অপূর্ব শর্মা

০৭ মার্চ, ২০২১ ২০:৩৪

দাবায়ে রাখা যায়নি আমাদের, দাবিয়ে রাখা যাবে না

সাতই মার্চের প্রসঙ্গ এলে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটির পাশাপাশি যে কথাটি আমার মনোভূমিকে আন্দোলিত করে সেটি হচ্ছে আমাদের ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’।

১৯৭১ সালের এ দিনটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে একাধিকবার এই কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন। সেদিনের সেই অমর ভাষণের কালজয়ী সেই উচ্চারণ অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমানিত হয়েছে। আমাদের দাবিয়ে রাখা যায়নি। পাকিস্তানিরা আমাদের দাবাতে পারেনি, দাবিয়ে রাখতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একাত্তরে আমরা ঝাপিয়ে পড়েছিলাম স্বাধীকারের লড়াইয়ে। তার হার না মানার সংকল্পে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে আমরা শত্রুমুক্ত করেছি প্রিয় মাতৃভূমিকে। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসেরই জয় হয়েছিলো একাত্তরে। গণহত্যা চালিয়ে, বর্বরতা চালিয়ে, অগনন প্রাণ কেড়ে নিয়ে, নারী ধর্ষণ করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে, লুণ্ঠনে উন্মত্ত হয়ে, নির্যাতনে জাতিকে রক্তাক্ত করে, পুরো বাংলাদেশকে বধ্যভূমি বানিয়েও আমাদের মনোবলে চির ধরাতে পারেনি পাকিরা। কারণ বঙ্গবন্ধুর প্রতি, তার নেতৃত্বের প্রতি অগাদ বিশ্বাস ছিলো জাতির।

সে কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানে। জনতার কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি উত্তাল সময়ে দাড়িয়ে লিখেছিলেন, ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।’

ঠিক তাই। স্বাধীনতার অগ্নিগর্ভ সময়ে মুক্তিকামী প্রত্যেক বাঙালি হয়ে উঠেছিলো মুজিব সেনা। লড়াইয়ের ময়দানে, প্রাণ বিসর্জনে বঙ্গবন্ধুই দিয়েছেন প্রতিটি যোদ্ধাকে প্রেরণা। তার দাবিয়ে না রাখার অগ্নিমন্ত্রই ছিলো আমাদের পাথেয়।

একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর স্বাধীন হলো দেশ। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন দেশে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু দাবায়ে রাখতে না পারার কথাটি আবারও উচ্চারণ করলেন। আত্মশক্তির এই কথাটি বললেন তিনবার। নতুন সংকল্পে শুরু করলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের কাজ। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চললেন দৃপ্ত প্রত্যয়ে। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শত্রু এবং তাদের আন্তর্জাতিক মিত্ররা শুরু করলো ষড়যন্ত্র। স্বনর্ভির বাংলাদেশ গঠনের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়ানোর অপচেষ্টা চালাতে থাকলো তারা।

বাংলাদেশকে নিয়ে সে সময় আন্তর্জাতিক মোড়লদের দৃষ্টিভঙ্গির বহিপ্রকাশ ঘটে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্যে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হতে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তার সেই কথাটি কত বড় মিথ্যাচার ছিলো তা সময় পরিক্রমায় প্রমানিত হয়েছে।  

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে তার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টা শুরু হলো। পুরস্কৃত করা হলো ঘাতকদের। স্বাধীনতার শত্রুদের ফিরিয়ে আনা হলো দেশে। নানাভাবে তাদেরকেও করা হলো পুরস্কৃত। রচিত হতে থাকলো একের পর এক কলংকিত অধ্যায়। কিন্তু ঘাতকরা জানতো না, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই। তিনি চির অমর। চেতনার যে বহ্নিশিখা তিনি প্রজ্জ্বলিত করে গেছেন, তা গ্রহণের কালো ছায়া হয়ে ক্ষণিকের জন্য হয়তো আলোকরস্মি বিকরণের পথকে রুদ্ধ করেছে কিন্তু গ্রাস করতে পারিনি। দুঃশাসনের বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে মুজিব সেনারা। বিদেশে থাকায় প্রানে বেচে যান জাতির জনকের দুই সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় বছর পর শেখ হাসিনা ফিরে আসেন দেশে।

১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রাকৃতিক বৈরিতা উপেক্ষা করে পনেরো লক্ষাধিক মানুষ ঢাকায় স্বাগত জানায় তাকে। সেদিন জনতাকে উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনার ভাষ্য ছিলো- ‘আমি নেতা নই, সাধারণ মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী, আপনাদের কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আপনাদের নিয়ে নিরলস সংগ্রাম করে যাবো।’

পনের বছর সংগ্রাম চালিয়ে তারই নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় আওয়ামীলীগ। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। কিন্তু পথচলায় ছন্দপতন ঘটে ২০০১ সালের নির্বাচনে। হেরে যায় আওয়ামী লীগ। ২০০৪ সালে ফিরে আসে ভয়াল আগস্ট। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য প্রকাশ্যে চালানো হয় গ্রেনেড হামলা। একুশে অগাস্টে ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সমাবেশে ভয়াবহ হামলায় সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলো ২৪ জন নেতা-কর্মী। শেখ হাসিনাসহ সেদিন আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক মানুষ। মুজিব সেনারাই সেদিন বুকে আগলে রেখে রক্ষা করেছিলেন শেখ হাসিনাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রত্যাবর্তনের অনন্য গল্প লিখে পুণরায় ক্ষমতায় আসেন জনক কণ্যা। তবে এজন্য বন্ধুর পথ পারি দিতে হয় তাকে। এমনকি জেলের ঘানিও টানতে হয়। ক্ষমতাসীন হয়ে আত্মনিয়োগ করেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের কাজে। পিতার আদর্শেরই বাস্তবায়ন করে চলেছেন তিনি। বাংলাদেশ আজ উন্নয়ননের রোল মডেল। জাতির জনকের স্বপ্নের পথ ধরেই আজকের পর্যায়ে এসেছে বাংলাদেশ। এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সারথী হয়ে বাংলাদেশ যে বিশে^র বিস্ময় তা বার বার প্রমান করে চলেছেন শেখ হাসিনা। যে পাকিস্তান আমাদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিলো, সেই পাকিস্তানই কালপ্রবাহে সব সূচকে আমাদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে আজ। বাংলাদেশের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতে বাধ্য হচ্ছে তারা।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য শুনলে সহজেই অনুমিত হবে, বাংলাদেশের অবস্থান। তিনি বলেছেন, ‘বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ভারতের চেয়ে অনেক বেশি সফল। গড় আয়ু, নারী স্বাক্ষরতার মতো ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশের জাতিগত সহাবস্থান অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।

সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পদ্মা সেতু নির্মানের স্বপ্ন দেখালেন শেখ হাসিনা। অন্তরায় হয়ে দাড়ালো বিশ্ব ব্যাংক। অভিযোগ উত্থাপন করা হলো দুর্নীতির। চ্যালেঞ্জ করলেন তিনি। মিথ্যে প্রমাণিত হলো অভিযোগ। ঘোষণা দিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের। অনেকেই বলল, এটা অলীক স্বপ্ন। সেই স্বপ্নই এখন বাস্তব। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। টানা এক যুগ ক্ষমতায় থাকার কারনে বাংলাদেশ এখন কাঙ্খিত সাফল্যের কাছে। এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে বাংলাদেশ। তা আমাদের জন্য যেমন আনন্দের, তেমনই গৌরবের।

গত ২২-২৬  ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) বৈঠকে বাংলাদেশকে এলডিসি উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়। মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরত-এই তিন সূচকে বিচার করা হয় একটি দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল ধাপে উত্তরণ করবে কি না। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম দেশ হিসেবে তিনটি সূচকের সব কটি পূরণ করে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হলো। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষে এবং স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে এই ঘোষণাটি আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় পাওনা। ঐতিহাসিক সাতই মার্চ যে স্বপ্ন যাত্রার সূচনা করেছিলেন মহানায়ক, আজ তা পরিপূর্ণতার পথে। প্রেরণার উৎস হয়ে সেই ভাষণটিই আমাদেরকে পথ দেখাচ্ছে, মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে। সর্বশেষ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ তিন অনুপ্রেরণীয় নারী নেতার তালিকায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার লন্ডনের বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে দেওয়া বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২১ উপলক্ষে দেওয়া বিশেষ ঘোষণায় মহামারি চলাকালীন সফলভাবে নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ তিন নারী নেতার নাম ঘোষণা করেন কমনওয়েলথের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড কিউসি। তারা হলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন ও বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী মিয়া আমোর মোটলি।’

এ ঘোষণাটি অবশ্যই আমাদের জন্য আত্মশ্লাঘার। করোনা মোকাবেলায়ও আমরা ভালো অবস্থায় রয়েছি। বিশ্বে আমাদের অবস্থান ২০তম, আর দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। শেখ হাসিনার দক্ষতার কারনেই যেখানে ১৩০ টি দেশ কোনো টিকাই পায়নি সেখানে আমরা পেয়েছি। টিকা নিয়েও ষড়যন্ত্র হয়েছে। অপপ্রচার হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কান দেননি তিনি। এগিয়ে যাচ্ছেন আপন প্রত্যয়ে।

গত ৪ মার্চ একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না। করোনাভাইরাস যখন পারেনি তখন আর কেউ পারবে না। এটাই আমার বিশ্বাস।’ সার্তই মার্চের প্রাক্কালে তার এই বক্তব্যে সেই দাবিয়ে রাখতে না পারার বিষয়টি অনুরণিত হলো। পিতার মতোই দৃপ্ত কন্ঠে শেখ হাসিনার উচ্চারণ প্রত্যক্ষ করলো জাতি। সাতই মার্চের সাজুয্য খুজে পেলাম আমরা। যে ভাষণের প্রেরণায় আজকের বাংলাদেশ. সেই ভাষণের উজ্জীবনীতেই আমাদের অগ্রগতি। সাতই মার্চের ভাষণ যেমন জাতি রাষ্ট্র গঠনের বীজমন্ত্র. তেমনই সমৃদ্ধ দেশ গঠনেও এই ভাষণের ভূমিকা অনস্বীকার্য্য। যতদিন রবে বাংলাদেশ, ততদিন এই ভাষণ স্বপ্ন, সম্ভাবনা এবং অগ্রগতির সোপান রচনায় পথ দেখাবে আমাদের।  
অপূর্ব শর্মা : লেখক, সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত