আল-আমিন রহমান

০৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৪:৫৩

বাকশাল কর্মসূচি: মিথ্যাচারের জবাব

বাকশাল নিয়ে বাংলাদেশ বিরোধীদের একটা বিভ্রান্তিমূলক প্রোপাগান্ডা রয়েছে। তারা বলতে চায় বাকশাল স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু আসলেই কি বিষয়টা এমন? বাকশাল আসলে কী? ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বাকশাল নিয়ে আলাপ করতে সংকোচবোধ করে, কিন্তু কেন? এর কারণ একটাই বাকশাল সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা কম, আমাদের অজ্ঞতা।

বাকশাল কোনো স্বৈরতান্ত্রিক বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না। বাকশাল ছিল মূলত অর্থনৈতিক কর্মসূচি, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কার। ১৯৭৪-এর ষড়যন্ত্রমূলক কৃত্রিম খাদ্যসঙ্কটে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি হিসেবে জাতীয় সরকার গঠনের পদক্ষেপ নেন। এই জাতীয় সরকারে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে। সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান পরবর্তীতে সামরিক স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানও বাকশালে স্বেচ্ছায় যোগদান করে। এমনকি বাকশাল ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করে কলামও লেখেন। দৈনিক সংবাদে ৮ মার্চে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়- 'বাকশাল আয়োজিত সভায় উপস্থিত শ্রোতাদের সম্মুখ সারিতে বসে রয়েছেন জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া। '

বাকশাল কেবল অর্থনৈতিক কর্মসূচি ছিল তা না। এটা ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারও। বঙ্গবন্ধু এক আদেশবলে সব মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে ৬১ জেলায় গভর্নর নিয়োগ দেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন ছিলেন এমপি, ১৩ জন সরকারি আমলা, ৭ জন আইনজীবী, ৫ জন সাবেক এমসিএ, ২ জন পার্বত্য জনজাতি প্রধান ও একজন সামরিক কর্মকর্তা। এই গভর্নরদের শক্তিশালী করতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে তাদের নির্বাচিত করার বিধানও রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল তৃণমূলে স্থানীয় প্রশাসনকে শক্তিশালী করা। একইসাথে সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক একাধিপত্য খর্ব করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

বাকশাল, যার পরিপূর্ণ রূপটি হচ্ছে 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ'। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়; ফলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। সংবিধানের নতুন এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করার সাংবিধানিক বিধান কার্যকর করা হয়। সংবিধানের এই ধারা মোতাবেক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) একত্রিত হয়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ছিল সরকারের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তখন আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবি ব্যতীত অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠনে নিয়মতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি চর্চা করেনি। স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেকেই আত্মগোপন করলেও তাদের একটি অংশ ধ্বংসাত্মক বিপ্লববাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যায়। এছাড়া বেশ কিছু উগ্রবাদী রাজনৈতিক দল সরকার উৎখাতে গোপনে থানা-পুলিশ ফাঁড়ি লুট করা, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা করাসহ চরমপন্থায় দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্র আমাদের মতো এতো পশ্চাৎপদ ও অল্প শিক্ষার হারের এক নতুন রাষ্ট্রে কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। তাই সময়ের প্রয়োজনেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপটি ১৯৭২ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেই নেওয়া দরকার ছিল। ভারত বা পাকিস্তানের মতো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র লড়াই করতে হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কেবল মনোবল আর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে লড়ে গেছি আমরা। প্রাণ দিয়েছেন ৩০ লাখ বাঙালি, ২ লাখ মা-বোন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রক্তাক্ত এ লড়াই আমাদের জন্যে যেমন ছিল বন্ধুর তেমনি শ্বাপদসংকুল। পাকিস্তানি হানাদারদের পাশাপাশি সক্রিয় ছিল এ দেশীয় হায়েনারা। রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস নামে এই হায়েনার দল নিজেদের সংগঠিত করে পাকিস্তানি সৈন্যদের পথঘাট চিনিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারীদের নির্মমভাবে হত্যা ও নারকীয় নির্যাতন করেছিল এই নরপিশাচরা। বাংলার সবুজ জমিন রক্তে লাল হয়েছিল যার প্রতীক হয়ে জ্বলজ্বল করে উজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের জাতীয় পতাকা।

বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাঁর চিন্তাধারা সম্পর্কে বিশদ আলোকপাত করেন-

"আমার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ধ্যান ও ধারণার উৎস বা মূলনীতিমালা হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতিমালার সমন্বিত কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শোষণহীন সমাজ তথা আমার দেশের দীনদুঃখী, শোষিত, বঞ্চিত, শ্রমজীবী, মেহনতি মানবগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের সমষ্টিগত প্রকৃত 'গণতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক' শাসন প্রতিষ্ঠাকরণই আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারার একমাত্র লক্ষ্য।

আমার দেশের মাত্র ৫ শতাংশ লোক ৯৫ শতাংশ লোককে দাবিয়ে রাখছে, শাসন–শোষণ করছে। বাকশাল করে আমি ওই ৯৫ ভাগ মানুষের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যবস্থা করেছি। এতকাল মাত্র ৫ ভাগ শাসন করেছে, এখন থেকে করবে ৯৫ ভাগ। ৯৫ ভাগ মানুষের সুখ–দুঃখের সাথে ৫ ভাগকে মিশতে হবে। আমি মেশাবোই। এজন্য বাকশাল করেছি। এই ৯৫ ভাগ মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছি তাদের পেশার নামে, তাদের বৃহত্তর কল্যাণে, তাদের একক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালে। মূলত বাকশাল হচ্ছে বাঙালির সর্বশ্রেণি সর্বস্তরের গণমানুষের একক জাতীয় প্লাটফর্ম, রাজনৈতিক সংস্থা, একদল নয়। এখানে স্বৈরশাসনেরও কোনও সুযোগ নেই। কারণ বাঙালি জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত বা সমষ্টিগত শাসন ব্যবস্থায় কে কার উপর স্বৈরশাসন চালাবে? প্রত্যেক পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে শাসন পরিষদ গঠন করা হবে। কোনও পেশা বা শ্রেণি অন্য পেশার লোকদের ওপর খবরদারি করতে পারবে না। যে কেউ যিনি জনগণের সার্বিক কল্যাণের রাজনীতিতে তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তিনি এই জাতীয় দলে ভিড়তে পারবেন।

যারা বাকশালকে একদলীয় ব্যবস্থা বলেন, তাদের স্মরণ করতে বলি, ইসলামে ক'টি দল ছিল? ইসলামী ব্যবস্থায় একটি মাত্র দলের অস্তিত্ব ছিল, আর তা হলো খেলাফত তথা খেলাফতে রাশেদীন। মার্কসবাদও একটি মাত্র দলের অনুমোদন দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম কিংবা অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে কতটি করে দল আছে? এইসব ইসলামী রাষ্ট্রসমূহকে বাদ দাও, ওখানে মহানবীর ইসলাম নেই। বস্তুত প্রকৃত গণতন্ত্র বা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই একটি একক জাতীয় রাজনৈতিক সংস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। একটি জাতীয় কল্যাণের অভিন্ন আদর্শে, ব্যাপক মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে একটিমাত্র রাজনৈতিক সংস্থার পতাকাতলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বহুদলীয় তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় কোনওভাবেই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। সেখানে বহুদলে জনগণ বহুধা বিভক্ত হতে বাধ্য। আর বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত, পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্বসংঘাত, হিংসা–বিদ্বেষ ও হানাহানির রাজনীতি দিয়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কোনোভাবেই অর্জিত হতে পারে না। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলে।"

বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন-
এক. রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক পেশাভিত্তিক লোকদের জাতীয় দল বাকশালে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা রেখেছি। এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় দলের একাধিক প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। জনগণ তাদের মধ্যে থেকে একজনকে নির্বাচিত করবেন। প্রেসিডেন্ট জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় দলের সদস্য যে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদের আস্থাভাজন একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন। সংসদ সদস্যদের দুই–তৃতীয়াংশের অনাস্থায় প্রেসিডেন্টকে অপসারিত করতে পারবেন। মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন। স্থানীয় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বস্তরের জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যক্ষভাবে বজায় থাকবে।

দুই. আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম–সমবায় প্রকল্প। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থব্যবস্থায় উন্নয়ন বা স্বনির্ভর–স্বাধীন গ্রামীণ ব্যবস্থা, বিশেষ করে ভূমিসংস্কারের প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের পুনর্বাসন তথা কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সাম্যভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। ভারি শিল্পকারখানা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংক, বীমা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি জাতীয়করণ করে জনগণের যৌথ শেয়ার মূলধনে নতুন নতুন কৃষিজাত শিল্প ও অন্যান্য শিল্প কলকারখানা ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা। সীমিত ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাসমূহ যাতে জনসাধারণ ও তাদের শ্রমিকদের শোষণ করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকবে।

তিন. প্রশাসনিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, কর্পোরেশন ও বিভাগগুলোর পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন তথা মাথাভারী প্রশাসনের উচ্ছেদ সাধন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জেলা গভর্নর ও থানা প্রশাসনিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ, মহকুমা ও বিভাগীয় প্রশাসনকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। জেলা ও থানাগুলো জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ সদস্যদের ভোটে থানা পরিষদ গঠিত হবে। তবে থানা পরিষদের প্রশাসক/চেয়ারম্যান ও জেলা গভর্নর জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। থানা প্রশাসক/চেয়ারম্যানরা ও জেলা গভর্নররা জনগণ, স্ব স্ব পরিষদ ও প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। গ্রাম সমবায় পরিষদ থানা পরিষদের কাছে, থানা পরিষদ জেলা পরিষদের কাছে দায়ী থাকবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ– এরপরই থাকবে জাতীয় সরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে জাতীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিপুলভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করে প্রশাসনকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র, স্টিলফ্রেম গতানুগতিক ধারার চরিত্রকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেবার ব্যবস্থা গ্রহণ।

বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে রাজধানীতে বহাল রেখে হাইকোর্ট বিভাগকে আটটি আঞ্চলিক বিভাগে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা। তবে সুপ্রিমকোর্টের অধিবেশন বছরে অন্তত একবার করে প্রতিটি আঞ্চলিক বিভাগে (হাইকোর্ট) বসবে। জেলা আদালতসমূহ বহাল থাকবে। প্রতিটি থানাতে থাকবে একাধিক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। প্রত্যেকটি আদালতে যেকোনো মামলা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মীমাংসা করা হবে। গ্রামে থাকবে একাধিক সালিশ বোর্ড। সালিশ বোর্ড গঠিত হবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। সালিশ বোর্ড চেয়ারম্যান থাকবেন সরকার নিয়োজিত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে সুষ্ঠু, ন্যায় ও দ্রুততর গণমুখী বিচারকার্য সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।

অনেকে বাকশালকে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতীয়মান করতে গিয়ে ৪টি পত্রিকা রেখে অন্যান্য সংবাদপত্র নিষিদ্ধের কথা বলে থাকেন। কিন্তু সংবাদপত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা ছিল একেবারেই অন্যরকম-

এক. দেশে নির্দিষ্ট সংখ্যক জাতীয় দৈনিক থাকবে বাংলা ও ইংরেজিতে। এখানে কর্মরত ব্যক্তিরা, যাদের লেখনির মাধ্যমে জাতি পাবে সঠিক পথনির্দেশক। দেশের সব পেশা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে থাকবে তাদের অবারিত প্রবেশাধিকার।

দুই. প্রতিটি পেশার জন্য থাকবে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় দৈনিক। যেমন শ্রমিকদের জন্য শ্রমবার্তা, কৃষকদের জন্য কৃষিবার্তা, মহিলাদের জন্য মহিলাবার্তা, যুবকদের জন্য যুববার্তা, ছাত্রদের জন্য ছাত্রবার্তা, শিশুদের জন্য শিশুবার্তা প্রভৃতি। এ সব পত্রিকায় সংক্ষেপে জাতীয় বিশ্ব সংবাদ ছাপার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পেশার সব প্রকার সমস্যা ও সম্ভাবনার আলোচনা থাকবে এসব পত্রিকায়।

তিন. গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে সংঘটিত সংবাদ শহর বন্দর পেরিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসতে আসতে পচন ধরে যায়, খবরের পাপড়ি ঝরে যায়, কলি যায় শুকিয়ে। তারপর পত্রিকা অফিসে যখন পৌঁছে তখন এডিটর সাহেব পাঠিয়ে দেন সংবাদ ডেস্কে। পান চিবাতে চিবাতে মফস্বল অডিটর সাহেব সেই শুকনো কলি ফেলে দেন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। আর যদি কখনো ছাপা হয় বড় জোর দুই তিন লাইন। গত আগস্টে শৈলকূপায় স্বামীর প্রহারে স্ত্রীর মৃত্যু অথবা ভাণ্ডারিয়ায় স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গৃহবধূর আত্মহত্যা। কিন্তু আর কোনো সংবাদ নেই।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন দেশের ৬২টি জেলার সবকটিতে দৈনিক পত্রিকা থাকবে। বরিশাল বার্তা, চট্টগ্রাম বার্তা, রাজশাহী বার্তা, বগুড়া বার্তা, দিনাজপুর বার্তা প্রভৃতি।

চার. প্রতিটি জেলার নিজস্ব দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও থাকবে জাতীয় আদলে প্রত্যেক শ্রেণি ও পেশার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকবে আকর্ষণীয় বেতন ভাতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।

পাঁচ. সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কোন কোন বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকা জাতীয় দৈনিক হিসেবে থাকবে। একই সঙ্গে সংবাদ সংস্থা সম্পর্কেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

ছয়. নির্বাচিত পত্রিকা এবং সংবাদ সংস্থা ছাড়া অন্য সব পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থা আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে সেখানে কর্মরত সব সাংবাদিক ও অন্য কর্মচারী নিয়মিত বেতন পাবেন। এ জন্য সাংবাদিক কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে মাসের প্রথম দিন বেতন ভাতা নিয়ে আসবেন।

সাত. চাকরিহীন সাংবাদিকদের নাম তালিকাভুক্ত এবং তাদের বেতন ভাতা নির্ধারণ করার জন্য সাংবাদিক প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করা হবে।

সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনা কত প্রগতিশীল ছিল। এত দরদ নিয়ে কেউ কখনও তাদের কথা ভেবেছে? বঙ্গবন্ধু সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নিয়ে ভাবতেন। একজন রাষ্ট্রনায়কের চিন্তা-ভাবনা যেরকম হওয়া দরকার ছিল ঠিক তেমনভাবেই তিনি ভাবতেন।

বাকশাল কর্মসূচি নিয়ে ছাত্রলীগের নিয়মিত পাঠচক্র করা উচিত। বিরোধীদের ছড়িয়ে দেওয়া ভুল ও বিভ্রান্তিকর ধারণা সমূলে উৎপাটন করতে হলে আমাদের বাকশাল সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে জয় বাংলার অফিস স্থাপন করে বঙ্গবন্ধু পাঠচক্রের আয়োজন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে প্রকাশিত বই-পুস্তক সেই পাঠচক্রের পাঠ্য হবে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও আদর্শ প্রতিটি ছাত্রলীগ কর্মীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

আল-আমিন রহমান: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ; সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত