মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১৬ মার্চ, ২০২৪ ১৩:০২

সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্যে ও শিক্ষা

হিজরিবর্ষের নবম মাসটির নাম রমজানুল মুবারক। এ মাসের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বলার অপেক্ষা রাখে না। এ মাস আল্লাহ তাআলার অধিক থেকে অধিকতর নৈকট্য লাভের উত্তম সময়, পরকালীন পাথেয় অর্জনের উৎকৃষ্ট মৌসুম। ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আযকার এবং তাযকিয়া ও আত্মশুদ্ধির ভরা বসন্ত। মুমিন বান্দার জন্য রমজান মাস আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিয়ামত। তিনি এই মাসের প্রতিটি দিবস-রজনীতে দান করেছেন মুষলধারা বৃষ্টির মত অশেষ খায়ের-বরকত এবং অফুরন্ত কল্যাণ। মুমিনের কর্তব্য, এই মহা নিআমতের জন্য কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত হওয়া এবং এর কদর করা।

এ মাসে বান্দা পার্থিব সকল চাহিদা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দয়া ও রহমত লাভ করবে, অতীতের সকল পাপাচার থেকে ক্ষমা চেয়ে নতুনভাবে ঈমানি জিন্দেগির উত্তাপ গ্রহণ করবে, তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে পুরো বছরের ইবাদত ও ইতাআতের শক্তি সঞ্চয় করবে, চিন্তা-চেতনা ও কর্ম-সাধনায় আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সমর্পিত করবে—এই হচ্ছে মুমিনের আনন্দ।

তবুও কুরআন মাজিদের বিভিন্ন আয়াতে এবং হাদিস শরীফের বিস্তৃত বর্ণনায় রমজান মাসের যে গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে, তার কিছু দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করব। এরপর পেশ করব এ মাসের প্রধান আমল সিয়াম বা রোজা সম্পর্কে কুরআন মাজিদ ও হাদিস শরীফের কিছু নির্দেশনা।

সিয়াম ও কিয়ামের মাস: মুসলিম উম্মাহর নিকট রমজান মাসের আগমন ঘটে প্রধানত রোজা ও তারাবীহ’র বার্তা নিয়ে। এটি রমজান মাসের বিশেষ আমল। তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য, পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে এ দুই বিষয়ে যত্নবান হওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন— يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.

হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি; যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী (মুত্তাকী) হতে পার। —সূরা বাকারা (২) ১৮৩

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন— لَمَّا حَضَرَ رَمَضَانُ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلمَ: قَدْ جَاءَكُمْ رَمَضَانُ، شَهْرٌ مُبَارَكٌ، افْتَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَتُغَلُّ فِيهِ الشَّيَاطِينُ، فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا، فَقَدْ حُرِمَ.

যখন রমজান মাসের আগমন ঘটল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমজান এসেছে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য এ মাসের রোজা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শিকলে বন্দী করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বি ত হল, সে তো প্রকৃতপক্ষেই বি ত। —মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৭১৪৮; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২৪১৬; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস ৮৩৮৩; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস ৮৯৫৯

কুরআন নাযিলের মাস: রমজানুল মুবারকের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল তা কুরআন নাযিলের মাস। এই পবিত্র মাসেই আল্লাহ তাআলা পূর্ণ কুরআন মাজিদ লওহে মাহফুয থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ করেন। অতঃপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কুরআনের সর্বপ্রথম ওহীও এ মাসেই নাযিল হয়। ইরশাদ হয়েছে— شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

রমজান মাস, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়তে এবং সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর হক্ব-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন অবশ্যই এর রোজা রাখে। —সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

মুসলমানদের জন্য সর্বোত্তম মাস: হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন— مَا أَتَى عَلَى الْمُسْلِمِينَ شَهْرٌ خَيْرٌ لَهُمْ مِنْ رَمَضَانَ، وَلَا أَتَى عَلَى الْمُنَافِقِينَ شَهْرٌ شَرٌّ لَهُمْ مِنْ رَمَضَانَ، وَذَلِكَ لِمَا يُعِدُّ الْمُؤْمِنُونَ فِيهِ مِنَ الْقُوَّةِ لِلْعِبَادَةِ، وَمَا يُعِد فِيهِ الْمُنَافِقُونَ مِنْ غَفَلَاتِ النَّاسِ وَعَوْرَاتِهِمْ، هُوَ غنْم الْمُؤْمِن يَغْتَنِمُهُ الْفَاجِرُ.

আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রমযানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনগণ এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গণিমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ। —মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৮৩৬৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস ৮৯৬৮; সহিহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস ১৮৮৪; তবারানী হাদিস ৯০০৪; বাইহাকী শুআবুল ঈমান, হাদিস ৩৩৩৫

রহমতের মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়: হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন— إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ، فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنّةِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النّارِ، وَصُفِّدَتِ الشيَاطِينُ.
যখন রমজান মাসের আগমন ঘটে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। —সহিহ বুখারী, হাদিস ১৮৯৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১০৭৯; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৮৬৮৪; সুনানে দারেমী, হাদিস ১৭৭৫

إِذَا كَانَ أَوّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشّيَاطِينُ، وَمَرَدَةُ الجِنِّ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ، فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ، وَفُتِّحَتْ أَبْوَابُ الجَنةِ، فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ، وَيُنَادِي مُنَادٍ: يَا بَاغِيَ الخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ، وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنَ النّارِ، وَذَلكَ كُلّ لَيْلَةٍ.

যখন রমজান মাসের প্রথম রাতের আগমন ঘটে, তখন দুষ্ট জিন ও শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে—হে কল্যাণের প্রত্যাশী! অগ্রসর হও, হে অকল্যাণের প্রার্থী! থেমে যাও। আর আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন। —জামে তিরমিযি, হাদিস ৬৮২; বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান, হাদিস ৩৬০১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৬৪২; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস ১৫৭২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস ৮৯৬০

জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস এবং দুআ কবুলের মাস: আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য, বেশি বেশি নেক আমল এবং তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেদেরকে এই শাহী ফরমানের অন্তর্ভুক্ত করা।

হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— إِن لِلّهِ عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ، وَذَلِكَ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ. وقال البوصيري : رجال إسناده ثقات

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে প্রতি ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। প্রতি রাতেই তা হয়ে থাকে। —সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৬৪৩, মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২২২০২, আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদিস ৮০৮৮; সুনানে বায়হাকী, হাদিস ৩৬০৫

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন— إِنّ لِلّهِ عُتَقَاءَ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ،(يعني في رمضان). لِكُلِّ عَبْدٍ مِنْهُمْ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রত্যেক দিবস ও রাত্রিতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দুআ কবুল করেন। —মুসনাদে আহমাদ হাদিস ৭৪৫০, মুসনাদে বাযযার, হাদিস ৯৬২

দানশীলতার মাস:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, كَانَ رَسُولُ اللّهِ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلمَ أَجْوَدَ النّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدَ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِّنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ القُرْآنَ، فَلَرَسُولُ اللَّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَجْوَدُ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ المُرْسَلَةِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। তাঁর দানশীলতা (অন্য সময় হতে) অধিকতর বৃদ্ধি পেত রমজান মাসে, যখন জিব্রীল আ. তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। জিব্রীল আ. রমযানের প্রতি রাতে আগমন করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন শোনাতেন। তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল। —সহিহ বুখারী, হাদিস ৬, সহিহ মুসলিম হাদিস ২৩০৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ২৬১৬

আমলের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধির মাস:
রমজান মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এ মাস মুমিনের নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধির মাস এবং আখেরাতের সওদা করার শ্রেষ্ঠ সময়। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে— قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لِامْرَأَةٍ مِنَ الْأَنْصَارِ...إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فَاعْتَمِرِي، فَإِن عُمْرَةً فِيهِ تَعْدِلُ حَجَّةً.
وفي رواية أخرى لمسلم : فعمرة في رمضان تقضي حجة أو حجة معي.
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আনসারী মহিলাকে বললেন, বর্ণনাকারী বলেন, তার নাম ইবনে আব্বাস রা. উল্লেখ করেছিলেন কিন্তু আমি তা ভুলে গিয়েছি—(অন্য বর্ণনায় তার নাম উম্মে সিনান উল্লেখ করা হয়েছে) তুমি কেন আমাদের সাথে হজ্ব করতে যাওনি? তিনি বললেন, আমাদের পানি বহনকারী দুটি মাত্র উট রয়েছে। একটিতে আমার ছেলের বাবা (স্বামী) ও তাঁর ছেলে হজ্ব করতে গিয়েছেন, অন্যটি পানি বহনের জন্য আমাদের কাছে রেখে গিয়েছেন। তিনি বলেন, রমজান মাস এলে তুমি উমরা করবে। কেননা এ মাসের উমরা একটি হজ্বের সমতুল্য। সহিহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রমজান মাসের উমরা একটি হজ্বের সমতুল্য। অথবা বলেছেন, আমার সাথে একটি হজ্বের সমতুল্য (সওয়াবের হিসাবে)। —সহিহ বুখারী, হাদিস ১৭৮২, সহিহ মুসলিম ১২৫৬, মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২০২৫

পাপ মোচন ও গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের মাস:
হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন— الصلَوَاتُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُن إِذَا اجْتَنبَ الْكَبَائِر.

পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআ এবং এক রমজান থেকে আরেক রমজান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহকে মুছে দেয় যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। —সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৩৩ (৩)

মা লাভের এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যে ব্যক্তি নিজের পাপসমূহ ক্ষমা করাতে পারে না সে সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত। হাদিস শরীফে তার জন্য বদ দুআ করা হয়েছে।

হযরত কা’ব ইবনে উজরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেন, তোমরা মিম্বরের নিকট সমবেত হও। আমরা সকলেই সেখানে উপস্থিত হলাম। যখন তিনি মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন, তখন বললেন, আমীন, যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেন, আমীন, যখন তিনি তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেন, আমীন।

হযরত কা’ব ইবনে উজরা রা. বলেন, যখন তিনি (মিম্বর থেকে) অবতরণ করলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ আমরা (মিম্বরে উঠার সময়) আপনাকে এমন কিছু কথা বলতে শুনেছি, যা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। উত্তরে তিনি বললেন, জিব্রীল আ. আমার নিকট আগমন করেছিলেন, যখন আমি প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন তিনি বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে রমজান মাস পেল, তবুও তার গুনাহ মাফ হল না। আমি বললাম, আমীন। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম তখন বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যার নিকট আপনার নাম উচ্চারিত হল অথচ সে আপনার প্রতি দরূদ পড়ল না। আমি বললাম আমীন। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে বৃদ্ধ পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তারা উভয়ে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না। অর্থাৎ তাদের খেদমতের মাধ্যমে নিজেকে জান্নাতবাসী করতে পারল না। আমি বললাম, আমীন। —মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস ৭৩৩৮; মাযমাউয যাওয়াইদ, হাদিস ১৭৩১৭

লাইলাতুল কদরের মাস:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে মুসলিম উম্মাহর জন্য আরেকটি বিশেষ দান হল এক হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন— لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

‘লাইলাতুল কদর এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিব্রীল আ.) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক কল্যাণময় বস্তু নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। যে রাত পুরোটাই শান্তি, যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ —সূরা কদর (৯৭) : ৩-৫
এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়।

হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন— دَخَلَ رَمَضَانُ، فَقَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِن هَذَا الشهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلَّه، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلَّا مَحْرُومٌ.
قال المنذري : إسناده حسن، إن شاء الله، وكذا قاله البوصيري.

রমজান মাসের আগমন ঘটলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদের নিকট এই মাস সমাগত হয়েছে, তাতে এমন একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বি ত হল, সে প্রকৃতপক্ষে সকল কল্যাণ থেকেই বি ত। একমাত্র (সর্বহারা) দুর্ভাগাই এ রাতের কল্যাণ থেকে বি ত হয়। —সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৬৪৪

রোজার গুরুত্ব ও ফযিলত:
এ পর্যায়ে আমরা রমজান মাসের প্রধান আমল রোজা সম্পর্কে আয়াত ও হাদিসের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা পেশ করার চেষ্টা করছি।

রমজানের রোজা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। ঈমান, নামায ও যাকাতের পরই রোজার স্থান। রোজার আরবি শব্দ সওম, যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। পরিভাষায় সওম বলা হয়-প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ মুসলমান নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজাভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। সুতরাং রমজান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকীম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর উপর পূর্ণ রমজান রোজা রাখা ফরয। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন— يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার। —সূরা বাকারা (২) : ১৮৩

কোনো শরয়ী ওযর ছাড়া কোন মুসলমান যদি রমজান মাসের একটি রোজাও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করে তাহলে সে বড় পাপী ও জঘন্য অপরাধীরূপে গণ্য হবে। দ্বীনের মৌলিক বিধান লঙ্ঘনকারী ও ঈমান-ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারী হিসেবে পরিগণিত হবে। হাদিস শরীফে ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ত্যাগকারী ও ভঙ্গকারীর জন্য কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আবু উমামা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমার নিকট দুই ব্যক্তি আগমন করল। তারা আমার বাহুদ্বয় ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে এল। তারপর আমাকে বলল, আপনি পাহাড়ের উপর উঠুন। আমি বললাম, আমি তো উঠতে পারব না। তারা বলল, আমরা আপনাকে সহজ করে দিব। আমি উপরে উঠলাম। যখন পাহাড়ের সমতলে পৌঁছালাম, হঠাৎ ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, এ সব কিসের আওয়াজ? তারা বলল, এটা জাহান্নামীদের আর্তনাদ। তারপর তারা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। হঠাৎ কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদেরকে তাদের পায়ের মাংসপেশি দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এবং তাদের মুখের দুই প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে এবং তা থেকে রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা বলল, যারা ইফতারের সময় হওয়ার আগেই রোজা ভেঙ্গে ফেলে।—সহিহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস ১৯৮৬; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৭৪৪৮; সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদিস ৩২৮৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস ১৬০৯; তবারানী, হাদিস ৭৬৬৬

রমজান মাসের একদিন রোজা না রাখলে মানুষ শুধু গুনাহগারই হয় না, ঐ রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখলেও রমযানের এক রোজার যে মর্যাদা ও কল্যাণ, যে অনন্ত রহমত ও খায়ের-বরকত তা কখনো লাভ করতে পারবে না এবং কোনোভাবেই এর যথার্থ ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না।

হাদিস শরীফে বর্ণিত রোজার কিছু ফযিলত ও বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ করা হলো :
রোজার প্রতিদান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই দিবেন এবং বে-হিসাব দিবেন: প্রত্যেক নেক আমলের নির্ধারিত সওয়াব ও প্রতিদান রয়েছে, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমলকারীকে পুরস্কৃত করবেন। কিন্তু রোজার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- كُل عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ، الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ، قَالَ اللهُ عَز وَجَل: إِلَّا الصَّوْمَ، فَإِنَّه لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي.

মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকীর সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, কিন্তু রোজা আলাদা। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে। —সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৫১ (১৬৪); মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৯৭১৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস ৮৯৮৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৬৩৮

আল্লাহ তাআলা রোজাদারকে কেয়ামতের দিন পানি পান করাবেন: হযরত আবু মুসা রা. হতে বর্ণিত- إِنَّ الله تَبَارَكَ وَتَعَالَى قَضَى عَلَى نَفْسِهِ أَنَّهُ مَنْ أَعْطَشَ نَفْسَهُ لَهُ فِي يَوْمٍ صَائِفٍ سَقَاهُ اللَّهُ يَوْمَ الْعَطَشِ.

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের উপর অবধারিত করে নিয়েছেন, যে ব্যক্তি তার সন্তুষ্টির জন্য গ্রীষ্মকালে (রোজার কারণে) পিপাসার্ত থেকেছে, তিনি তাকে তৃষ্ণার দিন (কিয়ামতের দিন) পানি পান করাবেন। —মুসনাদে বাযযার, হাদিস ১০৩৯; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদিস ৫০৯৫

রোজা হল জান্নাত লাভের পথ: عَنْ أَبِي أُمَامَةَ قَالَ : أَتَيْتُ رَسُولَ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ : مُرْنِي بِعَمَلٍ يُدْخِلُنِي الْجَنّةَ. قَالَ: عَلَيْكَ بِالصّوْمِ؛ فَإِنّهُ لَا عِدْلَ لَهُ . ثُمّ أَتَيْتُهُ الثّانِيَةَ فَقَالَ لِيْ: عَلَيْكَ بِالصيَامِ.

হযরত আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আগমন করে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন, যার দ্বারা আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। তিনি বলেন, তুমি রোজা রাখ, কেননা এর সমতুল্য কিছু নেই। আমি পুনরায় তার নিকট এসে একই কথা বললাম। তিনি বললেন, তুমি রোজা রাখ। —মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ২২১৪৯; সহিহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস ১৮৯৩; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৩৪২৬; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২৫৩০

রোজাদারগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে ‘রাইয়ান’ নামক বিশেষ দরজা দিয়ে: হযরত সাহল ইবনে সা’দ রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- إِنّ فِي الجَنّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرّيّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، يُقَالُ : أَيْنَ الصّائِمُونَ؟ فَيَقُومُونَ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ.

জান্নাতে একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে- কোথায় সেই সৌভাগ্যবান রোজাদারগণ? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর রোজাদারগণ যখন প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে কেউ ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। —সহিহ বুখারী, হাদিস ১৮৯৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৫২; মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২২৮১৮

রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল ও দুর্গ:
হযরত জাবির রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘আমাদের মহান রব ইরশাদ করেছেন- রোজা হল ঢাল। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্য আর আমিই এর পুরস্কার দিব।’ —মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১৪৬৬৯; শুয়াবুল ঈমান বাইহাকী, হাদিস ৩৫৭০

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- الصِّيَامُ جُنّةٌ، وَحِصْنٌ حَصِينٌ مِنَ النّارِ.

রোজা হল (জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভের) ঢাল এবং সুরক্ষিত দুর্গ। —মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-৯২২৫; শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকী, হাদিস ৩৫৭১

রোজা কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “রোজা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে রব! আমি তাকে খাদ্য ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, (অর্থাৎ না ঘুমিয়ে সে তেলাওয়াত করেছে) অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। —মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৬৬২৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস ২০৮০; বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান, হাদিস ১৯৯৪

রোজাদারের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়:
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন— مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজান মাসের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। —সহিহ বুখারী, হাদিস ৩৮, ২০১৪; সহিহ মুসলিম ৭৬০ (১৬৫); মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৭১৭০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস ৮৯৬৮

রোজাদারের মুখের গন্ধ মিশকের চেয়েও সুগন্ধযুক্ত:
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ.

সেই সত্তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধময়। —সহিহ বুখারী, হাদিস ১৯০৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৫১ (১৬৩); মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৭১৭৪; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২৫২৩; সুনানে ইবনে মাজাহ ১৬৩৮

রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত: হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন— لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا : إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ، وَإِذَا لَقِيَ رَبّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ.
وفى رواية : اذا لقى الله فجزاه فرح،

রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে, যখন সে আনন্দিত হবে। এক. যখন সে ইফতার করে তখন ইফতারের কারণে আনন্দ পায়। দুই. যখন সে তার রবের সাথে মিলিত হবে তখন তার রোজার কারণে আনন্দিত হবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন সে আল্লাহর সাথে মিলিত হবে, আর তিনি তাকে পুরস্কার দিবেন, তখন সে আনন্দিত হবে। —সহিহ বুখারী, হাদিস ১৯০৪, ১৮৯৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৫১ (১৬৩, ১৬৪, ১৬৫); মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৯৪২৯, ৭১৭৪; সুনানে তিরমিযি, হাদিস ৭৬৬

রোজাদার পরকালে সিদ্দীকীন ও শহীদগণের দলভুক্ত থাকবে:
হযরত আমর ইবনে মুররা আলজুহানী রা. হতে বর্ণিত- جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَرَأَيْتَ إِنْ شَهِدْتُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَأَنّكَ رَسُولُ اللهِ، وَصَلَّيْتُ الصلَوَاتِ الْخَمْسَ، وَأَدَّيْتُ الزَّكَاةَ، وَصُمْتُ رَمَضَانَ وَقُمْتُهُ، فممن أنا؟ قال: من الصديقين والشهداء.

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি একথার সাক্ষ্য দিই যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং অবশ্যই আপনি আল্লাহর রাসূল, আর আমি যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করি, যাকাত প্রদান করি, রমজান মাসের সিয়াম ও কিয়াম (তারাবীহসহ অন্যান্য নফল) আদায় করি তাহলে আমি কাদের দলভুক্ত হব? তিনি বললেন, সিদ্দীকীন ও শহীদগণের দলভুক্ত হবে। —মুসনাদে বাযযার, হাদিস ২৫; সহিহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস ২২১২; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৩৪২৯

রোজাদারের দুআ কবুল হয়: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- إِن لِلصائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ لَدَعْوَةً مَا تُرَدُّ. قال البوصيرى : اسناده صحيح.

ইফতারের সময় রোজাদার যখন দুআ করে, তখন তার দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (অর্থাৎ তার দুআ কবুল হয়)। —সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৭৫৩

হযরত আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসা ইরশাদ করেছেন- ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ: الْإمَامُ الْعَادِلُ، وَالصّائِمُ حَتّى يُفْطِرَ... قال الترمذى : هذا حديث حسن.

তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না (অর্থাৎ তাদের দুআ কবুল করা হয়) ন্যায়পরায়ণ শাসকের দুআ; রোজাদার ব্যক্তির দুআ ইফতারের সময় পর্যন্ত এবং মজলুমের দুআ। তাদের দুআ মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং এর জন্য সব আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। তখন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, আমার ইজ্জতের কসম! বিলম্বে হলেও অবশ্যই আমি তোমাকে সাহায্য করব। মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৮০৪৩; সুনানে তিরমিযি, হাদিস ৩৫৯৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৭৫২; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৩৪২৮

রমজান হল খালেস ইবাদতের মৌসুম। তাই এ মাসের সময়গুলো যতটা শুধু আল্লাহর সাথে কাটানো যায় ততটাই কল্যাণ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে রমজান ও রোজার ফযিলত লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামীন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত