জফির সেতু

২৯ এপ্রিল, ২০২১ ২২:১৬

কেন এই অভিনন্দন? কেন এত অভিনন্দন?

[সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপদ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ড. জফির সেতু। তার এই পদোন্নতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিনন্দন জানাচ্ছেন অনেকে। এই অভিনন্দনবার্তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার উদ্দেশ্য, সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যত নিয়ে লিখেছেন তিনি।-বি.স.]

একটিমাত্র অভিনন্দন-পোস্টে চব্বিশঘণ্টারও কম সময়ে লাইকের পরিমাণ সাড়ে ছয়হাজার, কমেন্ট-সংখ্যা প্রায় আঠরোশ! এরকম অনেক পোস্টে হাজার হাজার, শতশত লাইক আর কমেন্টস্। কিন্তু কেন এই অভিনন্দন, কেন এত অভিনন্দন?

এই প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরছে গতকাল থেকে। ঘটনাটা এই: আমি অধ্যাপক পদে বৃত হয়েছি চলতি মাসের ১২ তারিখে। আমি যে-চাকরি করি এতে এটাই সর্বোচ্চ পদ এবং এই পদে উন্নীত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু সত্যি আমি খুশি হয়েছি কিনা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। আমার খুুশি হওয়া উচিত কিনা তাও আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি। হয়তো খুশিও হয়েছি। কিন্তু আমার ভিতরে একটা সংকোচ কাজ করেছে। এই পদের জন্য আমি কতটা যোগ্য, এব্যাপারে আমার সংশয় রয়েছে। সংশয়-সংকোচ যে রয়েছে তার প্রমাণ আমি এই খবরটি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করিনি।

দুয়েকজন (আক্ষরিক অর্থে) ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে কথাপ্রসঙ্গে শুধু তথ্যটা দিয়েছি। কিন্তু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিনি।

কিন্তু গতকাল সকালে যখন ঘুম ভাঙে আমার স্ত্রী সাহেদা শিমুল আমাকে প্রথমেই যথারীতি গুড-মনিং জানান এবং মোবাইল-ফোনে চোখ রাখতে রাখতে বলেন ফেসবুকে পদোন্নতির বিষয়টি আমার এক সহকর্মী শেয়ার করেছেন। তিনি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নিলুফা আক্তার। এর আগে তাঁর সঙ্গে এব্যাপারে আমার কথাও হয়নি; আমি জানতাম না বিভাগীয় প্রধান ছাড়া অন্য সহকর্মী বিষয়টা জানতেন কিনা। অবশ্য এর আগে একদিন সিনিওর অধ্যাপক আবদুর রহিম মোবাইল ফোনে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। নিলুফা যেটা করেছেন; তাঁর শুভেচ্ছাটা সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমেই দিয়েছেন এবং অন্যরা বিষয়টি জানুক এটা মনে করেই হয়তো তা করেছেন। এই আন্তরিকতার জন্য নিশ্চয়ই আমি তাঁর কাছে ঋণী। কিন্তু এই অভিনন্দন বার্তায় বিষয়টি অনেকেই জানতে পারেন দেশে-বিদেশে এবং বিভিন্নভাবে স্ট্যাটাস দিয়ে; মন্তব্য করে, লাইক দিয়ে সারাটা দিন জুড়ে আমাকে অভিনন্দনে সিক্ত করা হয়। খুব ঘনিষ্টজনেরা দুঃখও পান অন্যের মাধ্যমে খুশির বিষয়টি জানতে পেরেছেন বলে। কিন্তু তারা তো আর আমার ভিতরকার সংকোচ-সংশয়-দ্বিধাটা জানেন না। আর এরকম একটা বিষয় সামাজিক মিডিয়ায় ফলাও করা যায় কিনা সেটা নিয়েও আমার ভেতরে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু তাও তো আর কাউকে বলার কথা নয়।

বিজ্ঞাপন



সন্ধ্যার পর আমার মনে হলো ফেসবুকের ব্যক্তিগত তথ্যে অন্তত আমার নতুন পজিশনটি যুক্ত করা উচিত। এর মাধ্যমেও শুভাকাক্সিক্ষদের বার্তাটা দেওয়া যায় আমার তরফ থেকে। আমি তা-ই করলাম এবং আমার সঙ্গে সংযুক্ত বন্ধুরা অনায়াসেই জানতে পারেন। ফলে অভিনন্দন বার্তা; স্ট্যাটাস-কমেন্ট-মন্তব্য, যা আসলে অভিনন্দন বার্তাই; চলতে লাগল। মধ্যরাতে দেখতে পেলাম আমার বন্ধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলও অভিনন্দন জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এবং সেখানে হাজার হাজার লাইক-কমেন্ট যুক্ত হচ্ছে। পদোন্নতির মতো এই অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও প্রত্যাশা আমাকে আরও সংকোচিত ও সংশয়ী করে তোলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখাটি লিখতে হলো।

২.
জাতি হিসেবে আমাদের দীনতা থাকতে পারে অনেক; কিন্তু বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড়ো গুণ হচ্ছে তার শুভবোধ। আমার মনে হয় এটি এই জাতির সবচেয়ে বড়ো শক্তি। তা না-হলে যে-জাতিকে আর্যরা অসুরজাতীয় ম্লেচ্ছ, ইংরেজরা নোংরা, হীনন্মন্য ও চাটুকার এবং পাকিকস্তানিরা নিকৃষ্টস্বভাবের বলে আখ্যা দিয়েছে তারা একটা স্বাধীন-স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অধিকারী হয়ে পৃথিবীতের নিজের আসন অলংকৃত করতে পারত না। বাঙালির শক্তি মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক প্রকাশিত হয়েছিল; এরকম সম্ভ্রমবোধ পৃথিবীর অন্যকোনও জাতির মধ্যে দেখাও যায়নি; এটা অবশ্যই বাড়িয়ে বলা কথা নয়। ঘরের নববধূ থেকে ছয়বছরের শিশুপর্যন্ত সকলস্তরের মানুষকে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নজির বোধ হয় আর নেই।

এই শুভবোধের শক্তি আমি দেখেছি ছোটোবেলায়; আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে অন্যগ্রমে পড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই; আমার মনে আছে তখন ভাদ্রমাস হবে। ধানরোপণের মৌসুম। আমি বাবার সঙ্গে জমির আলপথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে রওয়ানা হয়েছি, দুপুর হবে তখন। বিভিন্ন ধরনের জমিতে চাষে মশগুল গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষগুলো। আমরা এগুচ্ছিলাম আর বারবার থেমেছিলাম; মানুষজনই আমাকে-আমাদেরকে থামিয়ে দিচ্ছিল। কোথায় যাই, কেন যাই। পড়ার জন্য যাচ্ছি, আমি বলছিলাম, কিংবা বাবা বলছে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি; এবার স্থায়ীভাবে রেখে আসব। চাষ করা বন্ধ করে, ধানেরচারা রোপণ করা বন্ধ করে মানুষ তখন এগিয়ে এসেছে; আমার গালে চুমু খেয়েছে কিংবা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছে; আশীর্বাদ করেছে। ‘যাও বাবা, অনেক বড়ো হও’। সেই মানুষগুলোর মুখ আমার চোখে আজ ঝাপসা হয়ে গেছে। এরা একই গ্রামের যে মানুষ; তা নয়। মূল সড়কে ওঠার আগে প্রায় তিনটি গ্রাম ফেলে আসতে হয়েছে; এই তিনগ্রামের মানুষই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, আর আর্শীবাদ করেছে। এদের অনেকেই আজ পৃথিবীতে নেই।

‘অনেক বড়ো হও।’ ‘সাবাস।’ এই শুভকামনা আমি সারাজীবন শুনে এসেছি। আমাকে সকলেই এই কথা বলেছেন। আমি যখন হাইস্কুল পাশ দিই লোকে বলেছে, যখন কলেজ পাশ দিই বলেছে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন বলেছে; যখন ক্যাডার সার্ভিসে যাই তখন বলেছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হয় তখনও বলেছে। এমনকি গতকাল অধ্যাপকপদ-প্রাপ্তির পরও হাজার হাজার লোক সেটা অভিনন্দনের মাধ্যমে বলছেন সাবাস, আরও বড়ো হও, এগিয়ে যাও!

বিজ্ঞাপন



মানুষের এই শুভবোধ ও শুভেচ্ছা আমাকে তাই নিজের মুখোমুখি করে তুলেছে গতকাল থেকে। যখন নিজের মুখোমুখি হয়েছি তখন প্রশ্ন করছি নিজেকে আমি কি বড়ো হয়েছি? তাহলে কতো বড়ো হয়েছি? আর বড়ো হওয়া কী? আর মানুষ যে আমাকে বড়ো হওয়ার আশীর্বাদ করেছে কেন করেছে? আমাকে যে বড়ো হতে বলেছে কেন বলেছে? আমাকে যে সারাজীবন অভিনন্দন জানিয়েছে কেন জানিয়েছে? আমি এইসব প্রশ্ন করেছি নিজেকে; এখন আমি নিজের মুখোমুখি হলাম।

৩.
শিক্ষা যে মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায়, এটা বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষটিও জানে। জানে বলে নিজেকে অভিশপ্ত বিবেচনা করে এবং তারমতো অভিশপ্ত কেউ হোক সেটা সে চায় না। চায় না বলে যখন কোনও শিশু স্কুলে যায় আলের পথ ধরে, তখন সে খুশি হয়, বলে বড়ো হও বাবা। গ্রামের নাম উঁচু করো, দেশের নাম উঁচু করো। দেশের জন্য কাজ করো, দশের জন্য করো।

এই হলো বড়ো হওয়ার মূল আকাক্সক্ষা। স্কুলগামী ভবিষ্যতের শিক্ষিত মানুষটি যেন বড়ো মাপের মানুষ হয়। আর সে যখন বড়োমাপের মানুষ হবে তখন যেন দেশের কাজ করে, দশের কাজ করে। কিংবা শিক্ষিত হয়ে দশ ও দেশের কাজ করতে করতে সে যেন বড়ো হয়।

কিন্তু বাস্তবতাটা কী? বাস্তবতাটা খুবই করুণ ও দুঃখজনক। এই যে সাধারণ মানুষ সারাটা জীবন আমার বা আমার মতো অন্যকে শুভকামনা করে গেল। শুধু কি তাই? প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ার খরচ দিল; ডাক্তার করে তুলল, ইঞ্জিনিয়ার করে তুলল, অফিসার করে তুলল, সাংবাদিক করে তুলল, অধ্যাপক সেই আমি আদপে কী হলাম? আমি আসলে তাদের বড়ো হওয়ার প্রত্যাশার বিপরীতে কী হয়েছি? তাদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন কতটা ঘটেছে আমার ‘বড়ো’ হয়ে ওঠার বিপরীতে? আমাদের বড়ো হওয়ার বিপরীতে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জাতীয় জীবনে দুর্ভাগ্যই ডেকে এনেছে বলেই মনে হয়। শুধু কি শিক্ষাব্যবস্থা? এরসঙ্গে গাঁটছড়া ভাব আছে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও। ফলে যে-মানুষগুলো রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেল, যাদেরকে বড়ো করে তোলার জন্য তিলে তিলে যতœ করা হলো, টাকা ব্যয় করা হলো; দেখা গেল এতসব পড়ে এরা ডাক্তার হলো ঠিকই, ইঞ্জিনিয়ার হলো, সচিব হলো, সাংবাদিক হলো, অধ্যাপক হলো কিংবা নেতা হলো কিন্তু বড়োমাপের মানুষ হতে পারল না বেশিরভাগই। কেন না ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অধ্যাপক-সাংবাদিক-সচিব হওয়া এক জিনিশ, আর বড়ো মাপের মানুষ হওয়া আরেক জিনিশ। যারা প্রকৃতই বড়ো হয়ে তারা অন্যের জন্য কাজ করেই বড়ো হয়; যারা নিজের জন্য করে, তারা ওইসব পেশাধারী হতে পারে কিন্তু বড়ো হয় না। তাই আমাদের দেশে এখন পদ আর পদাধিকার বেশি, কিন্তু বড়োমাপের মানুষ হাতেগোনা।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষগুলোই ঠিক আছেন; এই সেদিন বইদিবস গেল। সেখানে বিতর্ক উঠেছিল বই সত্যি কি মানুষকে মুক্তি দিতে পারে? একজন কবি বলেছেন, বইয়ের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোই শোষকে পরিণত হয়েছে। এই কথা মানি বা না-মানি, এটা তো ঠিক যে বাংলাদেশে নিরক্ষর তথা অশিক্ষিত মানুষের তুলনায় বই-পড়া শিক্ষিত মানুষগুলোই সবচেয়ে বেশি ভয়ংকার। এটা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। এই দেশটিকে যারা লুটপাট করছে এরা কারা? যারা বাজারে পণ্যসংকট তৈরি করছে, চালে সংকট তৈরি করছে, ভেজাল ওষুধ বানাচ্ছে, ঘুষ খাচ্ছে, দুর্নীতি করছে, ব্যাংকলুট করছে; স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তছনছ করছে, প্রশাসনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে, বৈচারিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে, শিক্ষাকে পণ্য করছে; এরা কারা। এরা সকলেই এই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ে-পড়া তথাকথিত মানুষগুলোই। এরাই রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে তসরুপ করছে। অথচ এটা যাতে না করা হয়, সেই উদ্দেশ্যে এই রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা খরচ করিয়ে এদের পড়ার খরচ জুগাতে হয়েছিল। কিন্তু ফল হয়ে উলটো।

আজকের বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতো নির্লজ্জ-বেহায়া আর কেউ নেই। পৃথিবীর কোথাও নেই। এরা গ্রাম থেকে উঠে আসে একটা ভাঙা সুকেস নিয়ে; পড়াশোনা করে চাকরি পেয়ে, ব্যবসা করে রাতারাতি টাকার কুমিরে পরিণত হয়। বাবা দেখা গেল এখনও খেতে কাজ করছে, ছেলে ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি করে এসি কক্ষে ঘুমায়। সৎভাবে চাকরি করে, ব্যবসা করে এরকম হওয়া সম্ভব এটা আপনি মানলেও আমি মানতে রাজি নই। সরকার যে বেতন দেয় তাতে কোনও রকমে জীবন চালানো যায়; এমনকি বড়ো চাকরি করা সত্ত্বেও। কিন্তু আমাদের সমাজ যেমন এই অসৎ-উপার্জনের উৎস খোঁজে না; অসৎবক্তিও এতে নীতি-নৈতিকতার পরোয়া করে না। একজন ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তার বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষত স্ত্রী কখনওই তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে না, তিনি মাসিক বেতন পান যেখানে পঞ্চাশ হাজার টাকা সেখানে মাসন চারলক্ষ টাকা খরচ করেন কীভাবে? এই আয়ের উৎসই-বা কী? এটা তার বাবা বা শ্বাশুড়ি যেমন প্রশ্ন করেন না, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেধাবী ছেলেটিও করে না। তাহলে কী শিক্ষা আমরা পেলাম? আর ওই যে মানুষগুলো আপনাকে আমাকে বড়ো হও আরো, মানুষ হও বলে আশীর্বাদ করেছিল, তা কি এই? ওরা চেয়েছিল আপনি একটা ঘুরখোর হোন, ডাকাত হোন, পুকুর-চোর হোন; চোরাকারবারি হোন? না এটা ওরা চায়নি।

৪.
সাধারণ মানুষ তাহলে কী চেয়েছিল আপনার কাছে? আপনার কাছে চেয়েছিল; আপনি এই গ্রাম থেকে যাচ্ছেন পড়াশোনা করতে; ভালো, পড়াশোনা করে আপনি বড়ো হোন। যেগ্রামে স্কুল নেই সেখানে স্কুল গড়ে তুলুন; যেখানে চিকিৎসাসেবা নাই সেখানে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেটা করুন; নিপীড়িত মানুষকে আর্তমানবতার সেবায় হাত বাড়ান। তারা চেয়েছিল আপনার গ্রামে রাস্তা নেই, একটা কাঁচা রাস্তা আনার ব্যবস্থা করুন; বিদ্যুৎ নেই, তা আনার ব্যবস্থা করুন। যেসব গরিবঘরের সন্তান পয়সার অভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না; তাদের কিছু একটা ব্যবস্থা করুন। অথবা, আপনি ভালো একজন শিক্ষক হয়ে মানুষগড়ার দায়িত্ব নিন, একজন পুলিশ হয়ে মানুষের নিরাপত্তা বিধান করুন; একজন জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন; একজন ডাক্তার হয়ে দুস্থদের সেবা দিন; একজন বিচারক হয়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করুন; একজন আইনজীবী হয়ে ন্যায় বিচারে সাহায্য করুন; একজন অধ্যাপক হয়ে সমাজের জন্য উন্নতমানের মানুষ গড়ে তুলুন এবং একজন রাজনীতিবিদ হয়ে রাষ্ট্রর জন্য সঠিক নীতি তৈরি করুন; দেশকে সুস্থির ও অগ্রসরমান করুন।

আপনার কী তাই মনে হয় না? তাহলে আবার ফিরে যান গ্রামে। খেতের আলে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করুন, তারা আাদপে কী চেয়েছিল? কিংবা আপনারা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছেন; বাড়িতে যখন যাবেন জিজ্ঞেস করবেন তারা আসলে আপনার কাছে কী চান? তারা আসলে নিজের জন্য কিছুই চাননি। চেয়েছেন দেশের জর‌্য, সমাজের জন্য এই উন্নত ও সুব্যবস্থা। আর আপনি কী হয়েছেন, দেখুন? কী হতে চান দেখুন।

বিজ্ঞাপন



এখন আপনার সমগ্র সত্তাজুড়ে চাই চাই চাই। পারলে সারাটা দেশই আপনার পেটের ভিতরে ভরে নিতে চান। আপনি টাকা চান, আপনি খ্যাতি চান, আপনি প্রাতপত্তি ও ক্ষমতা চান। অনেক অনেক ক্ষমতা চান, যে আপনার বাবাও যেন আপনাকে দেখে ভীত হয়? এমনি হোক আপনার ক্ষমতা। আপনি হয়তো তা হতে পেরেছেনও। অথবা হওয়ার অপেক্ষায়।

তাই এই হওয়াটা এত জরুরি হয়েছে যে কোনও বাবা-মাও আর সন্তানকে বড়োমাপের মানুষ করতে স্বপ্ন দেখে না। সন্তান তো নয়ই। এখন বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে সকলেই অফিসার হতে চায়। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হতে চায়; চাকর হতে চায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলেটি পড়তে এসেছে; কিংবা যে মেয়েটি কলেজে ভর্তি হয়েছে সে চায় বিসিএস কর্মকর্তা হতে। বিসিএস কর্মকর্তা হওয়া কী দেশে বড়ো হওয়ার সবচেয়ে উচ্চ ধাপ? তা কিন্তু নয়। কিন্তু সমাজরাষ্ট্রে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কারণ ওখানে রাষ্ট্রের সকল ‘মধু’ আছে। বড়ো হওয়া বলতে ওই সাধারণ মানুষগুলো তা বুঝেননি, আজও বুঝেন না। তারা মনে করেন অন্যেও জন্য কিছু করতে পারাই বড়ো হওয়া। আর আপনি একজন পদস্থ কর্মকর্তা হয়েও যেমন বড়ো হতে পারবেন না; অধ্যাপক হয়েও নিতান্ত তুচ্ছ থেকে যাবেন; তা তারা জানেন। এও জানেন যে, তুচ্ছ (!) স্কুল মাস্টার হয়েও আপনি সমাজের জন্য মহীরুহতুল্য হতে পারেন; একজন ফেরিওয়ালা হয়েও বড়োমাপের মানুষ হতে পারেন। এরা তা বুঝেন।

কিন্তু এই যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি; আমরা-আপনারা নিজেরা আবার বড়ো হওয়ার মাপকাঠি তৈরি করে ফেলেছি। বড়ো চাকরি, বাড়ি, গাড়ি, জায়গাজমি, পদ, ক্ষমতা এইসব হয়েছে বড়ো হওয়ার মাপকাঠি। কী তুচ্ছ আমাদের এই জীবনবোধ? শিক্ষিত হয়েও আমরা সেই মানুষগুলোরও সমকক্ষ হতে পেরেছি কি?

পদ, পদমর্যাদা; আমাদের দেশে পদমর্যাদার তাই এত গুরুত্ব, এত এত মূল্য। পৃথিবীর কোথাও এমন নেই; এমন হয় না। এমন হতে পারে না। এখানে যেমন পদটা বড়ো মানুষ-পরিচয়ের তুলনায়; ওখানে মানুষ পরিচয়ের মূল্যটাই বেশি, পদটা গৌণ। এই পদটাকে আমরাই এখানে শোষণের হাতিয়ার করে তুলতে মুখ্য করেছি, মর্যাদার উচ্চাসন হিসেবে নয়। ওটা আবার হয়ে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের ফলে। সেটার লিগেসিতেও।

৫.
‘অধ্যাপক’ পদটাও একটি বড়ো পদ। বিশেষ যোগ্যতায় কোনও সমাজ-রাষ্ট্রে এই পদে কাউকে বৃত করা হয়। এই পদ স্থানীয় কিংবা দেশীয় পদ নয়। এটি আন্তর্জাতিক অভিধাও। এই পদের গ্রহণযোগ্যতাও সর্বজনীন।

কী এমন মাহাত্ম্য এই পদের? অবশ্যই মাহাত্ম্য আছে। ইংরেজি ‘প্রফেসর’ শব্দটির বাংলা পরিভাষা অধ্যাপক। ইংরেজি বা বাংলা যে কেনোও ভাষার এই শব্দদুটোর ব্যুৎপত্তিগত অর্থটাও বিশেষ তাৎপর্যবহ। খুব সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে ‘অধ্যাপক’ শব্দের মূলে ‘অধি’ অব্যয় যুক্ত করা; যার অর্থ প্রধান্য/আধিপত্য বিস্তারকারী অর্থাৎ জ্ঞানতত্ত্বে মুখ্যব্যক্তি হবেন এই। কিন্তু বাংলা ভাষায় শব্দটি আরও বড়ো অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে ‘প্রফেসর’ শব্দের পরিভাষা বা প্রতিশব্দ হিসেবে। প্রফেসর শব্দের সঙ্গে জড়িত ‘প্রফেস/প্রফেসি’ মূল শব্দটা অর্থাৎ মোটের ওপর জ্ঞানভিত্তিক প্রবক্তক অর্থের সঙ্গে। প্রফেসর ও প্রফেটিক সমান উৎস থেকে আগতও। ‘প্রফেসি’ যিনি করেন তিনি প্রফেটিক গুণের অধিকারী হবেন। সুতরাং এই পদের বড়োত্ব বা মর্যাদা নিয়ে আর কিছু বলার থাকতে পারে না। আমার মনে হয়, মানুষের যতরকম গুণাবলি আছে সবচেয়ে বড়ো গুণ এই যে, প্রফেটিক-গুণ; দিব্যজ্ঞানী হওয়া। কারণ মনষ্যত্ববিকাশের সর্বশেষ ধাপও এটি। প্রফেটিকগুণের অধিকারীরা আলোকস্তম্ভবিশেষ। আলোকিত মানুষ। জ্ঞানতত্ত্বের মাধ্যমে এঁরা মানবজাতির সর্বোত্তম কল্যাণ সাধন করে থাকেন। এদের স্থান নাই, কাল নাই; এরা সর্বকালের, সর্বমানবের।

খুব ভেবেচিন্তে এই পদটির নাম দেওয়া হয়েছে নিশ্চয়। এই পদের মানুষ মানবজাতির ইতিহাসকে বদলে দিতে পারেন। দিয়েছেনও। গ্যালিলিও থেকে রবীন্দ্রনাথ এই ধাঁচের মানুষ। আইনস্টাইন থেকে বার্টান্ড রাসেল এই জাতের মানুষ। ইবনে সিনা থেকে অমর্ত্য সেন এই শ্রেণির মানুষ। জ্ঞানসৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণ এদের নেশা ও পেশা। সুতরাং মানবসভ্যতায় এই পদের একটা মূল্য ও মর্যাদা আছে। পদটা তাই সহজও নয়। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এ-পদে যেতে হয়।

কিন্তু বাংলাদেশে এই পদের অবস্থা কী? কী মর্যাদা রয়েছে সমাজ-রাষ্ট্রে? কারাই-বা ধারণ করে আছেন এই পদ-পদবি? প্রশ্নটা এখানে; শুরুতে আমি সংকোচ ও সংশয়ের কথা বলেছিলাম, সেই একই কারণে। বাংলাদেশের অনেক জিনিষের অবনমন ঘটেছে। একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন; হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। কিন্তু মানুষের কাছে তাঁর মর্যাদা কী ছিল? তিনি কি আদৌ মহামান্য থাকতে পেরেছিলেন। তিনি পদটাাকেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন। এভাবে বাংলাদেশে নানা পদ কলুষিত হয়েছে; সেই ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক পদের মর্যাদাও সমাজে সে-রকম নেই। নেই রাষ্ট্রেও। এই অবনমনের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে; সবচেয়ে বড়ো কারণ যে অধ্যাপকেরা তাও কি সত্য নয়?

আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি; কলেজে পড়েছি ও চাকরি করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে একযুগ ধরে পড়াই। ভিতরের সব খবর আমি জানি। কলেজের অধ্যাপকেরা কী করেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা কী না করেন। কিন্তু যাদেরকে আমি অধ্যাপক হিসেবে পেয়েছি; আর যাদেরকে দেখছি তাদের বেশিরভাগই যে কাগুজে তা আর কেউ না জানুক ভুক্তভোগীরা জানেন। সত্যিকার অধ্যাপকের প্রশ্ন সেখানে উঠছে না।
প্রথম কথা; অধ্যাপকরা শিক্ষক, গবেষক। অধ্যাপকেরা বুদ্ধিজীবী। এই তিনটি পরিচয়ের কয়টি আজ আমাদের অধ্যাপকেরা ধরে রাখতে পেরেছেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একটা সময় ছিল ‘অধ্যাপক’ শব্দটা শুনে গায়ের লোম শিহরিত হতো; শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে যেত। এখন কি তা হয়? সহজ উত্তর হয় না। কারণ এখন শিক্ষক-মনোনবৃত্তি না থাকা সত্ত্বেও  অধ্যাপক হওয়া যায়; মৌলিক গবেষণা না-থাকলেও এটা সম্ভব; এমনকী বুদ্ধিজীবীর ন্যুনতম দায় পালন না-করেও কেউ অধ্যাপক হয়ে বসে আছেন। তাই আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে অধ্যাপকের সেই প্রভাব যেমন নেই, সে মর্যাদাও নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, যারা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়ে তারা ভালো করেই এই পদ-পদবির ‘মাহাত্ম্য’ জানে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কান পাতলে অনেক জিনিশই শোনা যায়; শ্রেণিকক্ষে না-যাওয়ার মানসিকতা, ফলাফল মূল্যায়নে জুলুম, শিক্ষার্থীদের ওপর জবরদস্তি, শিক্ষক রাজনীতির নামে কুৎসিত দলবাজি, নোংরামো, গবেষণাপত্র জালিয়াতি করে ছাপিয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের গবেষণা করতে নিরুৎসাহিত করা, শিক্ষার্থীদের দয়া দেখানো, রূঢ় আচরণ করা, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি কওে সবধরনের সুবিধা আদায় করা ইত্যাদি। এর কোনওটাই প্রফেটিক গুণের মধ্যে যেমন পড়ে না, জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রাগ্রসরতার মধ্যেও না। কিন্তু এটাই হচ্ছে। অধ্যাপকদের জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত জায়গা না-হয়ে শিক্ষার্থীর জন্য কারাগার হয়ে যাচ্ছে। যেন এখান থেকে বের হতে পারলেই মুক্তি। অথচ পৃথিবীর সর্বত্র এ জায়গাটাই সকলে ছাড়তে চায় না। কারণ জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান-উদ্ভাবন মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ইউরোপ-আমেরিকায় পড়াশোনা করে এসেও আমাদের অধ্যাপকেরা এই শিক্ষাটা কেন যে নেন না এটাই বিস্ময়ের।

‘বড়ো হও’ বলে যাকে গ্রামের কৃষক বা শহরের ঠেলাগাড়ির শ্রমিক আপনাদের আশীর্বাদ করেছিল; তারা কি জানত বড়ো হয়ে আপনি ব্যাংক লুট করবেন? সাংবাদিক হয়ে একটা বেইমান হবেন? অধ্যাপক হয়ে আপনি প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করবেন? নিজের আরাম আয়েশের জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়ে আর আসবেন না? তাই, আমাদের অনেক অধ্যাপকও আসেন না। কারণ তিনি বড়ো হয়েছেন।

কিন্তু সাধারণ মানুষ এতশত জানে না। তারা এখনও আশাবাদী। তারা মনে করে আপনি অধ্যাপক হয়েছেন; মানে আপনি প্রফেটিক গুণেই হয়েছেন; আপনি জ্ঞানী-গুণী-সুবিবেচক। আপনি দেশের ভবিষ্যৎ। আপনি দেশের জন্য ভাববেন, দেশকে গড়ে তুলবেন, বিপদে বুদ্ধি দিয়ে রক্ষা করবেন। আপনি আপনার মস্তকও আপনার স্বার্থে বন্ধক দিয়ে দিতে পারেন; এ তারা কল্পনাও করতে পােেরন না। তারা মনে করেন, আপনি জ্ঞানতাপস, আপনি পণ্ডিত, আপনি বিদ্বান। আপনার সংস্পর্শে তার অপোগ- সন্তানটিও সোনায় পরিণত হবে, মানুষের মতো মানুষে পরিণত হবে।

মানুষ যেমন বিচারালয়ের বিচারকের ওপর আস্থা রাখে; বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ওপরও সমান আস্থা আছে বলে আমি মনে করি।

বিজ্ঞাপন



৬.
অধ্যাপক হওয়ার সংবাদে অন্যঅনেকের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক খ্যাতনামা অধ্যাপকেরা আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এদের অনেকেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অধ্যাপক পদের শেষ কাণ্ডারিও। এইসব অধ্যাপকের জন্য এখনও অধ্যাপক পদটির সুনাম ও মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু তাঁরা যখন কথা বলেছেন, সামাজিক মাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছেন; মেসেঞ্জারে টেক্সট পাঠিয়েছেন আমি আরও সংকোচ বোধ করেছি। আমি তো তাঁদের মতো হতে পারিনি, কিন্তু আমিও এই পদে আসীন হয়েছি। সুতরাং আমি বড়ো মর্মপীড়ায় ছিলাম ও আছি।

অন্তত চারজনের কথা এখানে না-বললেই নয়। কিংবদন্তীতুল্য শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন, অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অমলেন্দু চক্রবর্তী। সৈয়দ আকরম হোসেন লিখেছন, ‘যথাযথ মর্যাদার স্বীকৃতি-প্রপ্তির জন্য প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সতত কল্যাণ হোক।’ মহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘জফির, নিজের কাজটা করে যাও। এটা তো একটা পদ, তাই না?’ মহাম্মদ দানীউল হক লিখেছেন, ‘এটা যদিও একটা পদপ্রাপ্তি কিন্তু এখন শুরু হলো তোমার নিজেকে মেলে ধরে ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার যাত্রা। আমাদের আশিস রইলো।’ অমলেন্দু চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘অধ্যাপক মহোদয়কে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। আপনার উত্তরোত্তর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করছি।’

এই যে আমাকে আশীর্বাদ কিংবা অভিনন্দন, এই যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা এটা সেই ‘অনেক বড়ো হও’-এর মতো আশীর্বাদ; যেটা আমাকে করেছিলেন তিনগাঁয়ের কৃষকেরা; আমি যখন তিনযুগ আগে খেতের আল মাড়িয়ে স্কুলে ভর্তি হতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু আমি, আজ যখন এই পরিচয়ে পরিচিত হলাম; অধ্যাপক পদে বৃত করল আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়; আর সেসংবাদে হাজার হাজার মানুষ আমাকে অভিনন্দন ও আশীর্বাদ করল; তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই কি আমাকে নিজের আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে না? হতে হবে না, নিজের মুখোমুখি?

আমি নিজের মুখোমুখি হলাম; এবং প্রতিটি শুভেচ্ছাবার্তা আমাকে নিজের প্রতি; এই পদের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে বলে আমার মনে হলো। এই দেশটা নানাভাবে বামুন হয়ে গেছে; বামুন হয়েছে এই অধ্যাপক পদটাও। যে-কয়জন বিশিষ্ট অধ্যাপক আছেন; যারা এখনও ঋষিতুল্য এঁদের মৃত্যুর পরে এই পদের কী হবে সেটা ভেবে আমি কূল পাই না। তখন নিজেকে খুব অস্থির লাগে। আমার অন্তর বলে, এই পদের যথার্থ অধিকারী আমি নই। যদিও সৈয়দ আকরম হোেেসন বলেছেন; সেটা ¯েœহের বশেই বলে থাকবেন; যেমন আমি তাঁর পশমের তুল্যও নই। আর মহাম্মদ দানীউল হক যখন বললেন, এটা একটা যাত্রা তখন নিজের ভিতরটা শূন্য বলেই মনে হলো; মহাম্মদ জাফর ইকবালের মতো স্যার যথার্থই বলেছেন, এটা একটা পদ-প্রাপ্তি।

আমি গ্রামের আলবেয়ে একদিন যাত্রা করেছিলাম; এক ভাদ্রমাসের দুপুরে। আজ আবারও একই যাত্রা শুরু হয়েছে হাজার হাজার শুভানুধ্যায়ীদের অভিনন্দনে। কিন্তু যাত্রা শেষে আমি কি মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব? পারব এই ‘অধ্যাপক’ পদটাকে যথার্থ সম্মানিত করতে? সেই শক্তি ও সামর্থ কি আমার আছে?

মানুষের অভিনন্দন-বার্তা সকল সংকোচ-সংশয় কাটিয়ে আমাকে একটি শক্তি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমি যদি আমার কাজটুকু করি; তবেই তাঁদের প্রতি ফিরতি অভিনন্দন জানাতে পারি। কারণ পদ নয়, দায়িত্ববোধ ও কাজই মানুষকে বড়ো করে তুলতে পারে। মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে। সে- দায়িত্ব ও কাজ যদি হয় পৃথিবীর ক্রমমুক্তির।

২৯ এপ্রিল, ২০২১

জফির সেতু: কবি, আখ্যানকার ও গবেষক; অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত