সাব্বির খান

১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১৯:৪৮

বঙ্গের ঈদ : মানুষের উৎসব, কোনও গোষ্ঠীর নয়

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের ‘ঈদ’ যতটা ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসবের। ঈদেরর মাতম আঞ্চলিক ও বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে গড়ে তোলে অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদহীন এক সেতুবন্ধন। ধর্মীয় তত্ত্বে ঈদ অত্যন্ত পবিত্র। তবে বাংলাদেশে তা অত্যন্ত মধুর রসে সিক্ত একটি জাতীয় আনন্দোৎসব। এই উৎসবের সরল পথ ধরে একটা জাতি সমষ্টিগত ভাবে প্রাণশক্তি ফিরে পায়। বঙ্গাঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নির্ভেজাল যে অবকাঠামোগুলোকে বোঝানো হয়, ঈদোৎসব তাদের অন্যতম একটি, যা মানুষকে পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে বেঁধে দেয় এক শক্ত সৌহার্দ্যের বন্ধনে। বাঙালির জীবনদর্শনেও ঈদ নিঃসন্দেহে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক প্রায়োগিক বিধি, যা বিশ্বের অন্য মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে সুস্পষ্ট ভাবে আলাদা করে।

আধুনিক বাঙালি জীবনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘সমন্বয়বাদ’ বা অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার যে স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সহজ রাজনৈতিক অনুবাদ করেছিলেন বাঙালির জীবনদর্শনে। ঐতিহাসিক ভাবে ভারত উপমহাদেশের এই অঞ্চলের ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িক সমাজ জীবনেরই ইতিহাস। ‘ঈদ-পূজা’র মতো ধর্মীয় উৎসবগুলো ধর্মনির্বিশেষে প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে বাঙালিদের অসাম্প্রদায়িক হতে শিখিয়েছে ও উৎসাহিত করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেই উদার পরম্পরার লোকজ-সংস্কৃতি আজ বিভ্রান্তির বেড়াজালে ঘুরপাক খায় ক্ষমতালিপ্সু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির তাণ্ডবের কারণে, যা হাজার বছরের সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই নয়, চ্যালেঞ্জও করে একইসঙ্গে!

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলা ভাষাভাষীদের ঐকতানের মূল জায়গাটিই হচ্ছে তার হাজার বছরের গৌরবমাখা ইতিহাস ও সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তার লাভ করা ‘সুফিবাদ’, যা মানুষকে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছে, দীক্ষা দিয়েছে। ‘সুফিবাদ’ অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ ও সর্বজনীন ভালবাসা ও প্রেমদর্শনের যৌগিক এক জীবনদর্শন। ইসলামের মরমী মতবাদের অন্য নামই সুফিবাদ যা বাংলাদেশে ‘মারেফত’ নামে পরিচিত। সুফিবাদের উৎপত্তিস্থল আরবদেশে হলেও, পারস্য হয়ে উত্তর ভারতে এবং পরে বাংলায় এসে বিস্তার লাভ করলেও, বাঙালি সভ্যতার প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। অর্থাৎ, আরবের বিশুদ্ধ সুফিবাদও ভারতে ঢুকে তা শতভাগ বিশুদ্ধ থাকেনি। স্বভাবতই বাংলাদেশের সুফিবাদ ভারতসভ্যতারই অংশবিশেষ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, যা হাজার বছরের মানবিক এবং অসাম্প্রদায়িক রীতিকেই সমর্থন করে! সে অর্থে সুফিবাদ হচ্ছে আরবি ইসলামের কট্টর-মৌলবাদের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন প্রেমদর্শন-মিশ্রিত এক আদর্শজীবন, যা ইসলামের উদারনীতি ও মানবতাবাদী আদর্শকে উজ্জীবিত করে মানবকল্যাণের দিকে ধাবিত করে। এই সভ্যতা বাংলাদেশের আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির সহাবস্থানকে শুধু নির্বিঘ্নই করেনি, সেই সঙ্গে স্বীকৃতিও দিয়েছে মানবতাবাদের অসীম মূল্যবোধকে।

বাংলায় ঈদোৎসবের ইতিহাস কিছুটা ধোঁয়াটে। আমাদের এই অঞ্চলে ঠিক কবে থেকে ঈদ-উদযাপন শুরু হয়েছিল, কোনও ইতিহাসবিদ বা গবেষক তা কোথাও লিপিবদ্ধ করেননি। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে এলেও নামাজ-রোজা বা ঈদোৎসবের প্রচলন শুরু হয়েছিল তারও কিছু আগে থেকে। এ অঞ্চলটি মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার অনেক আগেই আরব থেকে পারস্য, শেষে ভারতের উত্তরাঞ্চল হয়ে বঙ্গদেশে সুফিবাদের বিস্তার লাভের কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল এবং ঈদোৎসবের সূচনাও যে সেই থেকে, তা বলার অবকাশ রাখে না। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আকর গ্রন্থ ‘বাহারাস্তাইন’ গ্রন্থের লেখক মির্জা নাথানের বর্ণনা থেকে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে রাজধানী ঢাকা প্রতিষ্ঠা লাভের পর ঢাকায় ঈদ-উদযাপনের কথা জানা যায়। ঢাকা শহরের ঈদ-উদযাপন এবং ঈদেরর আনন্দ শোভাযাত্রার বর্ণাঢ্য চিত্র ঢাকার জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বছর কয়েক আগে প্রকাশিত ঢাকার নওয়াবদের ডায়েরি থেকে জানা যায় যে, এক রবিবার বকরির ঈদেরর নামাজ শেষে নওয়াবের সঙ্গে বিনা খরচে অন্যান্যরাও ক্লাসিক থিয়েটার দেখার সুযোগ পেয়েছিল, যা নামাজ ও থিয়েটারের পাশাপাশি নওয়াব ও সাধারণের মাঝে অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থানেরই দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। ঈদোৎসব ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দ্বাদশ শতকে বঙ্গদেশে ইসলামের উপস্থিতি হলেও চার-পাঁচশো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে কট্টর পথে না গিয়ে সুফিবাদের মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক ধারায়ই যে ইসলামের চর্চা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকেও ঢাকাবাসী অনেক আনন্দঘন ঈদোৎসব পালন করত। সে সময় ঈদেরর দিন যে জমকালো বর্ণিল আনন্দমিছিল বের হত, তা আমাদের ছোটবেলায় কম-বেশি দেখেছি। প্রায় শত বছর পূর্বে আর্মানিটোলায়, ধুপখোলা, রমনা ময়দানে ঈদেরর দিন কত্থক নৃত্যের আয়োজন করা হত। কোথাও হিজড়া নাচের আয়োজনের কথাও শোনা যায়। ঘুড়ি ওড়ানো, বিভিন্ন খেলাধুলোর প্রতিযোগিতা বা গ্রামাঞ্চলে নৌকা বাইচের আয়োজন হতো। এই আয়োজনগুলোর নাম শুনলেই একটা ব্যাপার অবধারিত হয় যে, এই আনন্দযজ্ঞ শুধু মুসলমানদের নয়, একই সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণে যৌথ-আনন্দ উৎসবই ছিল। ধর্মীয় কোনও বিধিনিষেধই তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমার ছেলেবেলায় দেখেছি নারায়ণগঞ্জে অনেক হিন্দু পরিবারকে, তাঁদের বিভিন্ন পালাপর্বণের উৎসবে আমরা যখন অতিথি হতাম, নিজেদের কখনওই দূরসম্পর্কের মনে হয়নি। তখন মূলত শুধু ঈদ নয়, বিভিন্ন বড় পূজার জন্যও আমাদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো সমাধিক ভাবে। কোনও মুসলাম সুফিসাধকের মাজারে হিন্দুর যাওয়া, মুসলমানের পাশে দাঁড়িয়ে মানত বা প্রার্থনা করা ছিল এই দেশেরই একটি অতি সাধারণ চিত্র। গ্রামেগঞ্জে ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার নদীতে কলার ভেলায় রঙিন কাগজের ঘর বানিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসানো ছিল ‘হিন্দু-মুসলিম’ উভয় সম্প্রদায়ের জন্য আনন্দোৎসব। এ সব বাস্তবতা ছিল এ দেশেরই অতিসম্প্রতি ক্ষয়ে যাওয়া লালিত সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জল দৃষ্টান্তস্বরূপ।

একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সম্প্রদায় বোঝায়, যারা কিছু বিষয়ে একই ধরনের বিশ্বাস পোষণ করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়াও আরও অনেক সম্প্রদায় রয়েছে। বিশেষ কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চিন্তা বা চেতনা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের বিশ্বাস বা পালনীয় অবস্থানকে অস্বীকার বা অশ্রদ্ধা করলে, স্বীয়ধর্মকে প্রধান ভেবে অন্যের বিশ্বাসকে দমন করলে এবং অন্যকে কর্তৃত্বহীন করলে, তখন তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে এটা কোনও ধর্মের শিক্ষা নয়, বিশেষ করে বঙ্গদেশের সেই আদি-সুফিবাদের প্রচারিত মানবধর্ম তো নয়-ই! এটাকে গোষ্ঠীগত কিছু স্বার্থবাদী ভাবাদর্শ বলা যেতে পারে। এই ভাবাদর্শ মূলত ধর্মীয় রাজনৈতিক ধারারই একটি আদর্শ, যা সভ্যতাকে পশ্চাদপদ করতে বিরামহীন সচল থাকে। প্রয়াত শিখ লেখক খুশবন্ত সিংহ স্বর্ণমন্দির আক্রমণ ও শিখগুরু ভিন্দ্রানওয়ালে নিহত হওয়ার পরে রাগান্বিত হয়ে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে বলেছিলেন, “যে অ্যাকশন নৈতিক ভাবে সমর্থন করে না, তা রাজনৈতিক ভাবেও গৃহীত হতে পারে না।” মানবসভ্যতার আদিসংবিধান হচ্ছে তাঁর আদর্শ ও নীতি। তাতে ঘুণ ধরলে সে সভ্যতার ধ্বংস যে অনিবার্য তা বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশ ও সমাজে এই ধ্বংসের পদধ্বনি শোনা যায় প্রায়শ এবং খুবই সন্তর্পণে।

অধুনা বাংলাদেশে ঈদ-সহ বিভিন্ন ধর্মীয় আনন্দোৎসবে এক ধরনের পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্টতই চোখে পড়ে। মানুষের আর্থ-সামাজিক যে বৈষম্য, মূল্যবোধের যে অবক্ষয়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ছাড়াও ধর্মীয়-রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বাঙালির হাজার বছরের আনন্দোৎসবেও রোপণ করেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ। ধাবমান দেশ ও সমাজের প্রতিটা স্তরেই রেখে যাচ্ছে একধরনের পরিবর্তনের ধারাবাহিক ছাপ। আমাদের সামাজিক কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ইতিহাস, আমাদের ভাষা ও লোকজ-সংস্কৃতি কোনও উগ্রবাদী ধর্মবিশ্বাসকে সমর্থন দেয় না, কখনওই দেয়নি। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এ দেশ কখনওই তালিবান রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না।

মানবসভ্যতায় যা অনৈতিক, কোনও অর্থেই তা রাজনীতির অণুশীলিত নীতি হতে পারে না। ঈদ একটি উৎসবের নাম, একটি আনন্দের নাম। এটা মানুষের উৎসব, সমষ্টির আনন্দ। ঈদোৎসব বাংলার প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির অঙ্গের মতোই লালিত হয়েছে শত বছর ধরে। এটাকে কোনও গোষ্ঠীর কুক্ষিগত করণের অর্থই হবে বাঙালির শত বছরের সংস্কৃতির উপর আঘাত করার সামিল। এই অসভ্যতাকে রুখে দেওয়া বাঙালির শত বছরের লালিত সভ্যতার নৈতিক দায়িত্ব!

সাব্বির খান : কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[লেখাটি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাতেও প্রকাশিত]

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত