জাহানারা নুরী

২৯ জুলাই, ২০১৬ ১৬:১৬

কথোপকথন যখন চরমপন্থির সঙ্গে!

ফেসবুকের এক লড়াই নিয়ে লিখছি। যে লড়াই ফেসবুক ছেড়ে কারু কারু জন্য বাস্তব জীবনেও চলে আসে। যদিও এ লড়াই অন্তিমে কাউকে বিজয়ী করে না বরং এক পক্ষের হত্যার প্রবণতা ও অপরপক্ষের খুনোখুনি বিমুখ শান্তিবাদীতার প্রেক্ষিতে আরো লড়াইয়ের পূর্বাভাষ জাগিয়ে রাখে। এ লড়াই সেকুলার বাংলার ছেলেমেয়েরা নিরন্তর লড়ে যাচ্ছে। যা দেখা যায় না। যা কোনও পুরষ্কার প্রত্যাশা করে না। যা কেবল স্বপ্ন রচনা করে যায় আগামীর মুক্ত পৃথিবী ও মানবিকতার।

আমি ফেসবুকে লিখছিলাম এই সময়ের কৌতূহল উদ্রেককারী একটি বিষয় নিয়ে। ১ জুলাই, ২০১৬ এর রাতে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে স্থানীয় আই এস আই এস অনুসারী সন্ত্রাসীরা ২২ টি প্রাণকে নির্মমভাবে হত্যার পর আমরা দেখেছি নানা দিক থেকে নানান প্রশ্ন জেগে উঠছে। কোনও প্রশ্নের পূর্ণ উত্তর পাওয়া হয় নি। হলি আর্টিজানে আক্রমণের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সবাইকে বলতে ও লিখতে শুনেছি এবং পড়েছি কিছু কমন রেটোরিক। তার মধ্যে প্রধান যে আবেগটি প্রকাশ পেয়েছে তার নাম বিস্ময়। সবাই বিস্মিত হয়েছেন ভেবে যে কিভাবে এতো অল্প সময়ে এত তরুণ জঙ্গি হয়ে উঠলো । এ বিস্ময় তাদের যাচ্ছিল না। খেয়াল করুন বাক্যটিতে কতগুলো শব্দ আছে যা দিয়ে তারা বোঝাতে চাইছেন ঘটনাসমূহ কতখানি অচিন্তনীয়, অভাবনীয়; শব্দগুলো হচ্ছে ’কিভাবে’, ‘এত অল্প সময়’ ইত্যাদি।

এত অল্প সময় বলতে বক্তারা কি বোঝান তা বোধগম্য হয় নি আমার। এ কথা দিয়ে তারা বোঝাতে কি চান যে আমাদের ভেতর এর দেশে আগে কখনও এমন চরমভাবাপন্নতা ছিল না? আত্মঘাতী রাজনীতির প্রবণতা ছিল না? তা সঠিক নয়। আমাদের সমাজে আত্মঘাতী চরম ভাবাপন্ন রাজনীতির প্রবণতা, ক্ষমতার লোভ ও হিংসার কারণে প্রতিপক্ষকে অথবা অন্যকে হত্যা করার প্রবণতা বহাল তবিয়তে ছিল। হয়তো মুষ্টিমেয়ের মধ্যে ছিলো এবং এখনো আছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধ্বজাধারীদের ভেতর যে এ চরমভাবাপন্ন আচরণ ও মানসিকতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ছিল তার প্রমাণ ৭১ শুধু নয়, একাত্তর পরবর্তী গত চুয়াল্লিশ বছরে বহুবার আমরা পেয়েছি। তাহলে আমরা তাকফিরি আই এস আই এস এর প্ররোচনায় তরুণদের ছুটে যাওয়া পতঙ্গের মতো মৃত্যুফাঁদে ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে এত সরল বিস্ময় কেন প্রকাশ করছি?

বাস্তবে জঙ্গি রিক্রুটমেন্ট কিভাবে ঘটে তার কয়েকটি অভিজ্ঞতা পাঠ করেছিলাম। মনে হলো বিষয়টা কিভাবে ঘটানো চলছে তার একটা আবছা আঁক মনের মধ্যে যেহেতু আছে লিখে ফেলি। ফেসবুকে কয়েকটি বাক্য লিখেই ফেললাম। সকলের সঙ্গে ভাববিনিময় তো করতে হবে। মনে হচ্ছিল আসলে তো মুসলমানের সন্তান হিসেবে সন্ত্রাসী হওয়ার আগে এ সব তরুণের ভেতর ইসলামের দুর্বল বীজটা ছিল। তবে তাদের ভেতর ছিল বাংলার ইসলামের বীজও, যেমন থাকে পোশাক আশাক, সহজ জীবনের অংশ হিসেবে তেমনি। এসব তরুণ মসজিদে আসতো যেতো। সেখানে ছদ্মবেশী উম্মাহর চরমপন্থি ভাই বেরাদারদের চোখে পড়তো। কর্মক্ষেত্রে, দোকানপাটে বা তার কাছাকাছি ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কিন্তু টার্গেটের কাছে আচমকা, সাক্ষাৎ তো হতো। সাদর বন্ধুত্বের আহ্বান কে ফেলতে পারে। বন্ধুত্ব হতো। ক্রমে বন্ধুত্বের পরিসর বিস্তৃত হতে লাগলো। নতুন নতুন বন্ধু জুটলো। তরুণটি কিন্তু জানলও না তার জীবন নিয়ে কেউ ততক্ষণে খেলা শুরু করে দিয়েছে।

বাঙালি মুসলমান ধর্ম বিশ্বাস করে প্রশ্ন ছাড়া। যে ধর্মের আহ্বান নিয়ে আসে তাকে তরুণরা অধিকাংশই প্রশ্ন কিম্বা সন্দেহ করতে শেখে নাই। ধর্মে বিশ্বাসী যে সে বা তারা যে নির্মমভাবে আরেক মুসলমানকে হত্যা করতে পারে এটাও কিন্তু ফেসবুকে পড়েছি তরুণদের একাংশ এতদিন বিশ্বাস করতো না। বরং তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও তাদের কৃত অপরাধগুলো নিয়ে সন্দেহ ব্যক্ত করতো। আশ্চর্যজনকভাবে তাদের কেউ কেউ এখন জঙ্গিদের হাতে ব্যাপক বিধর্মী ও নাস্তিক হত্যাকে জাস্টিফাই করতে চেষ্টা করে। তা যে রাজনীতির কারণে করে তা বোঝা যায়।

তো বন্ধুদের সাথে উঠতে বসতে গিয়ে ক্রমাগত এক হাত থেকে আরেক হাতে যেতে যেতে টার্গেট তরুণ ক্রমে কুরানের সেই সব আয়াতের পাঠ গ্রহণ করতে শুরু করে যেখানে একজন মুসলমানকে বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার আমন্ত্রণ রয়েছে। সাথে সুন্নাহ পালনকারীদের জন্য উদাহরণ হিসেবে থাকছে আব্বাসীয় বিদ্রোহের ও ইসলামের বিভিন্ন ফিতনার আমলের তৈরি হাদিসগুলো। ঐসব হাদিস দ্বারা প্রমাণ দেয়া হয় যে নবী নিজ জীবনে কোনও বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে ঐকাজ করেছেন। ধাপে ধাপে শিক্ষার ভেতর দিয়ে যাওয়া তরুণকে নিশ্চয়ই বোঝানো হয় যে এই বিশেষ ভাইয়েরা নবীরই সুন্নত পালন করতে নেমেছেন। তারা নবীর অনুসরণকারী। টার্গেট তরুণ দেখা যাচ্ছে একের পর এক নতুন ব্যক্তির সাথে পরিচিত হচ্ছে ও ব্যক্তির মাধ্যমেই মোটিভেশন পাচ্ছে। ঐ তরুণের সাথে এমন সব তরুণরা মিশছে যাদের কেউ কেউ তার চেয়ে বেশি লেখাপড়াও করেছে। নিদেন পক্ষে কিছু বিষয়ে ওরা তার চেয়ে ঝানু। ইতিমধ্যে ছেলেটার স্ট্যাটাসই পাল্টে গেছে এদের সাথে মিশে। এতকাল শুধু নামাজ ও একটু আধটু  কুরান পড়তো। এখন জানার পরিধি ছেড়ে তারা বিশেষ অধ্যায়, বিশেষ সূরা বাস্তবায়নের পথের দিকে চলেছে। তরুণ কখন এই যাত্রার অংশ হয়ে গেছে খেয়ালই করে নি। যখন বুঝেছে হয়তো উপলব্ধি করে নি। তখন সামনে টাকা, ছোট্ট একটা ঘনিষ্ঠ বন্ধু গ্রুপ, উত্তেজনাকর জীবন, প্রায় ফিল্মের হিরো মনে হচ্ছে নিজেকে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে রাজনীতির স্বার্থ তো আছে। তবে রাজনীতিটা এই তরুণটির জীবনে ব্যক্তির মাধ্যমে প্রসারিত হচ্ছে।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডটা চালানো হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র গ্রুপ দিয়ে বিশ্বাস ইমুনাইজ করার মাধ্যমে। ব্যক্তি ও এই ছোট গ্রুপ গুলোর মাধ্যমে লাইনআপের কাজগুলোই করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত দেখা সাক্ষাতের দ্বারা। ব্যক্তিগত দেখা সাক্ষাৎ নিঃসন্দেহে এমন সব স্থানে যেখানে কারু সন্দেহ উদ্রেক না করে অর্থনৈতিক, সামাজিক সাক্ষাতের সুযোগ রয়েছে। যেখানে হয় কাজ, নয় প্রার্থনা করার চল রয়েছে। প্রথম দেখা, তারপর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড চলে এমন স্থানসমূহ; যেমন দোকান-পাট, মসজিদ, মাদ্রাসা, অজুখানা ইত্যাদি স্থানে একটু একটু আলাপ আলোচনা। পরিচয়ের সীমানা বিস্তৃত হয় ভ্রাতৃত্বে। ভ্রাতৃত্বের পরিসর বিস্তার লাভ করে নতুন নতুন একক ভ্রাতার সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে।  

প্রতিটি ক্ষেত্রে রিক্রুট করা তরুণের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নতুন রিক্রুটের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে জানাটা চরম মাজহাবের ছিল না। তবে ধর্মের অত্যন্ত উদার ব্যাখ্যাও তার ভেতর ছিল না। ধর্মের আধো-জানা মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্নহীন আধো জ্ঞান নিয়ে সে যখন শুনতে পায় তার চেয়ে বেশি কুরানের বয়ান বলছে কেউ সে নির্দ্বিধায় সে লোককে বিশ্বাস করে ও একদিন পরিবারের গণ্ডী ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। কারণ ইতিমধ্যে পরিবার ও সমাজের চেয়ে যে ধর্মের কাজ তাকে বেশি মহীয়ান করবে সে বিষয়ে তার বিশ্বাস গাঢ় হতে শুরু করেছে। সে বেরিয়ে গিয়ে ছোট্ট একটি দলভুক্ত হয়। শুরু হয় অন্য ধরণের প্রশিক্ষণ। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন শুধু জিহাদ ও ক্বিতালের সবকে দিন কাটানো এই সময়ে কখনো ভয় লাগলেও বেরুবার পথ কই?  সাথে সবসময় একটা দল থাকছে। নিশ্চয়ই মনিটর করার জন্য ও কেউ থাকছে।  

এই তরুণদের ধর্ম বিষয়ক জ্ঞানার্জনের পথে যে প্রশ্নহীন যুক্তিহীন চর্চার ফাঁক তার ভেতর কিন্তু ঢুকে পড়ছে উগ্র চেতনায় আচ্ছন্ন আরেকটি মন, যে মনটি গঠিত হাজার মাইল দূরের কোনও ঘাতক বাহিনীর চিন্তার ভাইরাস দ্বারা। তার মনকে ইমুনাইজ করছে সন্ত্রাসীরা তাদের রচিত ইসলাম ধর্ম দিয়ে। কি বিষয়ে ইমুনাইজ করছে? হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত যে ঘৃণা ও অপরাধের সাজা খাটার ভয় ভীতি তা থেকে তাকে ইমুনাইজ করে মুক্ত করা হচ্ছে। তার বিশ্বাসের ভেতর গুঁজে বেড়ে উঠতে দেয়া হয় চরমপন্থা, সরকার, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা, খুনের প্ররোচনা এবং বেহেশত ও সেইস্থানের অলৌকিক জীবনের আশাকে। ধর্মের সাথে অপার্থিব যৌনতার ওতপ্রোত সম্পর্ক তার তারুণ্যকে আদেশপালনমুলক এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে রোমাঞ্চের স্বাদ এনে দেয়। সে তখন এক জৈব ঘাতক প্রাণী। ধর্মের জন্য আত্মঘাতী হতে তৈরি।
       
এই চরম মনোভাবটি কিন্তু ওদের মনের ভেতর গুঁজে দেয়ার সুযোগটা ওরা পাচ্ছে কেননা আসল সত্যটা তরুণদের মনের ভেতর নেই। ধর্ম নিয়ে যে ঢাকঢাক গুড়গুড় ভাব মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত তা থেকেই প্রজন্মকে আমরা ধর্ম বিষয়ক ভাবনার ঘাটতির ভেতর ফেলে দেই। যা বোঝার সে সত্যটা জেনেই বুঝুক ও বিশ্বাস করুক এই সাহসটা মুসলমান সমাজ কিন্তু করতে চায় না। কিন্তু বুঝতে না দেয়া, বলা যে ’ইসলাম শান্তির ধর্ম’ আর সব বাজে কথা তা বুমেরাং হয়ে দেখা দিচ্ছে মুসলমান সমাজে। কুরানে হাদিসে ইসলামের ইতিহাসে যেসব হত্যার, ধর্ষণের, দাসত্বের কথা আছে তা কেন আজকের যুগে মানবার নয় সে যুক্তিটা এই তরুণদের ভেতর দেওয়ার দায়িত্ব কার ছিল?সবার, পরিবারের, সমাজের, ধর্ম শিক্ষকের, বিজ্ঞান শিক্ষকের, শিক্ষায়তনের, রাজনীতিবিদদের এমন কি রাষ্ট্রেরও।   

এ বিষয়টি আমি বেশি করে উপলব্ধি করেছি সামাজিক মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের সমর্থকদের গালিগালাজ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। আমরা যারা সেকুলারিজম নিয়ে লিখি তাদের সাথে বিশ্বাসী চরমপন্থিরা কিন্তু পাল্টা যুক্তিতে আসে না। আমার লেখা পড়ে একটি ছেলে সোজা ফেসবুকে যেন চাপাতি চালায় অর্থাৎ থ্রেট দেয় এবং কতগুলো বহুল প্রচলিত বাক্য মন্তব্য হিসেবে লিখে। তাদের প্রায় সবার মন্তব্যই কমবেশি অভিন্ন। তুলনামূলকভাবে কম অশ্লীল কিছু বাক্য এমন “যারা জঙ্গি সবাই নর্তকীর সাথে নাচত মদ খেত আপনি মসজিদ আনেন কেন?” “এই দেশ মুসলমানদের চলে যেতে পারেন” ”নাম দিছেন মুসলমানের আর কাম করেন মালাউনের”। “১৯৭৪ সালে পুরোপুরি ভাবে মুসলমান দেশ হিসেবে পেয়েছি কোথাকার বৌদ্ধ আর সাপ খোর ব্যাঙ খোর। ” ”আপনার ভাষা বদলান মুসলিম মসজিদ ইসলাম নিয়ে অপ প্রচার বন্ধ করেন। ” ” হিন্দু হয়ে মুসলমান নাম দিয়ে ইসলাম এবং মুসলমানের বদনাম করেন। ”

বাস্তবে আমরা কোনও খবরে কিন্তু পাইনি যে নিহত জঙ্গিরা কোনও নর্তকীর সাথে নেচেছে। মদ খেয়েছে পড়েছি। তাহলে এই মন্তব্যকারী তরুণ নর্তকী কোথায় পেল? এটা ইসলামি, ওয়াজ নসিহতে প্রায়শ: শোনা যায়। অর্থাৎ শব্দটি সে কোনও বড়ো ভাই বা ধর্মীয় নেতার বা তাদের রচিত পুস্তক থেকে পেয়েছে। সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালী কিন্তু এখন আর নর্তকী শব্দ বলে না, তারা নাচের মেয়ে বা নৃত্যশিল্পী বলে। ফেসবুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কমন এবিউজারদের একটা বড়ো দল হচ্ছে এরা যারা আধুনিক বাংলা ভাষার ব্যবহারিক রূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। সাঈদীর মতো ধর্ম বিষয়ক অপপ্রচারকারী তথাকথিত মওলানার শব্দাবলী দ্বারা তাদের মন ও মাথা ইমুনাইজড।

তো এই ইমুনাইজড মনটা কেমন? ফেসবুকে এসব উত্তরদাতার বেশির ভাগেরই প্রবণতা হচ্ছে লেখককে মুসলমান বুঝতে পারা সত্ত্বেও হিন্দু বৌদ্ধ অর্থাৎ বিধর্মী ও নাস্তিক বলতে শুরু করা। কেননা এই শব্দগুলো তাদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণা প্রকাশক। যদি আমি কুরানকে যারা সত্য ধর্ম, শান্তির ধর্ম হিসেবে বিশ্বাস করেন তাদরে চোখ দিয়েই দেখি তাহলে বলতে হয় চরমপন্থিদের মধ্যে  এই বাস্তব বিষয়টির জ্ঞান কম থাকে যে বা তারা হয়তো সচেতনভাবেই এড়িয়ে যায় যে  কোরান-এ বর্ণিত সপ্তম শতকের হত্যার ঘটনাগুলো শানে নযুল বা পরিপ্রেক্ষিত দ্বারা বুঝতে হবে। পূর্বাপর পটভূমির মধ্যে সেসব সূত্রবদ্ধ।

এটি নিঃসংশয়ে বলা যায় বিশেষ কোন একটা আয়াত যে বা যারা বাস্তবায়নে নেমেছে তারা এসব জেনে শুনেই করছে। তাহলে বলতে হয় রিক্রুট করতে মাঠে নেমে তরুণদের মিথ্যা অনেক আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। আমরা যারা এসব নিয়ে লিখালিখি করছি তাদের লেখা তরুণদের এই শ্রেণীটিকে ডি–ইমুনাইজ করছে। যুক্তি এমন একটা বিষয় যা সংশয় হয় দূর করে না হয় মনে নতুন প্রশ্ন জাগিয়ে দেয়। সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দেহ জোরদার করতে পারে বিধায় ওরা যুক্তিকে আক্রমণ করে এবং প্রশ্নকে হত্যার ভয় দেখায়। দেশ ছাড়া করতে চায়। প্রশ্ন ও যুক্তির ভীতি রয়েছে তাদের মধ্যে। প্রশ্ন ও যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে প্রতিটি আবরাহমিক পুস্তকের ধর্ম ধোপে টিকবে না। তাই সতের শতকে হাম্বলী তার শিষ্য ইবনে তাইমিয়্যাকে বলেছিলেন, প্রশ্ন করো না। তাইমিয়্যাহর অনুসারীদের মধ্যে চতুরতম ও হিংস্রতম বেদুইন ওয়াহাব বলেছিলেন, যে তার কথায় সন্দেহ পোষণ করবে তাকে না কি হত্যা করতে হবে। এই ইতিহাসটি উল্লেখ করার কারণ যে তরুণদের সাথে আমার গালিগালাজ সূত্রে ধর্ম ও রাষ্ট্র বিষয়ক ডিসকোর্স চালু থাকছে তারা এসব সরল প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হুমকি দেয়। তাদের পরিচয় হিসেবে তারা কালেমা আল্লাহ ইত্যাদি লেখাই শুধু প্রোফাইলে রাখে না বাংলাদেশ, এর প্রাকৃতিক দৃশ্য, বাংলাদেশের পতাকা, এবং জিয়াউর রহমানের ছবি এমন কি শেখ মুজিবের ছবিও রাখে।

তাদের প্রশ্ন নেই কিন্তু হুকুম আছে। আমার ধৈর্য অপরিসীম। সুতরাং তারা তাদের দুর্ব্যবহার চালিয়ে যেতে থাকে। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে ব্লক করে দেই। মনে হয় কেন এরা ব্রেন ব্যবহার করতে চায় না? প্রশ্ন মানে তো বুদ্ধি, বিদ্যা ও যুক্তি। কেন মসজিদের খুতবা নিয়ে লিখেছি। কেন আমার লেখায় ইসলামের প্রসঙ্গ আসবে? আমি মেয়ে মানুষ লিখবো ফুল পাখি লতা পাতা, স্বামী সেবা কিভাবে করতে হয়। আমি মসজিদ ও জুম্মার খুতবা নিয়ে লিখি। সরকার খুতবা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমি ঈদের নামাজ নিয়ে লিখি, ঈদের জামায়াতে জঙ্গি হামলা পুলিশ ঠেকিয়ে দেয়। সরকার, পুলিশ যে আমি লিখেছি বলেই ঐ সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা তো নিশ্চয়ই না। তবে সরকারকে তো সরাসরি কিছু এখনও করতে পারছে না ফলে এরা আমার মতো লেখকদের গাল দেয়, ব্যাঙ্গ করে। উপাদেয় রকমের ইংরেজি বা আরবি গালিগালাজ ও তার মধ্যে থাকে।  

মসজিদ আনেন কেন আপনার আলোচনায়? ওদের প্রশ্ন। কিন্তু যারা মসজিদ বা নামাজকে রাজনীতির হাতিয়ার বানায় তারা যত্রতত্র মসজিদ, ধর্ম, কুরান হাদিস নিয়ে আসতে পারে। তারা নিশ্চয়ই ধর্মের সোল এজেন্সি পেয়েছে। তারা যে কোনও হুজুগে তৈরি করে বৌদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক লেখক এবং হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার, তাদের হত্যা করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। গেণ্ডারিয়ার মসজিদ নিয়ে তারা অর্গানাইজড ক্রাইম করেছে। রাতের গুলশানে যা ঘটবে বলে টুইট করা হয়েছিল সে দিক থেকে সরকারের দৃষ্টি সরিয়ে ব্যস্ত রেখেছে গেণ্ডারিয়ায়। ২০১৩ সালে ফটিকছড়িতে দেখেছি মসজিদকে লীগের সমর্থকদের হত্যার কাজে ব্যবহার করতে। মসজিদের সম্মান এভাবে ধুলায় লুটিয়ে দেয় তারা। প্রার্থনা ঘর যদি পবিত্র হতো তাদের কাছে তাহলে কোনো মুসলমান ওয়াজকারী ওয়াজ করতে বসে দেশের ও দশের মঙ্গলের কথাই বলতো। নারীর কুৎসা না করে নারীজাতিকে সম্মান করতে বলতো। অন্য ধর্মের ও ধর্মহীনদের সাথে সুন্দর ব্যবহার উৎসাহিত করতো। মসজিদকে যে নোংরা রাজনীতির প্রচারণার, রিক্রুটমেন্টের এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগকে ব্ল্যাকমেইল করবার কুকাজে ব্যবহার করা হয়েছে ও হচ্ছে তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

তবে এসব আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর সমাজকেও আমার উপলব্ধি হয় বটে। আমরা সমাজের মানুষরা চাই না ধর্ম আসলে কি তা মানুষ জানুক? গোটা মুসলমান সমাজই তা চায় না। চাইলে ধর্মের মঙ্গল হতো। কিন্তু ধর্মের মঙ্গল ধর্মবাজদের উদ্দেশ্য নয়। রাজনীতির উদ্দেশ্য মানুষকে যথাসম্ভব অজ্ঞ রাখা। কুরানের প্রতিটি স্কুলিং এর উদ্ভব কুরান ও হাদিস বিষয়ক ব্যক্তির অভিমত থেকে। এটা বলা যাবে না কেন? মসজিদ একটি উম্মাহর সম্মেলনের স্থান। সেটাকে রাজনীতির ফায়দা লোটার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এ সত্য বলা যাবে না কেন?

যদি আমরা আমাদের তরুণদের বলতাম দ্যাখো এই হচ্ছে কুরান। এর একদিকে এই মহৎ চিন্তা এর অপর দিকে এই সীমাবদ্ধতা। যদি আমরা তাদের বলতাম ধর্মের সমস্ত মহৎ গুণাবলী সত্ত্বেও তার সবই ন্যায় নয়, ন্যায্য নয়। কেউ তো আই এস আই এসের ওই নিহত নতুন রিক্রুট তরুণকে তা বলে নি। ধর্মের এই এই দিকে গেলে সে কাজটা যে আসলে আজকের পৃথিবীতে ফৌজদারি ক্রাইম, এবং দেশদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য হবে, কেউ কি তাকে জানিয়েছে ? না তো । কেউ তো তাকে বলে নি এই সত্যটা যে বিশেষ কিছু সূরার নির্দেশ বাস্তবায়ন আসলে বর্তমান যুগের আইনের চোখে ক্রাইম? বলেনি যে কতিপয় সহি বা অসহি হাদিস এবং সব আবরাহমিক পুস্তকের কতিপয় সূরা, সূক্ত বা স্তোত্র হত্যার, ধর্ষণের ও দাসদের এবং নারীদের চরম নির্যাতনের মতো অপরাধ করতে নির্দেশ দেয়। তারা যদি এসব সত্য জানতো, যদি তাদের শেখানো হতো ধর্মের কোন জিনিসটি সবচেয়ে খারাপ আর কোনটি ভালো তাহলে তাদের মনের মধ্যে ধর্ম নিয়ে এমন কোনো অন্ধকার গহ্বর থাকতো না যার সুযোগে তাদের কেউ আত্মঘাতী পথে নিয়ে যায়।

আমাদের সমাজ বদ্ধ। ধর্ম ও যৌনতা, আইন ও সংবিধান এসব অতি প্রাকৃত ব্যাপার স্যাপার। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের কথা বলা নিষেধ। সব দলের রাজত্বে ক্ষমতায় বসা দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ আলোচনা নিষেধ। আলাপ আলোচনা সমালোচনা না থাকলে ঐ বিষয়ে মন থাকে স্থবির। স্থবির মনে আগাছা জন্মে পরে ব্যক্তির গোটা দেহ-মন-চিন্তার সিস্টেমটাকেই গ্রাস করে।

তরুণদের আমরা এই কথাগুলোই বা কতবার বলেছি যে মানুষকে মানুষের কাছে আনে যে সব উপলব্ধি ও চিন্তাধারা তার মূল সুর হচ্ছে  মিলন, পারস্পরিক সহমর্মিতা,সহযোগিতা সৌজন্য ও ভদ্রতা বোধ। এগুলো যেমন মানুষ ঐতিহ্য ও জাতিগত সংস্কার থেকে অর্জন করে তেমনি ধর্মের যা কিছু ভালো তা থেকেও গ্রহণ করে। সামাজিক যে সম্পর্ক মানুষকে বেঁধে রাখে তার মধ্যে থাকে একে অপরের নিরাপত্তা বিধান, বিপদে আপদে সহায়তা, পরস্পরকে সম্মান প্রদান ও এক অপরের মানবাধিকার রক্ষায় সমভাবে হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা। ব্যক্তি যদি এই সব প্রবণতাচ্যূত হয় তখন ব্যক্তি মানুষ ধর্মচ্যুত হয়। কারণ যা কিছু সৃষ্টি তা যদি সবই আল্লাহর বা খোদার হাতে হয়ে থাকে তবে এই ডাইভার্সিটি তার প্রিয় বলেই তিনি তা তৈরি করে রেখেছেন। এই বৈচিত্র্যের বিরুদ্ধে যাওয়ার অর্থ আল্লাহর সংগুপ্ত লীলার বিরুদ্ধে যাওয়া। তার সৃষ্টি মানুষকে ভিন্ন হওয়ার কারণে অপমান অপদস্থ করার মানে সৃষ্টিকর্তাকে অপমান করা।

আমরা কি আমাদের তরুণদের জানিয়েছি যে প্রতিটি দেশে বাইরে থেকে ইসলাম যখন প্রবেশ করে তখন তা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রবেশ করলেও ইসলাম টিকে গেছে মুষ্টিমেয় কিছু সূফীবাদী ধর্মপ্রচারকের কারণেই, যারা মানুষের মিলনে ও সহনশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন। যারা ভারতবর্ষে (প্রাচীন ভারতবর্ষ বলতে আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বোঝায়) আসার পর এদেশের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য, আচার আচরণ করণ-কারণকে ভালোবেসেছেন। তারা অনেকেই এদেশে থেকে গিয়ে পরিবার গড়েছেন ও ধর্ম প্রচার করেছেন। সুতরাং প্রতিটি স্থানীয় সংস্কৃতিকে আত্তীকৃত করেই প্রতিটি দেশে ইসলাম প্রসারিত হয়েছে। বৌদ্ধ, প্রকৃতি উপাসনার সংস্কৃতির বিপুল স্রোতের সাথে ইসলাম নিয়ে আসা মধ্যপ্রাচ্যীয় সংস্কৃতির স্রোত মিশেছে ভারতে। তেমনি আফগানিস্তান ও তৎসংলগ্ন দেশসমূহেও এককালে অগ্নি উপাসক, প্রকৃতি উপাসকদের সংস্কৃতির সাথে মিশেছে ইসলাম।

আমরা কি প্রজন্মকে এই সত্য উপলব্ধি করতে প্রাণিত করেছি যে, ধর্মের এই যে নমনীয়তা বা ইলাস্টিসিটি তাই দেশ থেকে দেশান্তরে, সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে কালচার থেকে কালচারে দেশীয় মানুষের ঐতিহ্যের ভেতরে এক হয়ে থেকে গেছে। আজকের পৃথিবীতে এই আত্তীকরণ করার স্বভাবসম্পন্ন ইসলাম ধর্মই তো দেশে দেশে বাস করছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও প্রাচীন যাযাবর সংস্কৃতির সাথে তা মিলে মিশে আছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামের সংস্কৃতিই সারা বিশ্বের মানুষ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে এটা অবাস্তব একটা ধারণা। এ ধারনা ধর্মবিনাশী। ধর্মকে যুগে যুগে লোকে লোকে লোকসমাজকে বিকশিত, আনন্দিত ও সমৃদ্ধ করার কাজে না লাগিয়ে তাকে বিভেদ হানাহানির বিচ্ছিন্নতার উপাদানরূপে যারা কুৎসিত ঘৃণ্য রাজনীতির কাজে লাগাচ্ছে তারা ইসলামকে ধ্বংস করছে।

ধর্ম যখন মানুষকে দম ফেলার বা কথা বলার ফুরসত দেয় না তেমনই এক পরিস্থিতিতে ফরাসী বিপ্লবের মতো ঘটনা ঘটেছিল। জনতার হাতে তিনশোরও বেশি নান এবং যাজক নিহত হবার পর খ্রিস্ট ধর্মের ক্লারিকগণ শাসকদের সাথে একত্রে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন রাষ্ট্র থাকবে সেকুলার এবং ধর্ম হবে ব্যক্তিগত। সেই দুঃখজনক মানবিক বিপর্যয়ের পর খ্রিস্টীয় সমাজ পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে বিজ্ঞান ও শিল্প-কলার সাধনায়। বিগত দুইশ বছরে বিজ্ঞানে মানবজাতি যে স্থানে পৌঁছেছে তার আগে এর কণামাত্র তারা অর্জন করতে পারে নি।

মানবজাতির বেঁচে থাকার স্বার্থেই তাকে ধর্মের উদার ও সহনশীল ধারার প্রসারে আত্মনিয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্রকে হতে হবে সেকুলার কারণ তার কাজই হচ্ছে বস্তুবাদী বিষয় আশয় নিয়ে জনগণের সেবা করা। ব্যক্তিকে মুক্ত করে দিতে হবে বিশ্বাসের বাধ্যবাধকতা থেকে যেন সে তার সৃজনশীলতা ব্যয় করতে পারে মানবজাতির উন্নয়নে।

বলাই বাহুল্য, ইসলাম বিশ্বাসীরা যারা চরমপন্থি তারা এই কথাগুলো শুনলেও গালি দেন। কারণ তারা ভয়ে কণ্টকিত হয়ে ওঠেন এই ভেবে না জানি এসব যুক্তি কখন তাদের নিজের অজান্তে মাথায় ঢুকে পড়ে। যুক্তিবাদীদের ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্ত থাকতে হলে যুক্তিহীন অন্ধ ও বধির হয়ে যাওয়া বিশ্বাসীদের পক্ষে বেহেতর। অন্ধ যুক্তিহীন ও বধির হয়ে যাওয়ার পর্যায়গুলো এবং কখন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আপনার বুকের ধন খেয়াল করুন। পরিবারকে গণতান্ত্রিক করে তোলার বিকল্প কিন্তু নাই।

এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত