তুহিন বড়ুয়া তমাল

২২ জুলাই, ২০২১ ১৯:১৮

খেলার মাঠ চাই!

ক্লিশে জীবন, অফিস পলিটিক্স, ব্যস্ততা ইত্যাদি মানুষকে বিষিয়ে তুলে। সপ্তাহে একটা দিন মাঠে যদি দৌড়ঝাঁপ দেয়া যায় কর্মব্যস্ত ছটা দিন দমবন্ধ লাগে না তেমন। একারণেই বোধহয় শুক্রবার কিংবা একটা বন্ধের দিনের জন্যে আমরা অপেক্ষায় থাকি। আমরা বলতে সেই ইশকুলের আঙ্গিনা মাড়ানো বন্ধুরা।

২.
সারা শহর খুঁজে এমন কোনও মাঠ পাওয়া যায় না যেখানে একটু লম্বা সময় ধরে খেলা সম্ভব। খেলার উপযোগী গুটিকয়েক মাঠ যেগুলো আছে সেখানে খেলার জন্যে লাইন পরে থাকে। একটা বা সর্বোচ্চ দুটি ম্যাচ খেলেই মাঠ ছেড়ে দিতে হয়, না হলে অপেক্ষমাণ খেলোয়াড়েরা বসে থাকবে।

বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সিলেটে আবির্ভূত হয়েছে ইনডোর প্লে গ্রাউন্ড৷ ফুটবল আর সীমিত পরিসরে ক্রিকেট খেলা যায়।

এসব প্লে গ্রাউন্ড হলো চৌবাচ্চার মতো। কষ্টেসৃষ্টে সাঁতরাতে পারা যাবে কিন্তু মন ভরবে না। এখানে রোদ পড়ে না। বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা ঢোকে না। প্লে গ্রাউন্ডে ঘড়ির কাঁটা মেনে চলা লাগে। টাকা গুণতে হয় ঘণ্টায় ঘণ্টায়। টাকার পরিমাণ মোটেও কম নয়।

ঘনবসতির এই দেশে শহরতলীগুলোর পরিচিত সিনারিও হয়ে উঠছে এমন টা।

৩.
আজ শহরে কড়া রোদ পড়েছে। পিচঢালা রাস্তা চকচক করছে৷ রিকশাওয়ালার বুক উঠানামা করছে হাপরের মতো। দরদর করে ঘাম ঝরেই যাচ্ছে সিক্ত চামড়া বেয়ে। আকাশে যে বিশাল বিশাল আকারের মেঘ জমেছে তাদের দিকে একটানা চেয়ে থাকা যায়না। সূর্যের আক্রোশ, চোখ ঘোলা করে দেয়।

এমন রোদজ্বলা দিনে যারা কখনো মাঠে দৌড়েছেন, খেলেছেন তাদেরও একই রকম শারীরিক প্রতিক্রিয়া হতো না? মনে পরে?

ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতো। ধুলোর মাঝে অবিন্যস্ত চুল উড়তো। চামড়া পুড়ে তামাটে হয়ে যেতো। হৃৎপিণ্ড ধরাম ধরাম করে বিট করতো- সারা শরীরের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়তো তাজা অক্সিজেন ভরা উজ্জ্বল রক্ত।

একটা বার মনে করার চেষ্টা করুন তো ঐসব দুর্বার দিনে আপনি কখনো অবসাদগ্রস্ত হয়েছিলেন কিনা? কখনো বিশ্রাম রত অবস্থায় শারীরিক দুর্বলতার শিকার হয়েছিলেন কিনা?

হননি, আপনি কখনো হননি। মাঠের কায়িক শ্রম আপনার শারীরিক যে ক্ষয় করতো সেটুকু আপনার শরীর দ্বিগুণ উদ্যমে পূরণ করে দিতো। অবসাদ কোত্থেকে ভর করবে?

৪.
আমার শৈশবের প্লে গ্রাউন্ডে কদাচিৎ যাওয়া হয়। জেনারেশন গ্যাপের দায়। পরিচিত মুখ পাওয়া ভার। সাবেল, শাওনের বাসা মাঠের পাশেই হওয়ায় এরা এখনো মাঠে ব্যাট বল নিয়ে ঠোকাঠুকি করে। আমি ঈর্ষান্বিত হই। যার কাছে মাঠ আছে, সবুজ ঘাস আছে তাকে হিংসে না করে পারা যায় কি করে?

৫.
আশংকাজনক ভাবে কমে যাচ্ছে খেলার মাঠ। শৈশব এখন যাদের কিংবা শৈশব যাদের কদিন পরেই তাদের ভবিষ্যৎ কি আমি ভাবি দিনমান। রোদে পুড়ে যে কখনো খেলেনি, মেঘে সিক্ত হয়ে যে কখনো কাদাতে গড়াগড়ি খায়নি তার আবার জীবন কি? তার আবার শৈশব!

আমরা খেলতে খেলতে প্রচণ্ড তেষ্টায় পড়তাম। মাঠের কোনের অজুখানা, জুমেলের বাসার পানি গিলতাম ঢকঢক করে। সে পানির স্বাদ ছিলো অমৃতসম। আকণ্ঠ সুধাপান।

মাঝেমাঝে খেলার পরে আকাশ যখন নিভুনিভু হয়ে আসতো, গোল হয়ে বসে আনমনা হয়ে যেতাম সবাই। কেউ ঘাসের ডগা চিবাতো। কেউ পিঁপড়ের সারি ভাঙতো। শীতের দিনগুলোতে জবুথবু আমরা মুখের ধোঁয়ায় ইন্দ্রজাল বুনতাম। আমরা কল্পনায় হারিয়ে যেতাম।

এ প্রজন্ম, যাদের জন্যে আমরা খেলার মাঠ রেখে যেতে পারছি না, তাদেরকে বন্দি করে দিচ্ছি চারকোনা ডিসপ্লের জগতে। এদের কাছে বাস্তবের সবুজ নেই। নেই ধুলার মাঝে লুটোপুটি খাবার অভিজ্ঞতা।

৬.
ছোট ছোট মানুষগুলো, যাদের আমরা বাচ্চাকাচ্চা বলি- তাদের ধার্মিক বানান, চাকুরে বানান কিংবা ব্যবসায়ী যা ইচ্ছে তা বানান কিন্তু বিনাশর্তে সবচেয়ে আগে নিশ্চিত করুন একটা উচ্ছল শৈশব।

আপনার পাড়ায় যদি একটা উন্মুক্ত মাঠ থাকে, মাঠের চারপাশে গাছ থাকে ওখানে পাখি উড়বে। ফড়িং উড়বে। ওদের সাথে ছোটাছুটি করবে আমাদেরই বাচ্চাকাচ্চারা। ঘরের মাঝে কম্পিউটারে, খাবার টেবিলে মোবাইল স্ক্রিনে যে শৈশব রচিত হয় পূর্ণবয়সে তা প্রস্ফুটিত হতে পারবেনা। মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হবেই।

মাঠের ধারে পরে থাকা একটা ঠ্যাং ভাঙ্গা কুকুর দেখে যারা ব্যথিত হবে না, রোঁয়া উঠা বিড়াল দেখে শুশ্রূষা করার ইচ্ছে জাগবে না যাদের তাদের মধ্যে মানুষকে সাহায্য করার বাসনা কিভাবে জাগ্রত হবে? এই বাসনা জাগাতে মাঠ চাই। বন্ধুদের সাথে ছোটাছুটি চাই।

উঁচু উঁচু বিল্ডিং অনেক হবে, কিন্তু একটা মাঠ হারিয়ে গেলে হারাবে শত শত শৈশব। বাঁধাগ্রস্ত হবে ভালো মানুষ হবার প্রক্রিয়া।

খেলার মাঠ বাড়ান।
শৈশব রাঙান।
এটাই হোক স্লোগান।

তুহিন বড়ুয়া তমাল: চিকিৎসক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত