মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

১২ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩ ১২:০৮

‘এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’, মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর বিজয় দিবসের লেখা

মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদ চুপ্পু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। আজ রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর তিনিই হতে যাচ্ছেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মেয়াদ আগামী ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত থাকায় ২৪ এপ্রিল থেকে তিনি দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও দুদকের সাবেক কমিশনার।

গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে ‘এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি লেখা লেখেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সিলেটটুডের পাঠকদের জন্যে তাঁর লেখাটি প্রকাশ করা হলো:

১৬ ডিসেম্বর, বিজয়ের ৫১ বছর। একটা জাতির জন্য এ সময় খুব বেশি না হলেও কমও নয়। বছর যত এগোচ্ছে, প্রাপ্তির তালিকাও সমৃদ্ধ ও গৌরবোজ্জ্বল হচ্ছে তত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ পেয়েছি, আর তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের মহাসড়কে। বিজয়ের দীর্ঘ এই সময়ে সত্যিকার অর্থে আমরা কতটুকু এগিয়েছি? ব্যর্থতাই বা কী? পাঁচ দশকের বাংলাদশের পাওয়া-না পাওয়ার এই হিসাব কষব, তার আগে ১৬ ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপট নিয়ে দুই-চারটে কথা বলা প্রয়োজন। কারণ, একটা বিজয় দিবস অর্জনে পুরো দেশকে লড়াইয়ের জন্য তৈরি করা সহজ কথা নয়। বাংলাদেশ তৈরির লড়াইকে গোটা বিশ্বের কাছে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন হিসেবে না দেখিয়ে একটা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে দেখানো- এটাও সামান্য কাজ ছিল না। একমাত্র বঙ্গবন্ধুই সেটা পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় মূলধন ছিল বাগ্মিতা। ৭ মার্চে ঢাকার সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তার ‘ভায়েরা আমার’ সম্বোধন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’; ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’; ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে’ এবং ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’- এমন অসংখ্য বাক্যে লুকিয়ে আছে আমাদের ১৬ ডিসেম্বরের পেছনের গল্প।

বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করতে কিভাবে ভাবতেন তা বোঝার জন্য শামসুজ্জামান খানের একটি লেখা উদ্ধৃত করছি। ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ এবং প্রাসঙ্গিক কথকতা’য় তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর কারাগারে বন্দি। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘সেদিন আপনি কেন ওদের হাতে ধরা দিলেন?’ মুজিবের উত্তর- প্রথমত, তিনি ধরা না দিলে তার খোঁজে আরও অনেক লোককে খুন করা হতো। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের ক্রীড়নক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চলত। তৃতীয়ত, ‘একটা কথা বলি, তোমরা কেমনভাবে নেবে জানি না, তবে আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস, আমি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি থাকায় আমার দুঃখী বাঙালিদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ যেমন বেড়েছে, তেমনি মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে আমার একটা বিশাল প্রতীক মনে মনে তৈরি করে নিয়েছে। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের খুব বড় একটা শক্তি। আমি প্রবাসী সরকারে থাকলে শুধু প্রমাণ সাইজের মুজিবই থাকতাম। ওদের হাতে বন্দি থাকায় আমি বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতার ভূমিকায় স্থান পাই। মানুষ আমার নাম নিয়ে হেলায় হেসে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ওরা আমাকে যদি মেরে ফেলত, আমি আরও বড় প্রতীকে পরিণত হতাম। বাংলার মানুষ আরও লড়াকু হয়ে যুদ্ধ করত!’ কোটি বাঙালিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে এভাবেই নিজের জীবনের বিনিময়ে ভেবেছেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর ২৩ বছর বৈষম্যে জর্জরিত হয় পূর্ব পাকিস্তান নামের ভূখণ্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৩ বছর কঠিন ত্যাগ স্বীকার করে প্রাণপণ সাহসী সংগ্রামের ফসল ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর সেদিনের যুবনেতা শেখ মুজিব বুঝে যান পাকিস্তানের অধীনে থাকলে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি মিলবে না। এ জন্য ১৯৬৬ সালেই তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করেন। ১৯৭১ সালে ৯ মাস জনযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত রাষ্ট্র।

মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। এই ৫১ বছরে সেই দারিদ্র্য নেমে এসেছে ২০ শতাংশের নিচে। এটা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল। ১৯৭১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সামষ্টিক ও ব্যাষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথম (১৯৭২-৭৩) অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান (২০২২-২৩) অর্থ বছরে বাজেট ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি। ১৯৭০-এ সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার। বর্তমানে ১৭ কোটিরও বেশি মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৮০০ ডলারের বেশি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই একটা কথা বলে থাকেন- ‘কী পেলাম, কী পেলাম না, সে হিসাব মিলাতে আমি আসিনি। কে আমাকে রিকোগনাইজ করল, আর কে করল না, সে হিসাব আমার নেই। একটাই হিসাব, এই বাংলাদেশের মানুষ ও তাদের পরিবর্তনে কিছু করতে পারলাম কি না, সেটাই আমার কাছে বড়।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা সত্যিকার অর্থেই জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। চোখ বন্ধ করে নিজেকে এই প্রশ্ন করলেও যা উত্তর মিলবে, তা হলো- বিগত এই ৫১ বছরে বাংলাদেশ তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ি আজ আধুনিক কৃষি, তৈরি পোশাক, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনীতি, রেমিটেন্স, গড় আয়ু, আমদানি, রফতানি, রিজার্ভ, মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, নারী শিক্ষা, কলকারখানায় উৎপাদনসহ অনেক সূচকে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে অনেক ক্ষেত্রে পাশের দেশ ভারত-পাকিস্তানকেও ছাড়িয়ে গেছে।

শেখ হাসিনা জানেন, কিভাবে বাংলাদেশের ভাগ্য বদলাতে হয়। তাই তো সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের যতগুলো ধাপ রয়েছে, বাংলাদেশ একের পর এক অতিক্রম করে চলছে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে মেগা প্রকল্প। স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে আজ লাখো মানুষ চলাচল করছে প্রতিনিয়ত। নগরজুড়ে অনুরণিত হচ্ছে মেট্রোরেলের প্রতিধ্বনি। অন্তরীক্ষে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। জল-স্থল আর অন্তরীক্ষের পর পাতালে হচ্ছে বিশাল উন্নয়ন যজ্ঞ। আশা জাগাচ্ছে পাতাল রেল। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া, অর্থনীতিতে দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচ দেশের তালিকায় জায়গা করে নেওয়া, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, পদ্মা সেতু নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল ও ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন- সবই শেখ হাসিনার জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে ক্যারিশমেটিক ও দূরদর্শী সফল নেতৃত্বের ফল। শুধু তাই নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রফতানিমুখী শিল্পায়ন, তথ্য প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রফতানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে দেশ যেভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে; তাতে সহজেই অনুমেয়- আগামীর বাংলাদেশ ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশের সারিতে কাঁধ মেলাতে সক্ষম হবে।

শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশে তো বটেই, গোটা বিশ্বের রোল মডেল। তিনি শুধু রাজনীতিতেই স্থিতিশীলতা আনেননি, নারীর অধিকার, সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রক্ষায় গোটা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছেন, হচ্ছেন। সৎ-সততা ও বিশ্বের ক্ষমতাধর নারী-সমাজের মাঝেও আজ তার অবস্থান। যে আশা ও ভরসা দিয়ে চার দশকের বেশি সময় আগে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন, তা আজ শতভাগ বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন। তিনি এখন জনগণের কাছে নন্দিত-সমাদৃত।

১৯৭১ এ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান যে জাতির পরিচয় দিয়েছিলেন, ভিত্তি রচনা করেছিলেন, আজ স্বাধীনতার ৫১ বছর পর এক সুবর্ণ লগ্নে সেই জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছেন তারই উত্তরসূরি শেখ হাসিনা। পিতার অসমাপ্ত কাব্যকে তিনি পরম মমতায় নিজ হাতে সমাপ্ত করে যাচ্ছেন। তার ভাষায়, শুনি আমরা, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আরও আগেই একটি উন্নত দেশে পরিণত হতো।’ হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি আজ বিশ্বের দরবারে নিজের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে সদর্পে। এই তলাবিহীন ঝুড়ি যেন আলাদিনের আশ্চর্যের প্রদীপ যেথায় যোগ্য হাতের স্পর্শে চারদিক আজ উন্নয়ন উৎকর্ষের আলোয় উদ্ভাসিত।

পরিশেষে একটাই কথা, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা হলো বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এই অর্জনকে অর্থবহ করতে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সবাইকে জানতে ও জানাতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমরা পৌঁছে দেব- বিজয়ের এ মাহেন্দ্রক্ষণে- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত