তুহিন বড়ুয়া তমাল

১৩ অক্টোবর, ২০২১ ০১:২০

যে শারদীয়া সার্বজনীন

সংখ্যায় তেমন বেশি নেই সিলেটে। বৌদ্ধদের বিরাট একটা অংশ বসবাস করে চট্টগ্রামে। নিজ ধর্মীয় উৎসব বলতে যে আবহ আছে সেটা খুব একটা পাওয়া হয়নি তাই। বৌদ্ধদের কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে যেগুলোতে গ্রামের পর গ্রামে উৎসব লেগে যায়। ঠিক যেনো ঈদ কিংবা পূজো। সিলেটে বৌদ্ধরা যথাসম্ভব চেষ্টা করে নিজ ধর্মীয় দিবসগুলো ঘটা করে পালন করতে- তবুও চট্টগ্রামের মতো জাঁকজমক হয় না।

একারণে আমার তেমন আক্ষেপ নাই। কিছুকিছু ক্ষেত্রে আমার বরং উৎসব করার সুযোগ আরো বেশিই হয়েছে। ঈদ আসলে আমারও ঈদ লাগে, দুর্গোৎসবে আমার মাঝেও উৎসব জাগে। কোরবানীর গরু কিংবা অঞ্জলীর প্রসাদ সবার স্বাদই জিহ্বাতে প্রতিবছর লেগে যায়। আসসালামুয়ালাইকুম কিংবা নমস্কার বললে আমিও বলি ওয়ালাইকুম আসসালাম / নমস্কার। আল্লাহ্‌ হাফেয কিংবা হরে কৃষ্ণ বললে আমিও বলি আল্লাহ্‌ হাফেয/ হরে কৃষ্ণ।

পুরাটা বছর ঘুরতে বারোটা মাস লাগে। সব মাসে দিন চলে যায় কিন্তু শরৎ আসলে আমার দিন যেনো রাঙতা কাগজের ঝালর হয়ে উঠে! নোবেল বুড়োর সাদা মেঘের ভেলার মাস হলো এই শরৎ। হালের বাংলা  নাটকের উত্তরার কাশ বনের মাস হলো শরৎ।

চৌকা চৌকা বিল্ডিংগুলোর ফাঁক ফোকরে ঘুড়ি উড়ে। শহর ছেড়ে একটু বেরোলেই দেখা যায় ধানের মাঠ হলদে হবার ভাব ধরেছে। সামনে হেমন্ত। এরপরে হাঁড় কাঁপানো শীত। তার আগে শুভ্র শরৎ আর রঙিন শারদ।

আসলে ছোটবেলায় মানুষের উপর যে ছাপ পরে তা সারা জীবনই প্রভাবিত করে যায়। স্বপ্নীল, মিটু, তাপস, সুদীপ্ত, তপন, জিষ্ণু, স্বরুপ, মনো, মিহির, জনি, পরি, বিকুদের সাথে প্রতি দুর্গা পূজায় কতো স্মৃতি! ভোরে দুর্গাবাড়ি, সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ মিশন রাতে অন্যান্য মন্ডপে ঘোরাঘুরি। দশমীতে বিসর্জন - সবাই মনমরা আমিও মনমরা। দুর্গাতো আমার দেবী নয়, দুর্গার বিসর্জনে তবু আমারও মন খারাপ কেনো? পূজোর তিন চারটা দিন ইশকুলের বন্ধুদের হইহুল্লোরই হয়তো দায়ী।

আগে কোন মাজারের সামনে দিয়ে যেতে সালাম দিতাম। দুর্গা মূর্তির সামনে সষ্ঠাঙ্গ প্রণাম দিতাম। পরে জেনেছি আমার ধর্ম মতে এগুলো মিথ্যা দৃষ্টি। এতে আমার উৎসব পালনে তেমন হেরফের হয়নি। আমি প্রণাম দিচ্ছি না এখন, মাজারের সামনে সালামও ঠুকছি না, কিন্তু উৎসবের আনন্দ ঠিকই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি। ভোরে ঠিকই দুর্গাবাড়ি ছুটতে মন চাইবে এবারো।

হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব পালনের রীতিনীতি আমাকে মুগ্ধ করে। বিশেষ করে দুর্গা পূজো। লাল পেড়ে শাড়ি, ধূতি, আলতা। ধূপ ধুনো ঢাঁকের শব্দ। সকাল সকাল স্নান করে  আরতি পাঠ। সব মুগ্ধ হয়ে দেখি। ভোরে যখন পাখীরা ডাকতে শুরু করে, দেবী আরাধনার অপার্থিব সুর কেমন জানি নতুন প্রাণের সঞ্চার করে মনে হয়। সব অলৌকিক লাগে আমার। মুগ্ধ হয়ে প্রতিমা দেখি। দেখি শিল্পীর গড়া নিপুন কারুকাজ। কত যত্নে আর সৃষ্টিশীলতায় বানানো। কেউ ভাবে মূর্তি পূজো। আমারও মাঝেমাঝে তাই মনে হয়। পরক্ষণেই মনে হয় তাতে কি? প্রতিটা প্রতিমাই যেনো একেকটা সৌন্দর্যের আঁধার। শিল্পীর সৌন্দর্য সৃষ্টির সাক্ষর। আমার মনে অদ্ভুত ভালো লাগার জন্ম দিচ্ছে- আমি মোহিত হচ্ছি! এতেই আমার আনন্দ!

অপার বাংলার লেখনিতে শরৎ, দুর্গা দেবীর আরাধনার অনেক লিখিত চিত্র পাঠ করেছি কৈশোরে। শরতের কাশ আর মেঘের দল লেপ্টে গেছে সারা মন জুড়ে তখন হতেই। কাঁচা মাটির মতো কিশোর মন তাই সযতনে ছেপে রেখেছে মনের খোলা বইতে। পৃষ্টা উল্টোলেই সুখ লাগে। মন্ডপে গিয়ে যখন দেখি বইয়ের পাতা উঠে এসেছে বাস্তবের জমিনে অবাক হই! তাইতো দুর্গা পূজোয় আমার এতো উচ্ছ্বাস! হয়তো তো তাই 'শারদ' কিংবা 'শারদীয়া' শব্দগুলি মনে নাড়া দেয় ভীষণ ভাবে!

পেশাগত ব্যস্ততা খুব বেশি বেড়ে গেছে আমাদের সবার। জানিনা এবার শারদ আবহ আগের মতো আচ্ছন্ন করতে পারবে কিনা। মনে প্রাণে চাইবো সারা বাংলাদেশের কোথাও যেনো কোন প্রতিমা ভাঙ্গার খবর শুনতে না পাই।

ঠাকুরের দুলাইন গুনগুন করি-

' আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা,
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা'


তুহিন বড়ুয়া তমাল: চিকিৎসক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত