থেকে প্রাণে। হৃদয়ের গহীন ভেতর। সালমানের অগণন ভক্তরা চিরদিন হয়তো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখবেন তাকে ঘিরে। একেকজন সালমান ভক্তের খামে মোড়া অন্তরঘন দীর্ঘশ্বাসও হয়তো উড়ে উড়ে যাবে নীল ঠিকানায়। যেখানে হয়তো লিখা থাকবে-
“ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে
আমার ভেতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে….”

আমিনুল ইসলাম রোকন : সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত