আবুল কাশেম উজ্জ্বল

২৩ এপ্রিল, ২০২১ ০২:২৫

শিক্ষার উদ্দেশ্য বনাম শিক্ষিতের আচরণ

বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার কত, এর উত্তর অনেকেরই জানা। স্বাক্ষরতা অভিযানে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং এ হার প্রায় ৭৪ শতাংশ। কিন্তু স্বাক্ষরতা অভিযানে আমরা সাফল্য দেখালেও শিক্ষার যে উদ্দেশ্য তাতে আমাদের সাফল্য কতটা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এদেশে সনদধারী মানুষের সংখ্যা অনেক কিন্তু শিক্ষিত মানুষ হিসেবে উপযুক্ত আচরণ প্রদর্শন করার মানুষের ঘাটতি প্রকট। এখন যে কেউ চেষ্টা করলে ও সুযোগ থাকলে অনায়াসে প্রাথমিক থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর সনদ পেতে পারেন, এমনকি পিএইচডি অর্জন করাও এখন খুব সহজ। কেবল শিক্ষক নন, এর বাইরের পেশার মানুষের মধ্যে পিএইচডি অর্জনের এক ধরনের ‘ট্রেন্ড’ লক্ষ করা যাচ্ছে যদিও তা কতটা মানসম্মত ও প্রয়োজনসাপেক্ষ তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।

শিক্ষা হল একটি আচরণগত পরিবর্তন এবং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে শেখার সুবিধা বা জ্ঞান, দক্ষতা, মান, বিশ্বাস এবং অভ্যাস অর্জন করা যায়। Oxford Advanced Learner’s Dictionary-তে Education শব্দের অর্থ করা হয়েছে, Knowledge, Abilities and the development of character and mental powers. বাংলা ‘শিক্ষা‘ শব্দটি সংস্কৃত ধাতু শাস থেকে এসেছে যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশ বা উপদেশ দেওয়া। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ Education শব্দটির উৎস কয়েকটি ল্যাটিন শব্দ থেকে। কারো মতে শব্দটি ল্যাটিন Educere থেকে উদ্ভূত, যার ইংরেজি অর্থ হচ্ছে To lead out অর্থাৎ শিশু এবং শিক্ষার্থীর মনের মধ্যে যে সব মানসিক শক্তি জন্মসূত্রে বিদ্যমান সেগুলিকে বাইরে আনা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক জীবনের সুষম বিকাশ সাধন করা, এর ব্যাপ্তি দীর্ঘকালব্যাপী যা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় সীমাবদ্ধ থাকে না।

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও বিতর্কের সুযোগ খুব কমই, বরং বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাণীগুলো প্রায় একই সুরে গাঁথা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে প্লেটোর ভাবনায় ছিল শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতি, যেখানে সক্রেটিস শিক্ষাকে দেখেছেন মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের বিকাশ হিসেবে। এরিস্টটলের দর্শনে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা এবং ফ্রোবেলের মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য পবিত্র জীবনের উপলব্ধি। অন্যদিকে জন লক বিষয়টিকে দেখেছেন সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্বকরণের মাধ্যম হিসেবে। তবে অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথের বক্তব্য বর্তমান সময়ের সাথে বেশ সঙ্গতিপূর্ণ, শিক্ষাকে দেখেছেন এমন একটা শক্তিরূপে যা মানুষের অন্তরে নিহিত র‌্যাসানালিটিকে জাগিয়ে তোলে এবং অ্যানিম্যালিটিকে নিয়ন্ত্রণে করে। বিখ্যাত কবি মিল্টন বলেন “Education is the Harmonious development of body, mind and soul.” অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে দেহ, মন এবং আত্মার সমন্বিত উন্নয়নের নাম। তাদের বক্তব্যকে যদি গ্রহণ করি তাহলে বুঝতে হবে আমাদের শিক্ষা আমাদের বস্তুগত অর্জনে সহায়ক হলেও মানবিক উৎকর্ষতার বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

যদি জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার কত তাহলে অনেকেই হয়ত আমাকে বোকা ভাববেন। আমরা সনদধারী হচ্ছি ঠিকই কিন্তু শিক্ষা আমাদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব কতটা তৈরি করতে পারছে, কতটা মানবীয় আচরণ করতে শেখাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্নের অভাব নেই। ভেবে দেখেন, আজ আমাদের দেশে যত দুর্নীতি হয় তা কারা করছেন। আর্থিক বা নৈতিক যে কোন ধরনের দুর্নীতি বা অনাচারের জন্য আলোচিত, সমালোচিত ব্যক্তিদের তালিকা করলে সবার আগে যাদের নাম আসবে সেখানে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শীর্ষস্থানে থাকবেন। এটা বলব না যে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তারা দুর্নীতি বা অপরাধ করছেন না। তবে ঐ মানুষগুলো তাদের অপকর্মের মাধ্যম হিসেবে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সনদধারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া করতে পারবে কি?

যেদেশে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা কৃষিঋণের জন্য গরীব, বৃদ্ধ কিন্তু আপেক্ষিকভাবে সৎ কৃষকের কারাবাস হয়, সে দেশেই শত বা হাজার কোটি টাকা লোপাটকরীদের বিচার করা সহজ নয়। বরং তারা তথাকথিত শিক্ষিত বলেই আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যায় এবং মালয়েশিয়া বা কানাডায় ‘সেকেন্ড হোম’ এ নিরাপদে বাস করেন। দেশের টাকায় শিক্ষিত হয়ে দেশের সম্পদ লোপাট করে বিদেশে সম্পদ উপভোগ করার মানসিকতা কি শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে? দেশের অর্থনীতিকে নিজেদের শ্রম-ঘামে-রক্তে যারা সজীব রাখে সেইসব কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষগুলো অতি কষ্টে জীবন-যাপন করলেও সহজে দুর্নীতি করেনা বা তাদের সেই সুযোগও নেই। বরং তাদের মধ্যে নিয়ম-নীতির মধ্যে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা রয়েছে। আর যারা দেশের টাকায়, বলা উচিৎ মেহনতি মানুষের দেয়া করের টাকায় লেখাপড়া করে তকমাধারী হয়, তারাই রাষ্ট্রের সব সুবিধা ভোগ করার পরও অন্যায় ও অনৈতিকভাবে জনগণের অধিকার ও সম্পদ নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করে। অথচ তাদের কাছেই প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি।

আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একাংশ নিজেদের র‌্যাসনালিটি কাজে না লাগিয়ে অ্যানিম্যালিটিকে কাজে লাগাচ্ছেন। এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তাদেরকে মানুষের চেয়ে অ্যানিম্যালের ন্যায় আচরণে অভ্যস্ত করে দিচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে আরও জঘণ্য। শিক্ষা তাদের কতটা কাজে লেগেছে বা লাগছে তা তারাই ভাল বুঝবেন, কিন্তু আমাদের জন্য যে ক্ষতির কারণ তা নতুন করে বলার দরকার নেই। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য তাদেরকে সুশীল করেনি, তাদের র‌্যাসনাল আবেগ ও নৈতিকতাকে জাগ্রত করেনি। অ্যানিমেলের মধ্যেও প্রতিযোগিতা থাকে, তবে সেটা কেবল বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু এ শ্রেণির মানুষ মোটেও র‌্যাসনাল নন, বরং তাদের চাহিদার কোন সীমা নেই।

দুর্নীতির সূচকে ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু মাত্র ২৬ পয়েন্ট নিয়ে আমাদের আত্মতৃপ্তির সুযোগ আছে কি? বরং এটা দৈনন্দিন জীবনের সাথে যেভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে তাতে করে ভবিষ্যতে এর লাগাম টেনে ধরা খুব সহজ হবে না। এরা কেবল দুর্নীতিই করে না, সাথে সাথে দুর্নীতির বীজও বপন করে ভবিষ্যতে আরও দুর্নীতি করার জন্য। যে কারণে এ দেশে রাস্তা না থাকার পরও ব্রিজ হয়, এক নদীর ১০ কিলোমিটারের মধ্যে একাধিক ব্রিজ তৈরি করা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দ বছরের পর বছর বাড়তে থাকে। নিজেদের সাথে সাথে পরিবার পরিজনদেরও দুর্নীতির শিক্ষা দিয়ে নতুন প্রজন্মের দুর্নীতিবাজ তৈরি করছে। তাই আমাদের দরকার নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যাদের কাছে অবৈধ অর্থের চেয়ে দেশ প্রেম ও মূল্যবোধ কাজ করবে।

আমাদের দরকার এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা যা আমাদের র‌্যাসনালিটি শিক্ষা দেয়, অ্যানিম্যালিটি রোধ করে।

আবুল কাশেম উজ্জ্বল: শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত