খলিলুর রহমান ফয়সাল

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১৬:০২

‘আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য মারা যাবো’

মৃত্যুর আগে মানুষ কি টের পায়? মিলি হয়তো টের পেয়েছিলো। লেখক হুমায়ূন আজাদের কবিতার প্রথম লাইনটি ছিলো তার শেষ ফেইসবুক স্ট্যাটাস-আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য মারা যাবো।

ছোট্ট ঘাসফুল, টলোমলো শিশিরবিন্দু, চৈত্রের বাতাসে উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ি নাকি এক ফোটা বৃষ্টি, কিসের নেশায় সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলো মিলি? এর উত্তর কেউ জানেনা। সামসুন্নাহার মিলি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ছাত্রী।

২০১১-১২ ভর্তি পরীক্ষায় সবাইকে পেছনে ফেলে মেধাতালিকার প্রথম হয়ে যায় মিলি। বড় স্বপ্ন ছিলো কৃষি বিজ্ঞানী হবে। অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষেই ডায়াবেটিস ধরা পরে। হাসপাতালে ভর্তি ছিলো অনেক দিন। মেধাবী ছাত্রীটির অই সেমিস্টারে ফলাফল খারাপ আসে। তবে হাল ছেড়ে দেয়না মিলি। চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে ৪ এর মধ্যে মিলির সিজিপিএ ছিলো ৩.৮৪৯।

অসুস্থ শরীর নিয়েই জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মেয়েটা। খাওয়া দাওয়া নিয়মমতো, সকাল বিকাল হাঁটাহাঁটি, ইনসুলিন-ঔষধ আরো কতকিছু!

সুস্থভাবে বাঁচার প্রচণ্ড ইচ্ছা যেন।

রবিবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে হুট করেই রক্ত বমি শুরু হলো। পাবনায় ভালো চিকিৎসা না পেয়ে ঢাকার বারডেমে ভর্তি করে তার পরিবার। সিকৃবিতে মিলি সেবাধর্মী সংগঠন “বাঁধন” এর সাথে যুক্ত ছিলো। লেডিস হলের মেয়েদেরকে রক্ত দিতে উৎসাহ দিতো। এখন কি না তারই রক্ত লাগবে। পুরনো সাংগঠনিক বন্ধুরা মিলির জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে আদা-জল খেয়ে নামলো। তবে শেষ রক্ষা হলো না। লাইফ সাপোর্টে যাবার আগেই তার দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সিকৃবির সামসুন্নাহার মিলি।

এদিকে মিলির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র ক্যাম্পাসে শোকের ছায়া নেমে আসে। কৃষি অনুষদ পঞ্চম ব্যাচের ছেলে-মেয়েরা তাঁদের সহপাঠীর মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলেই এ ঘটনায় মর্মাহত।

মিলির প্রিয় শিক্ষক কৃষিতত্ত্ব ও হাওর কৃষি বিভাগের প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম বলেন, “এ ঘটনা একেবারেই মেনে নেয়া যায় না। মেয়েটা অনেক সৎ ছিলো। মিথ্যের বেসাতি ভরা এ সমাজে প্রথম বর্ষেই বৃত্তির টাকা নিয়ে তাঁর সহজসরল স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। অসুস্থ শরীর নিয়েও কখনো পড়াশোনায় ফাঁকি দেয়নি আমাদের মিলি।”

মিলিকে নিয়ে কথা বলার দুমিনিটের মধ্যেই চুপ হয়ে যান ড. নজরুল। বাকরুদ্ধ এ শিক্ষকের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

পড়াশুনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সংগঠনেও যুক্ত ছিলো পাবনার বেড়া উপজেলার মেধাবী মেয়েটি। কথা কম বলতো তবে যার সাথে মিশতো প্রাণ খুলে মিশতো। একই সংগঠনের তোহিদুর রহমান তার অগ্রজ সম্পর্কে ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন, “যখন, যেখানে, যেভাবেই দেখা হোক না কেন, এক অকৃত্রিম আন্তরিকতার সাথে কথা বলতেন কিছুক্ষণ। পড়াশোনার ব্যাপারে আপন বোনের মতো খোঁজ খবর রাখতেন। সে হাসিমুখ আর পাবো কই?”

সম্প্রতি সিকৃবিতে কৃষিতে অনার্স শেষ করে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগে ভর্তি হয়েছিলো মিলি। তার বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।

এককণা জ্যোৎস্নার জন্য নাকি এক টুকরো মেঘের জন্য অথবা টাওয়ারের একুশ তলায় হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির পেছনে হারিয়ে গেলো মিলি?

যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।

  • খলিলুর রহমান ফয়সাল : কর্মকর্তা, জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি)।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত