স্বপন তালুকদার

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২২:১৯

এ সময়ে কেন এমন হত্যাকাণ্ড?

নতুন মডেলের মোটর সাইকেল কিনে না দেওয়ায়, মুগ্ধ নামের তরুণ বাবা-মাকে ঘরের মধ্য রেখে আগুণ লাগিয়ে দেয়। মা আংশিক পুড়ে বেঁচে গেলেও, বাবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান।

চট্টগ্রামের সুমিত তার মাকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে। বড় ভাই সোমনাথের অভিযোগ এইচএসসিতে খারাপ করায় মা সুমিতকে বকাঝকা করেন, তাই মাকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে সুমিত।

একই দিনে সাত বছরের শিশু কাব্যকে তার মা খুন করে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। জানা যায় তার মা নাকি মানসিক ভারসাম্যহীন।

গত বছর ৮ জুলাই সিলেটে রাজনকে এক দল পিশাচ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পৈশাচিকতার চরম সীমায় পৌঁছে খুন করে, যতটা সম্ভব কষ্ট দেওয়া যায় তা দিয়ে। কেউ সেদিন রাজনকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি। যে কজন এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরাও, ঐ নির্মম হত্যাকাণ্ড ভিডিও করে ফেইসবুকে আপলোড করে মজা লুটে!

এ রকম অসংখ্য ঘটনা আমরা প্রায় প্রতিদিন পড়ছি। এই যে ছেলে বাবাকে, মা ছেলেকে খুন করছে, এই সব ন্যক্কারজনক ঘটনা নতুন কোন ঘটনা নয়, তা ঘটছে। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক মধুরতম যা চিরন্তন। এই মধুরতম সম্পর্কের মাঝে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড, মানুষের মনের স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা ও স্নেহের বন্ধনকে কী প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল না!

একটি বা দুটি হলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। প্রায় প্রতিদিনই এমন অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা ঘটছে। আমরা কোথায় নিরাপত্তা খুঁজবো? যে কোন রাষ্ট্র ও জাতির জন্য কতটা লজ্জাজনক এবং দুর্ভাগ্যের তা ব্যাখ্যাতীত। আর কেনই বা এমন অসহনীয় মর্ম-পীড়াদায়ক পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে। আমাদের তরুণদের এমন অবক্ষয়ের দায় কী আমরা কোন ভাবে এড়াতে পারি? আর এ অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি।

আমরা যদি সাম্প্রতিক বছরগুলোর দিকে তাকাই শিশু হত্যা, নারী হত্যা, খুন ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রায় প্রতিদিন ঘটতে দেখছি। সন্তান সন্ত্রাসী হবে, বাবা-মাকে আগুনে পোড়াবে, জঙ্গিবাদে জড়াবে একি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, মূল্যবোধ? আমাদের কিশোর ও তরুণদের অবক্ষয়ের মূলে অনেক কারণ নিহিত রয়েছে।

আমি মনে করি, আমাদের পারিবারিক বন্ধনে শৈথিল্য অনেক বড় কারণ। পরিবারের সদস্যদের মাঝে যে কাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক গড়ে ওটার কথা, তা গড়ে তুলতে পারছি না আমরা অনেক ক্ষেত্রে। আমরা অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। পারিবারিকভাবে যে মূল্যবোধ গড়ে ওঠার কথা তা আজ প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। আর এই শৈথিল্যের আসল কারণ যৌথ পরিবারে ভাঙন।

আমি আমার ছেলেবেলার একটি ঘটনা বলি। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। জানুয়ারির প্রথম দিকের ঘটনা। শীতের কাপড় কেনার জন্য একদিন আমার কাকার কাছে টাকা চাইলাম। কাকা আমার কত টাকার দরকার এবং কি কিনতে চাই জানতে চাইলেন। তখন নতুন কালো রঙের জ্যাকেট বেরিয়েছে। খুব বেশি চলত। প্রায় সবার গায়েই এ জ্যাকেট দেখা যেত। এই জ্যাকেটে স্টাইল করে গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন আমার সমবয়সী ও সিনিয়রদের অনেকেই। আমি এই নতুন আসা জ্যাকেট কিনার কথাই কাকাকে জানালাম। কাকা শোনে অনেকটা অবাক হলেন। তখন তা আমি বুঝতে পারিনি। প্রথমে আমাকে এটা কিনতে না করলেন। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, আমার জ্যাকেটই চাই। কাকা আর কিছু না বলে পরের দিন সকালে আমাকে ডেকে নিয়ে জ্যাকেটের টাকা দিলে, তা জ্যাকেটের দামের চেয়ে তিনগুণ। আমি বললাম এত টাকা তো লাগবে না। কাকা বললেন, শোনো তোমার বাবারও শীতের কাপড়ের দরকার। তাই তোমার বাবার জন্যও একটা কিছু কিনে আনবে। সাথে সাথে বললেন তোমার জন্য তো জ্যাকেট আনবেই, তবে তোমার বাবার জন্য কি আনবে বলে ভাবছ? তোমার বাবা তো বয়স হয়েছে। তাই শীত নিশ্চয় তোমার চেয়ে একটু বেশি করবে। তোমার জ্যাকেটের চেয়ে নিশ্চয় ভারী কিছুর দরকার হবে। কারণ তোমার শীত নিবারণে যদি জ্যাকেট লাগে, তোমার বাবার চাদরে শীত নিবারণ তো সম্ভব নয়, তাই না? এ কথা শোনে আমার কান লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সেদিনের এই ঘটনা আমাকে পুরোই বদলে দেয়।

এরপর থেকে জ্যাকেট কিনা তো দুরের কথা জ্যাকেট পরিহিত কাউকে দেখলেই আমার লোকটাকে খুব বাজে লোক মনে হতো। এই যে পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষা তা কী ভুলার। সেদিন যদি আমার কাকার কাছ থেকে এই শিক্ষাটা না পেতাম, হয়তো আমার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পেত।

মুগ্ধ তার বাবাকে পুড়িয়ে মেরেছে, পাঁচ লাখ টাকার একটা মোটর সাইকেল থাকার পরও আরেকটা নতুন মডেলের সাইকেলের জন্য। অথচ মুগ্ধর যে বয়স, এই বয়সে এত দামী সাইকেলের দরকারি ছিল না। যদি মুগ্ধদের পরিবারে চাচা-চাচী, চাচাতো ভাই-বোন থাকত তাঁদের কথাও ভাবতে হত বা সবার জন্য এই উচ্চবিলাসী চাহিদা পূরণের কথা ভাবতে পারতেন না বা সম্ভব হতো না।

আমি যৌথ পরিবারের কথা বলছিলাম, যৌথ পরিবারে যেমন অসুবিধা আছে, তেমনি সুবিধাও আছে। শহরে কি গ্রামে আমাদের সন্তানরা অনেকটা খাঁচায় বন্দি জীবন যাপন করছে বাবা-মায়ের সামান্য সান্নিধ্য পেয়ে। বাবা-মা দুজনকেই বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে কাজে। সন্তানকে কাজের লোকের কাছে রেখে। তার উপর স্কুল কলেজের পর কোচিং আর প্রাইভেট টিউটরের কাছে। যে সামান্য অবসরটুকু পায়, তা ব্যয় করছে টিভিতে কার্টুন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ফেইসবুকে। বাবা-মা সারাদিন অফিস থেকে পরিশ্রম করে এসে সময় কোথায় সন্তানদের জন্য ব্যয় করার। যদি যৌথ পরিবারের থাকত, দাদা-দাদী, চাচা, ফুফুদের সান্নিধ্য পেত। আমরা যতই বাবা-মাকে সন্তানের সাথে বন্ধু সুলভ আচরণের কথা বলি না কেন, বাবা-মা কখনও চাচা-ফুফুর যে ভূমিকা তা রাখতে পারেন না।

পরিবারে প্রত্যেক সদস্যদেরই সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে আলাদা আলাদা ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য আমাদের সন্তানরা চাচা-ফুফু, দাদা-দাদীর আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত। এই টানাপোড়নের বয়সটায় যাঁদের পরম মমতা, প্রয়োজনীয় পরামর্শ তাদের দরকার তা তারা পাচ্ছে না। আমাদের তরুণ ও কিশোরদের চাহিদা পূরণে পরিবার তথা রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতা রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যর্থতা রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবস্থায়। আগেকার মতো পাড়া, বৃহত্তর আত্মীয়তার গণ্ডি, শিশু-কিশোর সংগঠন আর কার্যকর নেই। স্কুল কলেজের শিক্ষক, এলাকার বা সমাজের অভিভাবকরা ব্যক্তিগত কাজ ও ব্যস্ততায় তাদের কাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক গড়ে উঠতে পর্যাপ্ত সময় দেন না। অথচ এই সংবেদনশীল সময়টায় এদের প্রয়োজন হয় পরামর্শের এবং সঙ্গের। তার পরিবর্তে এদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল লাভের যান্ত্রিক মিশন পূরণে।

এখন আসা যাক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে। আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। পাসের হার ও জিপিএ ফাইভের যেন বন্যা বয়ে দিচ্ছে! প্রতিটি বিষয়ে আশি বা আশির বেশি নম্বর পাচ্ছে, তা ভাবা যায়! চাহিদা এবং যোগ্যতার চেয়ে বেশি পেয়ে যাওয়ার যে কুফল তা অস্বীকার করার জো নেই। যা ঘটলো মুগ্ধর বেলায়। যখন তাঁর সাইকেলেরই দরকার ছিল, তখনই সে পেয়ে গেল পাঁচ লাখ টাকার দামী মোটর সাইকেল। তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটছে। যাঁর জিপিএ ফাইভ পাওয়ার কথা নয়, সেও আজকাল জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে। অনেক জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তরা কাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ না হতে পেরে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। কেউ বা পারছে না কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে, কেউ বা পারছে না রেজাল্ট অনুযায়ী চাকুরী নিতে। ফলে ঘটছে সব দুর্ঘটনা। কেউ হচ্ছে সন্ত্রাসী, কেউ স্বার্থান্বেষীদের খপ্পরে পরে যোগ দিচ্ছে জঙ্গিবাদে।

যা বলছিলাম, বর্তমানে আমাদের শিক্ষায় শিক্ষক হবেন ছাত্রদের বন্ধুর মতো। বন্ধু সুলভ আচরণের মাধ্যমে আনন্দ ও খেলার চলে শিক্ষা দেন। দিতে হয়।মুখস্থ করার প্রয়োজন খুব একটা নেই বললেই চলে। আর লাগবেই বা কেন? প্রতিটি বিষয়ে নৈব্যিত্তিক প্রশ্ন ৫০-৬০টি। অবাক লাগে, মুখস্থ পাঠাভ্যাস যেখানে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের ভৌগলিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় এটি একটি অমূল্য ঐতিহ্য। যার মুখস্থ করার ক্ষমতা কম, সে পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তার জ্ঞানার্জনে ঘাটতি থেকে যাবে। পড়াশোনায় এমন কিছু বিষয় থাকে, তা মুখস্থ না করে উপায় নেই। যেমন বানান, বিজ্ঞানের তথ্য, গণিতের তথ্য ও ফর্মুলা ইত্যাদি। কথায় আছে, বেশি পড়লই বেশি জানা সম্ভব।

আমরা বাঙালি, বই পড়ায় আমাদের উদাসীনতার যথেষ্ট বদনাম রয়েছে। যদি কম পড়ে বেশি মার্কস পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তারা পড়বে কেন! তাও আবার পাঠ্যবইয়ের মতো বই! যাদের মেধা আছে, তারা মুখস্থ করতে করতে এক সময় অনুধাবন করতে পারবে বিষয়টি। অনুরূপ কিছু বুদ্ধি খাটিয়ে করারও যোগ্যতা অর্জিত হবে। প্রশ্ন হচ্ছে দশ বছর বা তারও আগে যাঁরা পড়ালেখা করেছেন, তাঁরা কি সৃজনশীল দক্ষতা অর্জন করেননি!

আমাদের ব্যর্থতা শুধু শিক্ষায় নয়, ব্যর্থতা রয়েছে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায়। শিশুর সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবে তরুণ প্রজন্ম অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঝে অনেকটা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে গড়ে উঠছে। আগের দিনে অনেক যৌথ পরিবারে সংস্কৃতিচর্চার হতো। উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের যুগে পারিবারিক আবহে সাংস্কৃতিক চর্চা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। যেখানে সন্তানের সাথে সময় দেওয়ার সময় নেই, সেখানে পারিবারিক আবহে সংস্কৃতিচর্চা কল্পনাতীত!

মানবের একটি অন্যতম গুণ হচ্ছে মানবিকতা। এই মানবিকতার ঘাটতি নিয়ে বেড়ে উঠছে, বর্তমান প্রজন্ম সঠিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবে। স্কুল-কলেজগুলোতে নেই ক্যাম্পাস, নেই পর্যাপ্ত খেলাধুলার স্থান ও বিনোদনের ব্যবস্থা। তাই শিক্ষার অংশ হিসেবে সংস্কৃতি চর্চাকে যুক্ত করা দরকার। একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে যদি চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত,নাটক-এসব বাধ্যতামূলক ভাবে যুক্ত করা যায় তবে শিশুকাল থেকেই মানবিক গুণে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা সম্ভব হতো। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সন্তান বড় হচ্ছে সংস্কৃতিচর্চাহীন পরিবেশে।

এই পরিবেশে যে শিশুর বিকাশ সে বড় হয়ে কী করবে?

অর্থ ক্ষমতা প্রতিপত্তির সংস্কৃতি মানবিক ও নৈতিক বিকাশের অন্তরায়। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ইতিহাসের চর্চার মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনায় ও দেশপ্রেমে তরুণ প্রজন্মকে সমৃদ্ধশালী হিসেবে গড়ে তুলতে সংস্কৃতি চর্চাই পারে আমাদের পথ দেখাতে।

স্বপন তালুকদার : শিক্ষক ও কলাম লেখক।

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত