চিররঞ্জন সরকার

১৫ জুলাই, ২০১৬ ১৮:২২

আবার রক্তাক্ত ফ্রান্স

জনসমাবেশে একটি ট্রাক ৮০ কিলোমিটার বেগে চালিয়ে দেওয়া যায়? এও কী সম্ভব? ট্রাক ঘাতক হয়ে প্রায় দু’ কিলোমিটার রাস্তা দিয়ে ভিড়ের মধ্যে মানুষকে পিষতে পিষতে এগিয়ে যেতে পারে, এটা কেউ কখনও ভেবেছিল? জঙ্গি সন্ত্রাসীরা সেই কাজটিই করেছে। মানুষ মারার অভিনব সব কৌশল বের করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এভাবেই ফের জঙ্গি হামলার নিশানা হয়েছে ফ্রান্স। যার জেরে অন্তত ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে নিস শহরে ফ্রান্সের জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান চলছিল নিস শহরে। আতসবাজির খেলা দেখতে সেখানে হাজির হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ সেই সময়েই পুলিশের নিষেধ না মেনে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে আসে একটি ট্রাক। রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে উঠে মানুষকে পিষতে পিষতে এগিয়ে যায় সেটি। এরপরে পুলিশ গুলি করে ওই ট্রাক চালককে হত্যা করে। পরে জানা যায় ট্রাকটিতে বিস্ফোরক বোঝাই করা ছিল। পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইতে ট্রাক চালকের মৃত্যু না হলে বিস্ফোরণে ট্রাকটি উড়ে গিয়ে আরও বড় মাপের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত বলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অনুমান। এখনও পর্যন্ত শিশু, মহিলা মিলিয়ে অন্তত ৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও শতাধিক মানুষ আহতও হয়েছেন।

ট্রাকটিকে আটকানোর জন্য পুলিশকর্মীরা গুলি ছুড়লেও সেটি প্রথমে থামেনি। প্রথমে ট্রাকের চাকায় বহু মানুষকে পিষে দেওয়ার পরে পুলিশের বাধা পেয়ে ট্রাক থেকে নেমে চালক এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ৩১ বছরের তিউনিশিয়া বংশোদ্ভূত মৃত ট্রাক চালক একজন জঙ্গি বলেই পুলিশের প্রাথমিক অনুমান। মৃত্যুর আগে অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ পুলিশকর্মীদের সঙ্গে তার গুলির লড়াই চলে।

২০১৫ নভেম্বরে জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত হয়েছিল প্যারিস। প্যারিসের সে হামলায় নিহত হয়েছিল ১৩০ জন, আহত হয়েছিল অনেক মানুষ৷ তারপর গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে নতুন সন্ত্রাসী হামলার আতঙ্কের মাঝে বাস করছে ফ্রান্সের মানুষ৷ সারা দেশে চলছে জরুরি অবস্থা৷ এই জরুরি অবস্থার মধ্যে আবার ঘটল এই অভিনব রক্তাক্ত হামলার ঘটনা।

আবারও সবার প্রশ্ন, কেন বার বার ফ্রান্সই জঙ্গি হামলার নিশানা হচ্ছে? অনেক বিশ্লেষক এর নানা কারণ ব্যাখ্যা করছেন। অনেকে এর জন্য ফ্রান্সের মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে দায়ী করছেন। অনেকে আবার অভিবাসী মুসলিমদের প্রতি ফ্রান্সের বৈষম্যমূলক নীতিকেও দায়ী করছেন। ফ্রান্সে প্রায় ৫০ লক্ষ মুসলিমের বাস, যা ইউরোপের মধ্যে সব চেয়ে বেশি। এই ফ্রান্স থেকেই ৯০০-র বেশি জঙ্গি ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর হয়ে লড়াই করতে ইরাক ও সিরিয়া গিয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর।এদের প্রভাবে কিংবা এদের কারও দ্বারা এই হামলা ঘটতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

‘জিহাদ’ গোটা বিশ্বে উঠতি মুসলিম যুবদের কাছে এক আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ব থেকে প্রতি সাতজনে একজন জিহাদি গ্রুপে যোগ দিচ্ছে। তারাই বিভিন্ন দেশে জঙ্গি আক্রমণে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আইএস ফ্রান্সকে পছন্দ করে আরো দুটি কারণে। প্রথমত, আইএস ইউরোপীয় দেশ হিসাবে ফ্রান্সকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে। আইএসের শীর্ষ মুখপাত্র আবু মোহাম্মদ আল-আদানি বলেছিলেন, তোমরা যদি অবিশ্বাসী আমেরিকান কিংবা ইউরোপিয়ান কাউকে হত্যা করতে পারো বিশেষ করে ফ্রান্সের ওপর, সেটা যে উপায়ে হোক। ফ্রান্স আইএসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অংশীদার।

দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সকে টার্গেট করার পেছনে বাস্তব কারণ আছে।পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্সে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করে। সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে দেশটি আইএসের অন্যতম প্রধান উৎস। আইএস মূলত ফ্রান্সে মুসলিম বিরোধী উস্কানি বাড়িয়ে দিতে চাইছে। তারা চায় এখানে মুসলমানদের হত্যা করা হোক। তারা এখানে গৃহযুদ্ধ চায়।

কারণ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ এবং তার সোশালিস্ট পার্টি এখন দুর্বল অবস্থানে আছে। তার বিরোধী মেরি লে পেনের ন্যাশনাল ফ্রন্ট রাজনৈতিক সফলতার দিকে যাচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে আঞ্চলিক নির্বাচনে জিতে যায় তাহলে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে মেরি লে পেনের দল একধাপ এগিয়ে যাবে। ফলে ওলাঁদের রাজনৈতিক জীবনের জন্য সংকটময় মুহূর্ত এখন। ওলাঁদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে আইএস। তাদের এই হামলা যে বিশ্বে বিশেষ করে ফ্রান্সের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিকভাবে প্রভাব ফেলবে সেটা আইএস খুব ভালো করেই জানে। তারা পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে। আইএস জানে, ওলাঁদ তার দুর্বলতা ঢাকতে এবং রাজনৈতিক সংকট কাটাতে বড় ধরনের অভিযান চালাবে আইএসের বিরুদ্ধে। এর ফলে ফ্রান্স থেকে নতুনদের নিয়োগে তাদের সুবিধা হবে। কারণ মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হয়ে আইএসে যোগ দেবে। এই অশুভ রাজনীতির খেলায় বলি হচ্ছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ।

এ ছাড়া ফ্রান্সের মুসলিম অভিবাসীদের মনে রয়েছে নানা ক্ষোভ। তা থেকে কেউ আত্মঘাতী হলেও হতে পারে। আশির দশকে ফ্রান্স মুসলিম অভিবাসীদের একাধিক স্ত্রী আনতে ‘চুপচাপ’ অনুমতি দিয়েছিল। ২০০০ সালের হিসাবে, শুধু প্যারিসেই দু’লক্ষ পরিবারে একাধিক স্ত্রী রয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে সরকার এক স্ত্রী ও তার সন্তানকেই বৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা করে। কেন অভিবাসনের শর্ত হিসেবে প্রথমেই সেটা বলা হয়নি সেটির পেছনে রয়েছে রাজনীতি। গোষ্ঠীর অধিকারের নামে বাল্যবিবাহ, জোর করে বিয়ে, একতরফা বিচ্ছেদ, মেয়েদের খৎনা, বোরকা পরিধান, সম্মানের নামে হত্যা এ সব ‘অধিকার’-এর তকমা দিয়ে চালু রাখার সুযোগ দিয়েছিল তারা। এসব নিয়ে কোনো মামলা হলে গোষ্ঠীর অধিকার ও সাংস্কৃতিক বহুত্বের নামে অভিযুক্তরা হালকা শাস্তি পেত, এমনকি অনেকে ছাড়াও পেয়েছে।

এই বহুত্ববাদ প্রায়শ একটি গোষ্ঠীর গোঁড়া অংশটিকে লালিত ও পুষ্ট করে তুলেছে। আজ তাই বহু পশ্চিমিও আইএসে যোগ দিতে আকৃষ্ট হয়েছে। আইএসের উত্থান শুধু শিয়া-সুন্নির বিরোধ বলে ভাবলে চলবে না। এটা হচ্ছে মৌলবাদী উন্মত্ততা। ধর্মীয় মৌলবাদের ছড়ানো শিকড় এখনই কাটতে শুরু না করলে আমরা সবাই বিষবৃক্ষের ফল খেতে বাধ্য হব। মেয়েদের সর্বনাশ হবে সবচেয়ে বেশি। মুক্তচিন্তার দেশ ফ্রান্সে বার বার হামলা ফরাসীদের জন্য তো বটেই, বিশ্ববাসীর জন্যই বিপদ-সংকেত।

অনেকেই বলে জঙ্গিবাদ পশ্চিমা রাষ্ট্র ও ইসরাইলের সৃষ্টি। এই কথার মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে, কিন্তু এটা মিথ্যে নয়। প্রশ্ন হলো, আইএসসহ মৌলবাদী জঙ্গিদের স্রষ্টা হিসেবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইসরাইল এমনকি ভারতকেও যদি ধরা হয়, বিভিন্ন দেশে জঙ্গি হামলাগুলো কিন্তু এসব দেশের নাগরিকরা করছে না। যারা হামলার সঙ্গে যুক্ত, তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের। দোষ কিন্তু পড়ছে মুসলিমদের ঘাড়ে। আমেরিকা, ইসরাইল, ভারত মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাবে, আর কিছু কিছু মুসলিম এই ষড়যন্ত্রের জালে পা দিয়ে নিজেদের কমিউনিটির সমূহ সর্বনাশ করে চলবে, তবে কী এই ধারাই যুগের পর যুগ চলতে থাকবে?

হামলাকারীরা মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ভুল আদর্শ, ভুল মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। এই পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত মুসলিম জঙ্গিরা। এই মুসলিম নামধারীরা পুরো মানবজাতির জন্য অভিশাপ তো বটেই, সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য। মুষ্টিমেয় জঙ্গির সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে পৃথিবীব্যাপী মুসলিমরা সন্দেহভাজন হচ্ছে। তাদের অবিশ্বাস করা হচ্ছে। নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে তারা। তৈরি হচ্ছে বিদ্বেষ, ঘৃণা।

এ পরিস্থিতিতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মুসলিম সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। কেননা জঙ্গিবাদের সঙ্গে মুসলিম ট্যাগ লাগানোর যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, এর বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার না হলে ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি মূল্য গুণতে হতে পার। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের পাপে এই সভ্যতা সমাজ সুখশান্তি ধ্বংস হতে পারেনা। জিহাদ, সন্ত্রাস, খুন-খারাবির পথ থেকে সবাইকে। সরে আসতে হবে। মানুষ খুন যে কোনো ধর্মের বিধান নয়, বরং অধর্ম, এটা নিজেকে বুঝতে হবে, অন্যকেও বোঝাতে হবে।

বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হামলা চালিয়ে কিছু মানুষ মারা যায়, কিছু মানুষকে হয়তো ‘শিক্ষা’ও দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় না। ধর্মও তাতে মহীয়ান হয় না। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরি ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি অপরাধী, তাহলে তার ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে না কেন? কেন ওবামা অক্ষত থাকছেন? ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর উপর জঙ্গি আক্রমণ করা হচ্ছে না কেন? শুধু শুধু কিছু নিরীহ মানুষকে খুন করে পুরো বিশ্বকে ‘মুসলিম বিদ্বেষী’ বানানোর যে জঙ্গিবাদী তৎপরতা, তার বিরুদ্ধে সবাইকে এখনই সোচ্চার হেতে হবে। না হলে মুসলিমরা একঘরে হয়ে পড়তে বাধ্য। সেটা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হবে না মোটেই।

চিররঞ্জন সরকার : লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত