দিলীপ রায়

০১ মে, ২০২১ ০০:৩৮

উন্নয়ন ও সাফল্য: স্বপ্নের পদ্মাসেতু

১৯৭১ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সড়ক যোগাযোগের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটা দেশের উন্নয়ন ও মানুষের সুবিধার জন্য নিরাপদ ও দ্রুতগতিসম্পন্ন অবকাঠামোর দরকার। অধিকন্তু আমাদের দেশ নদীমাতৃক। এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অসংখ্য নদ-নদী। তাই যোগাযোগ বৃদ্ধি করার একমাত্র উপায় ছিল নদীগুলোকে সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত করা। যে কোন সড়ক তৈরি করতে গেলেই ছোট বড় নদী অতিক্রম করতে হয় এবং তার সাথে রয়েছে অনেকগুলো ফেরি।

যোগাযোগ হচ্ছে উন্নয়নের পূর্বশর্ত। তাই সারা দেশব্যাপী বর্তমানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় রাস্তাঘাটের ব্যাপক সংস্কার করা হচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উন্নত রাষ্ট্র। এই স্বপ্নকে সামনে রেখে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। তার মধ্যে পদ্মাসেতু নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। পদ্মাসেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সেতু।

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো পদ্মাসেতু নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ করেও ঘুষ দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তোলে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মাসেতু নির্মাণে ১২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ঋণ আকস্মিকভাবে বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। এই ব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর আরও ৩টি আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন এজেন্সি, ইসলামিক ডেভোলাপম্যান্ট ব্যাংকও সরে যায়। দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও কিন্তু কম হয়নি। যারা চায়নি আমাদের পদ্মাসেতু হোক, তারা এমন সব বিবেকহীন কথাবার্তা জনসমাবেশে কিংবা বলা যায় দেশের মানুষের মনের মধ্যে ছড়িয়েছে, যার জন্য সাধারণ মানুষকে চরম এক আতঙ্ক নিয়ে বাড়ি থেকে জরুরি কাজকর্মের জন্য বের হতে হয়েছে। বিরুদ্ধবাদীরা মানুষের মাঝে এরকম জঘন্য গুজব ছড়িয়েছে যে, পদ্মাসেতু নির্মাণের জন্য কচি শিশুদের মাথা প্রয়োজন। তাই পথে-ঘাটে, বাজারে-বন্দরে, স্কুলে-পার্কে ছেলে ধরা বের হয়েছে ছোট ছোট বাচ্চাদের তুলে নেওয়ার জন্য।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সকল ষড়যন্ত্রকে বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে বিরুদ্ধবাদীদের দুর্ভেদ্য জাল ছিন্ন করে ফেলেন। তিনি জনগণকে সাথে নিয়ে দেশের নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্পন্ন করার ঘোষণা দেন। তারই প্রেক্ষিতে একনেক সেতুর জন্য ১০১৬১ কোটি টাকার পদ্মা বহুমুখী প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মাসেতুর প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে ১ম স্পেন বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মাসেতু। সমালোচনাকারীদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে মাওয়া প্রান্তের ১২ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে বাস্তবে রূপ পায় কংক্রিট ও স্টিলের তৈরি পদ্মাসেতুর পুরো অবকাঠামো। একই সঙ্গে দৃশ্যমান হয় ৬১৫০ মিটার। সেতুর উপরে অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মাওয়া-জাজিরা প্রান্তের সংযোগের মাধ্যমে লাখো মানুষের চোখে স্বপ্ন চিকচিক করে ওঠে। পদ্মাসেতু আজ পুরোটাই দৃশ্যমান। এটি এশিয়ার ২য় বৃহত্তম সেতু। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে গৃহীত এই প্রকল্পের বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৯৬ ভাগ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে বিশ্বের সামনে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিলো বর্তমান সরকার। এ সেতুর সুফল ভোগ করবেন সমগ্র দেশবাসী।

পদ্মাসেতু তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক শ্রমিকের ঘাম ও রক্ত এবং দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের ভালোবাসা ও আবেগ। এই সেতু চালুর পর মুন্সীগঞ্জের লৌহজঙ্গের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। এছাড়া সংযোগ সড়কের মধ্যে থাকবে ৯৭০ মিটারের ৫টি সেতু ও ২০টি বক্স কালভার্ট, ৮টি আন্ডার পাস ও ২টি টোল প্লাজা। পদ্মাসেতুতে থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা। বিশ্বের গভীরতম পাইপের পদ্মাসেতু বহুমুখী একটি প্রকল্প। সেতু প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে পদ্মার দু'পাড়ে ৭টি পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপিত হবে। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলিতে জনসাধারণের জন্য মসজিদ, খেলার মাঠ, মার্কেটসহ সব ধরনের ব্যবস্থা থাকবে। সেতুটি নির্মাণে পূর্ণতা লাভ করলে ঢাকা সহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সড়ক ও রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা হবে। এই সেতু দেশের অর্থনীতির অগ্রগতিতে বিরাট অবদান রাখবে। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ সমস্ত নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে। এই পদ্মাসেতুর মাধ্যমে মংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থল বন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এই সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করবে। কৃষকরাও সরাসরি উপকৃত হবেন। তাঁদের উৎপাদিত সব ধরনের পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকা সহ সমগ্র দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে অবশ্যই অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। এছাড়াও কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, শিল্প সহ সবক্ষেত্রে পদ্মাসেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেখা দিবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। সেখানে গড়ে উঠবে পর্যটন কেন্দ্র ও বিভিন্ন মোটেল-হোটেল-রেস্টুরেন্ট।

পায়রা বন্দরের সঙ্গে বুলেট চালু হলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন। ইতিমধ্যেই অনেক দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর ও এর আশপাশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছেন। এখন আর পদ্মাপারের মানুষকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগী নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ফেরি পারাপারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। অকালে প্রাণ যাবে না কোনো মায়ের কিংবা তার সন্তানের। এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যোগাযোগ, বাণিজ্য ও পর্যটন সহ অন্যান্য খাতে অর্থনীতির ভালো অবস্থার সৃষ্টি করবে। এ পদ্মাসেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্যও গতিশীল হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সময় ও অর্থ সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি আমদানি-জ্বালানি ব্যয় হ্রাস পাবে। ঢাকা বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ২১টি জেলার মানুষের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে স্বার্থ রক্ষা করবে পদ্মাসেতু। অনেকের ধারণা রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাড়তি চাপ হ্রাসে পদ্মাসেতুর ভূমিকা বিদ্যমান থাকবে। সড়ক ও রেলপথে দ্রুত ঢাকা থেকে আসা যাওয়ার সুবিধা তৈরি হলে অনেকে হয়তো ধূলিযুক্ত ঢাকার ব্যস্ত পরিবেশে না থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে আগ্রহী হবেন।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য বিরল গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পৃথিবী যখন করোনার কালো থাবায় থমকে যাওয়ার উপক্রম তখনও কিন্তু সেতু নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বপ্নের পদ্মাসেতু হচ্ছে।

পরিশেষে বলা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত দূরদর্শী ও সাহসী সিদ্ধান্তে বাংলার বুকে সৃষ্টি হতে চলছে এক নতুন ইতিহাস- যে আমরাও পারি।

দিলীপ রায়: প্রভাষক, গণিত বিভাগ, মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত