জাহানারা নুরী

০৭ আগস্ট, ২০১৬ ২৩:৩১

নিলয় নীল : জগতের আনন্দযজ্ঞ থেকে তোমরা যারা ছুটি নিয়েছ

নীল। ৭ আগস্ট ২০১৬। জগতের আনন্দযজ্ঞ থেকে গত বছরের এই দিনে তোমার তিরোধান হয়েছিল। তোমার আগে ও পরে এক এক করে তোমরা অনেকেই হঠাৎ অন্তর্হিত হয়েছো যেমন তমসাবৃত রাতে আকাশ থেকে আচমকা এক একটি নক্ষত্র ধূমকেতু হয়ে খসে পড়ে।

এশিয়ার দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের নীল সবুজের অবিমিশ্র রংয়ের খেলায় তরঙ্গায়িত জলের কোলে জন্মানো শ্যামল অরণ্য-শোভিত সবুজ তৃণভূমিতে যে তরুণরা  তোমরা জন্মেছিলে-ছিলে তোমরা রবিবাবুর সেই ’ক্ষ্যাপা’ যে সব কিছুকেই মাতিয়ে বেড়ায়, যে সব ভাঙার সাহস করে নতুন করে গড়বে বলে। পুরনো জগদ্দলকে প্রচণ্ড আঘাতে কাঁপিয়ে দিতে পারে যারা।

তুমি, তোমার প্রিয় অভিজিৎ, অনন্ত বিজয় তোমার সাথের আরো অগুনতি তরুণ-তোমরা এই তৃণভূমির স্বপ্নমঙ্গলের রচয়িতা হতে চেয়েছিলে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তোমরা যুক্তিহীন অন্ধত্বের সাথে লড়ে নদী ও বিল বাওর সায়র প্রান্তর লাল করে তুলেছো নিজের রক্তে। সমাজ যখন আড়ষ্ট, অনড় ও জগদ্দল তখন তোমরা সমাজটাকে ছুটিয়ে নিতে চেয়েছো দুরন্ত হাউইয়ের গতিতে।

তোমরা কি বুঝতে পেরেছিলে তোমাদের আদর  ও চপেটাঘাত সমপরিমাণে না পেলে এই সমাজ নড়তে শিখবে না? হয়তো বুঝতে পেরেছিলে। কিন্তু সমাজ কি বুঝতে পেরেছিল? সন্দেহ হয়। এ সমাজের বোঝার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ রয়ে যায়। সামনের কালে অন্ধকার যা ঘনিয়ে আসছে সেই আঁধারের সাথে লড়াইয়ে তোমরা যারা দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলে তোমাদের হাওয়া করে দেয়া হয়েছে। পাথর সমাজ। পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। নীল তোমাদের রক্ত তাই ঝরেছে ও ঝরছে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের বুকের মাঝ দিয়ে তরল ললিত চঞ্চল প্রাণস্রোতের মাঝে বয়ে যাচ্ছে লাল স্রোত।

নীল তোমরা তো জানতে এই আশ্চর্য রাষ্ট্র ও সমাজে অনেক অপকর্ম সিদ্ধ, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে যা শোভন তা নিষিদ্ধ। তরুণ তরুণীর প্রেম নিষিদ্ধ, ষাট বছরের বুড়োর ছয় বছরের শিশুর সাথে যৌনতা বিবাহমতে সিদ্ধ।মিথ ও কল্প-গল্পে-বিশ্বাসে পুণ্য, যুক্তি ও বুদ্ধির মুক্তির চর্চায় পাপ। বিজ্ঞান চর্চায় সুযোগ নেই। বেদুইনদের চিন্তায় ঠেকে আছে দক্ষিণ এশিয়ার তৃণভূমির নদ নদীর জলে বেঁচে থাকা বাঙালি সমাজের অগ্রগতি।তীব্র, ভয়ানক, প্লেগ রোগে অসুস্থ এ সমাজ; ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যার নাম। এর অসুস্থতা প্রতিদিন ঠেলে বেরিয়ে আসতে দেখি আমরা।

এই দেশটিতে দশ দিগন্ত উজালা প্রখর সূর্য, তথাপি দেশটি অন্ধকারে নিমজ্জিত। এখানে রাষ্ট্র নাগরিকের কোনও দায়িত্ব গ্রহণ করে না। অন্ধকারের ভেতর পথ করে সামনে সমস্ত বৈরিতা ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে নাগরিকের প্রাণ শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। তার পক্ষে খুব বড়ো কিছু আবিষ্কার, মানব জাতির বৃহৎ কোনো উপকার সাধনের সম্ভাবনা প্রতিনিয়ত কমিয়ে আনার জন্যে রাষ্ট্র তৎপর থাকে। কি দুঃখজনক যে এই রাষ্ট্রটি তোমরা বদলে দিতে চেয়েছিলে বলে তোমাদের প্রাণ দিতে হয়েছে কাপুরুষদের খাড়ায়।

রাষ্ট্রের বিপরীতে তোমরা তরুণ প্রজন্ম কতকিছুই না করতে চেয়েছো। কতো কাজ ছিল তোমাদের। তোমরা কি করতে চেয়েছো তা একটু খতিয়ে দেখলে উপলব্ধি হয় সমাজটাই ক্ষুদ্র হয়ে আছে। তার সন্তানরা তাতে ধরছে না। কিন্তু সমাজটাকে বৃহৎ, সম্প্রসারিত ও বিশাল হয়ে উঠতে কে সাহায্য করবে? যে এই কাজ করতে আসবে তাকে রাজনীতি বসিয়ে দেবে। তবুও প্রজন্ম তোমরা অদম্য। তোমাদের ভেতর সমাজের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সঞ্চিত আছে। আর আগ্নেয়গিরি অভ্যন্তরের মতো অগ্নিবাণবর্ষী। তার ভেতর থেকে মাঝে মাঝে উচ্ছ্রিত হচ্ছে উত্তপ্ত লাভা স্রোত, জ্বলন্ত পাথর ছাই গণগণে তাপ।গণজাগরণ মঞ্চকে দেখলে সেই তাপ অনুভূত হয়। তা কি অগ্ন্যুৎপাত; লাল না কি রক্তের লাল। লালের কি ধর্ম আছে? নেই। লাল রক্তের দায় কি আছে আমাদের?

সব রক্তের দায় নেই। তবে কল্পিত নীল রক্তের দায় নিয়ে আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার অনেকদূর পাড়ি দিতে পারে। বিদেশী অতিথিদের মুসলমানদের, আব্রাহমিক ধর্মে বিশ্বাসীদের রক্তের রং তার কাছে নীল, অভিজাত। ব্লগার ও লেখকদের, নাস্তিকদের রক্ত মূল্যহীন। রাষ্ট্র তা স্বীকার করে না। কোন রক্তের দায় কতটুকু তা রাষ্ট্র তার রাজনীতির মাপ অনুযায়ী ঠিক করে নিয়েছে। আজ আইজিপি যা বলেছেন তাতে বোঝা যাচ্ছে ব্লগার লেখকরা টেররিস্ট সমপর্যায়ের। তারা ধর্মের সমালোচনা করে ধর্মীয় টেররিজমকে বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশে ৫৭ ধারা বলবত আছে এবং তারই মাঝে সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (এথিস্ট সহ) ওপর চাপাতির আঘাত চলছে। এটা নিয়ে রাষ্ট্রের কোনও সুস্পষ্ট পদক্ষেপের কোনও ফল এখনও তেমন দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ধর্মগ্রন্থে হিংসা উসকে দেয়া বাক্য রয়েছে, এই কথা বলা টেররিজম। আজ রাষ্ট্র থেকে টেররিস্ট সবাই এক সুরে নীপিড়নমূলক ধর্মচর্চাকে ডিফেন্ড করতে নেমেছে। যেন তোমরা ওই কথা না বললে দেশে দেশে জিহাদের যে জোয়ার বইছে তা কখনো দেকা যেতো না। এই ধূর্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ন্যায্যতাহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা আছে বলেই অসমতা, বৈষম্য, তীব্র দারিদ্র্য, অসম উন্নয়ন, দুর্নীতি বলবত রয়েছে। সক্রিয় আছে রাজনৈতিক হত্যা থেকে পার পাইয়ে দিতে উদ্যোগী প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, সংগঠন।

২০১৫-তে সাতই আগস্ট নীল তোমাকে চাপাতির উপর্যুপরি আঘাতে, পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। জগতের আনন্দযজ্ঞ থেকে প্রাণময় তরুণদের পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেয়ার চেয়ে নিষ্ঠুরতম কাজ আর হতে পারে কি না তা কি এই রাষ্ট্র ভেবে দেখেছে? দেখে নি। বরং এই নৃশংস অপরাধের দায় অপমানকরভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তোমাদেরই ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ও আজও দিয়ে চলেছে। তারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এই অন্যায্য অন্যায় দর্শনকে, যে যদি তোমরা ধর্ম নিয়ে কথা না বলে থাকো তাহলেই রাষ্ট্র তার হত্যাকাণ্ডের দায় নেবে। রাষ্ট্র ঠিক করে দিচ্ছে কে কি লিখবে বা বলবে। তাসের রাষ্ট্রের কার্টুন প্রশাসন দায় অস্বীকার করে খুব সোজা সাপ্টা। গণমাধ্যমে যা খুশী তাই বলে। মসৃণভাবে এমন বীভৎস বাক্য উচ্চারণ করতে পারে যে রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্ক্ষলারক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান, সে রাষ্ট্র মানবিক রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক নয়, হতে পারে না।

একমাত্র ব্লগার ও লেখক হত্যাই আল কায়েদার মতে আসল জিহাদ। কারণ ধর্মে অবিশ্বাসীদের, ধর্ম নিয়ে সমালোচনাকারীদের হত্যা করার নির্দেশ রয়েছে। প্রতিটি আব্রাহমিক ধর্ম এই প্রশ্নে অভিন্ন অবস্থান নিয়ে থাকে। কিন্তু পৃথিবীতে অন্যান্য ধর্ম যখন সমালোচনাকে যুক্তি দিয়ে গ্রহণ করছে তখন ধর্ম সমূহের মধ্যে কনিষ্ঠতম ধর্ম  ইসলাম কেন অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি হিংসা, অবিশ্বাসীদের রক্তপাতের ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। একবিংশ শতকে এই মনোভাব পরিত্যাগ করাই যে শুভ সেই চেতনা পরিবর্তনের পথে কেন কথা না বলে তারা মানুষ হত্যায় নেমেছে সে প্রশ্ন কেউ করছে না করলে প্রশ্নের উত্তরও কেউ দিচ্ছে না। ধর্ম প্রচারক, ব্যাখ্যাদাতা, ধর্ম রাজনীতির প্রবক্তা ধর্ম দিয়ে দাসত্ব, হিংসা, হত্যা হানাহানি প্রচার করে যাবে, মানুষের মনে অন্য ধর্মের ও ধর্মহীনদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে যাবে আর তার প্রতিবাদ হবে না এমন সমাজ তো আমাদের ছিল না।

এই তো গতকালই হেফাজতে ইসলাম নামক এক ধর্মভিত্তিক দলের সেক্রেটারি বাবুনগরী বলেছে সন্ত্রাসী ও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। শৃঙ্ক্ষলারক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানের বক্তব্য ও বাবুনগরীর বক্তব্য একইসূত্রে গ্রথিত। নীল তোমাদের রক্তে হাত রাঙিয়ে হেফাজতীদের দলের দর্শনকেই সমর্থন দিয়েছেন পুলিশ প্রশাসন প্রধান।।পুলিশ প্রজাতন্ত্রের নাগরিকের বেতন ভাতা গ্রহণ করা কর্মচারী। পুলিশ বাহিনী প্রধান যতক্ষণ তার অফিসের পোশাক পরে আছেন, ডিউটিতে আছেন, এ ধরণের কোনও বক্তব্য প্রদান করা তার এখতিয়ার বহির্ভূত। কিন্তু তারা বলে যাচ্ছেন। নাগরিকের কথা বলার, দুর্নীতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদের, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অধিকারকে সর্বাংশে অস্বীকার করে একটি সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক সরকার কিভাবে দাবী করে এ এক পরম বিস্ময়।

নীল, তোমরা বলেছিলে রাষ্ট্র যখন ধর্মের সাপকে জড়িয়ে ধরে তখন তার বিষ এর শরীরকে জীর্ণ করে তোলে। জীর্ণ দেহ একসময় হজমযোগ্য হয়ে ওঠে। একটি একটি তার সন্তানকে হজম করে ফেলার পর রাষ্ট্র দেখে তার সারা শরীরে বিষের স্রোত অথৈ বিলের জল প্রবাহের মতো বহমান। সাপ অন্ধ। সাপ ক্ষমা করে না। জীর্ণ রাষ্ট্র শোষণে বিবর্ণ, ধর্মের অন্ধত্বে দীর্ণ, মুষ্টিমেয় খলের হাতে বন্দি এক মায়ের মতো দশা তার। আর তার নীলেরা হত।

কেন নীলদের কথা মনে করি। কারণ তারাই আচমকা ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বাংলাদেশের মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে; দ্যাখো এই দেশ- এ তোমার হাতে বানানো। এ তোমার স্বপ্ন, কল্পনা, চৈতন্যের গহনে থাকা জনপদ। এ তোমার আপন দায়। যখন মানুষ ব্রহ্মাণ্ড জয়ের স্বপ্নে বিভোর তখন এই ভূমিতে দৃষ্টি চলে না এমন ঘন কুয়াশায় একটি টিমটিমে বাতি জ্বালিয়ে পথ দেখাও তোমরা। তোমরাই বলো মানুষকে মিথচালিত বদ্ধ বিশ্বাসে পড়ে থাকলে স্বপ্নের দেশ রচনা সম্ভবে না।

প্রশ্নহীন, যুক্তিহীন, জ্ঞানহীন বিদ্যা চর্চার ফাঁক দিয়ে উগ্রবাদিতা তমসায় আবৃত হচ্ছে তোমাদেরই বয়সী একাংশের হাতে- যারা হিংসায় উন্মত্ত। নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বে যারা মেশিনের মতো চালিত সুযোগসন্ধানী সম্প্রদায়ের হাতে। তাদের মনটি গঠিত কোনও ঘাতক বাহিনীর চিন্তার ভাইরাস দ্বারা। তাদের মন ইমুনাইজড।

তোমরা চেয়েছিলে এই ভাইরাস নির্মূল করতে বিজ্ঞানের আলোয়। ভাষা থেকে বিজ্ঞান, চিন্তা ও দর্শন, জীবন-জীবিকা, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক চেতনার প্রতিটি স্তরে তোমরা চেয়েছিলে যুক্তির ছটায় উদ্ভাসিত করতে। যখন বিজয় দিবস, স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ, একুশে বাঙালির পথে চলার এক একটি মাইলস্টোন স্বার্থান্বেষী সুযোগসন্ধানীদের কাছে শুধুমাত্র জনতাকে তোয়াজ, তোষণে ও শোষণের হাতিয়ার মাত্র ছিল। তখন তোমরা এসব না ও মূল্যবোধজাত ইতিহাসের উপাদানের যথার্থ মূল্য দাবী করে রাজপথের আন্দোলনের অবিভাজ্য অনুষঙ্গ করে তুলেছিলে। এ চেতনাসমূহকে তোমরা করে তুলেছিলে বাঙালির ভেতর নতুন প্রাণ সঞ্চারের অন্যতম বাহন। যখন তোমাদের অগ্রজ রাষ্ট্রীয় সম্পদ দোহনে ব্যস্ত গোষ্ঠী অক্ষম পূর্ব পুরুষদের সম্পদ ও গৌরব গর্বের রোমন্থনে নিয়োজিত তখন তোমরা অধ্যাপক আহমদ শরীফের ভাষ্যে ‘স্বকালে ও স্ব-সামর্থ্যে –ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়’ বাঁচতে এই দেশকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াস নিয়েছিলে।

যে সমাজ ও রাষ্ট্র যুক্তির, চিন্তার, বুদ্ধিসঞ্জাত বিদ্যার মূল্য উপলব্ধি করে না সে সমাজকে তোমরা দিতে চেয়েছিলে মানববিদ্যার মতো অগ্রসর চেতনা। আর তোমাদের পথ ধরে গোটা প্রাগ্রসর প্রজন্ম ২০১৩ সালে সংগ্রামী সংকল্প গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। প্রণোদিত হয়- ধর্মের হোক বা রাষ্ট্রের-অন্যায়ের পীড়নের, অধিকার হরণের প্রতিবাদে, প্রতিকারে এবং প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে এবং সত্যকে। স্বদেশকে ও মানুষকে যে সব কর্মোদ্যোগের মাঝখানে রাখতে হয় সে চেতনায়। জাগত হয় এ বোধে যে মানবতার স্বার্থে, মানবিক গুণ বিকাশ জরুরী, জরুরী এই জ্ঞান অন্যকে জানাবার নিরলস চেষ্টা করে যাওয়া।

চার্বাক কৃণাদ থেকে মুজাফফর আহমেদ পর্যন্ত আজ পর্যন্ত কোনো নাস্তিকই সমাজ, পরিবেশ ও প্রতিবেশের কোনো ক্ষতি কখনও করেছেন বলে শোনা যায় নি। কিন্তু সমাজ তার প্রতিটি পশ্চাপদতার জন্য মানবতাবাদীদেরই দায়ী করেছে। সুতরাং আজ যা রাষ্ট্র প্রচার করে চলেছে তা নতুন কিছু নয়।

অগ্রগতির ভাবনা দন্দ্বসূত্রে, নানা উত্থান পতনের ভেতর দিয়েই চেতনায় চেহারা পাবে।  বিশেষ দেশে কালে, সমাজে ও রাষ্ট্রে আমাদের সমকালীন অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, শিক্ষাগত, নীতিগত ও চেতনাগত ঐক্য বিষয়ে আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক, ইত্যকার ভাবদ্বন্দ্ব চালু রাখা ও প্ররোচণাদান যৌক্তিক। দেশের মানুষের হাড়মাংস গুঁড়ো করে যে অর্থনীতি চলছে তার ওপর মতাদর্শগত রাজনীতির পাশাখেলা বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াই গণ মানুষের স্বার্থে জারি রাখার দায় এই যারা এখনও বেঁচে আছি, আমাদের সবার।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটি অখণ্ড সেকুলার সত্তার অঙ্গীকারে; যে সত্তার অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল এ দেশের সবাই। সেখানে হিন্দু মুসলিম, নাস্তিক আস্তিক ভেদ ছিল না। তোমরা জানো জনতা নয় সরকারগুলোই নীতিহীনতার মাধ্যমে সেই অভেদ আত্মাকে ক্রমে বিনষ্ট, বিভেদাত্মক পথে নিয়ে যেতে সক্রিয় ছিল। দেশের দুর্ভাগ্য ঘনীভূত দেখে তোমাদের বেদনা তোমাদের চিৎকারে বাধ্য করেছিল। তোমাদের বিবেকী কণ্ঠস্বরই বাংলার একমাত্র আশা।

আজকের তরুণ সমাজ যারা সামনে এগুতে চায় তাদের জন্য কি তোমাদের চাওয়া নীল? তাদের অগ্রগতি-চেতনায় চিন্তায় ও চৈতন্যে-নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র যুগে যুগে চলেছে, চলছে। তারা মূক ভীত। কিন্তু সবাই নয়। তোমার সাথীরা আজও অনড়।  
 
নীল, মানুষের পক্ষে জনগণের ঐক্যফ্রন্টে তোমাদের উপস্থিতি যতো ক্ষণস্থায়ীই হোক, জরুরী ছিল। কৃপাজীবি বুদ্ধিজীবীদের অনড় মূক অবস্থানের কালে তোমাদের কণ্ঠ সোচ্চার ও তোমাদের মশাল অনির্বাণ রাখার দায় আজ জীবিতদের। তোমাদের কোনও আক্ষেপ ছিল না। তোমরা জানতে এই হবে পরিণতি। কিন্তু আমরা যারা আছি এখনও আমরা তোমাদের হারিয়ে শুধু আক্ষেপ নিয়ে পথ চলি না, আমরা দুঃখভারাতুর হৃদয়ে সমাজের পশ্চাদগতিতে রুদ্ধশ্বাস। আমরা রাজনীতির কূটচালের সাক্ষী থাকি। ইতিহাসের মহাচলনের সাক্ষী থেকে কালের বহমানতার শামিল হই আমরা। আমাদের কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসছে ক্রমাগত, কিন্তু চেতনা শাণিত।

মানবকল্যাণে স্বদেশ ও স্বকালের মানুষদের বোধ-বুদ্ধি ও চেতনাসঞ্জাত পথে নিয়ে আসার প্রয়াসই আমাদের কাজ। ঘা খেয়ে আধমরা হয়ে থাকা দেশবাসীর বেদনা উপশমের পথে আজ তাদের পিছিয়ে থাকার পথের শত্রু চিহ্নিত। তাদের মুক্তির পথ প্রশস্ত করবে যারা তাদের কাজ কঠিন করার ব্যবস্থা পাকা হচ্ছে। মানুষের স্বাধীনতার দাবী থেকে সরে এসে আমরা আত্মবিক্রয় করিনি এখনও। তোমাদের আরাধ্য কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস তাই আমাদের কর্মের ও চিন্তার অবিভাজ্য প্রক্রিয়ার অংশ।

আশা রাখি তোমাদের সংগ্রামের পথে আরো অসংখ্য নানা প্রজন্ম প্রাণ আজ এগিয়ে আসবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত