আমিনা আইরিন

২৬ মার্চ, ২০১৬ ০১:৪০

আমি ধর্ষিতা হয়ে মরতে চাই না

এই সমাজে প্রতিটি মেয়েই কখনো না কখনো ধর্ষণের শিকার হয়। হোক সেটা শারীরিকভাবে অথবা মানসিকভাবে।

মেয়েদের অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তারা অন্যের চাহনি দেখে, স্পর্শে বুঝে ফেলতে পারে সেই চাহনিতে বোবা স্পর্শে ভালোবাসা আছে, নাকি রিরংসা। এই অদৃশ্য ধর্ষণের সাথে কিভাবে মানিয়ে অথবা পাশ কাটিয়ে চলতে হয় তা বাঙালি প্রতিটা মেয়েই জানে।

কিন্তু বাঙালি 'বীর' পুরুষ এখন শুধু স্বপ্নে কোন মেয়েকে বিছানায় নিয়ে তুষ্ট হচ্ছে না। যখন স্বেচ্ছায় কোন মেয়ে তার রাতের কামনার সঙ্গী হচ্ছে না তখন সে ধর্ষণকেই তার পুরুষত্ব ভাবছে।

আর পুরুষত্ব ভাবাই উচিত। কারণ এই সমাজ ব্যবস্থাটা এভাবেই গড়ে উঠেছে যেখানে ধর্ষক নয় বরং ধর্ষিতাকেই লজ্জা আর অপমানের জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।

গত বিশ মার্চ তনু নামের আমার বয়সী একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হল, খুন হল। কোথায়? কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এর মত একটা চূড়ান্ত নিরাপদ জায়গায়। গতকাল পাবনার সাতক্ষীরায় আরও একজন ধর্ষণের শিকার হল। সোশ্যাল সাইটগুলো যখন তনু হত্যার দাবিতে সোচ্চার, তখন কিছু লোককে দেখলাম তনুর কাপড়, তনুর চরিত্র নিয়ে অযথা থিসিস করতে।

শুধু তনু না, প্রতিটা ধর্ষণের পরই একদল হাজির হয় সেই ধর্ষণকে জাস্টিফাই করতে। তাদের মানসিকতা দেখে সত্যিই মুখের লাগাম টেনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। যা কিছুই হোক শেষ পর্যন্ত সব কিছুর দায়ভার একটা মেয়ের কাঁধেই বর্তায়।

ভালো মেয়েরা এইভাবে চলে না। ভদ্র মেয়েরা ঐভাবে চলে না। এই জটিল নিয়ম মেনে চলা কোন মেয়ের উপর যখন নির্যাতন হয়, তখনো কোন না কোন ভাবে দোষ মেয়ের উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়।

আসলে মনে হয় আমরা কেমন যেন বেহায়া হয়ে গেছি। প্রতিদিন সকাল বেলা ব্রাশ করা, চা খাওয়ার মতই প্রতিদিন এমন দুই একটা ধর্ষণের খবর শুনি। যেন এটা খুব স্বাভাবিক। যেন প্রতিদিন দুএকটা ধর্ষণ ষোল কোটি বাঙালির দেশে তেমন কোন বড় ব্যাপার না।

কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারব, এদেশে যতগুলা ধর্ষণ এদেশে হয় তার মধ্যে হয়ত দশভাগের একভাগ প্রকাশ পায়। আর বাকি ভাগ লোকলজ্জার ভয়ে চেপে যাওয়া হয়।

না, আমি আজ আর এসব কিছুর বিচার চাই না। কি লাভ বিচার চেয়ে! আন্দোলন করে! খুব বেশি হলে, তনুকে শারীরিকভাবে ধর্ষণের বিচার হবে। কিন্তু সে মারা যাওয়ার পর তাকে যে হাজারবার ধর্ষণ করা হল চোখ দিয়ে, মুখ দিয়ে, তার কিন্তু কোন বিচার হবে না। আর এই একটা ধর্ষণের বিচার করে কি লাভ? একটি ধর্ষণের বিচার শুরুর আগেই যেখানে আর একটি ধর্ষণ হয়।

এতো ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি দিতে কেনো সাধারণ জনগণকে রাস্তায় নামতে হবে?

এটা যেন এদেশের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিটা ধর্ষণের পর আমরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামব। আন্দোলন করব। তারপর 'উপরওয়ালা' চাইলে বিচার শুরু হবে; আর নাহয় আমরা দুএক সপ্তাহ আন্দোলন করে ক্লান্ত হয়ে তরকারিতে লবণ বেশি হচ্ছে কেনো সেই গবেষণায় চলে যাব। তারপর আবার কোনো ধর্ষণ; আবার আন্দোলন, আবার ক্লান্তি!

এভাবে চলতে চলতে যেদিন নিজের গায়ের উপর পড়বে, তখন হয়ত আর কারো আন্দোলন করার আগ্রহ থাকবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কেনো ধর্ষণের পরে আন্দোলন করি? এই সমাজে যাতে আর কেনো নারী কিংবা শিশু ধর্ষিতা না হয় তার ব্যবস্থা কেনো করি না!

আর তা যদি না পারি বরং প্রতিটি জেলায় থানায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর মত একটি করে বেশ্যালয় খোলা হোক। তুষ্ট থাকুক মহারাজেরা, তুষ্ট থাকুক তাদের কামনা। এর ফলে অন্তত রাস্তাঘাটে আর ধর্ষিতা হয়ে মরতে হবে না।

আজ স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু সত্যি একজন মেয়ে হিসেবে আমি আজ স্বাধীনতার স্বাদ উপলব্ধি করতে পারছিনা। আমি আজ বাঙালি মেয়ে হয়ে বলতে পারি আমরা পরাধীন। আমরা বাংলার 'বীর' পুরুষদের কাছে পরাধীন। আমরা পরাধীন তাদের লালসার কাছে।

আমাদের নারী, স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই! এই বাংলার মাটিতে আমাদের কোন সম অধিকারের প্রয়োজন নেই! বাঙালি 'বীর' পুরুষেরা, এই বাংলা আপনাদের, আপনাদের গৌরবেই এই বাংলা ভাসুক বরং!

আমরা নিরীহ বাঙালি নারী, একটিই শুধু দাবি করি, আপনাদের গৌরবের তরবারি দিয়েই না হয় আমাদের ধর্ষিতা হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত