সুজাত মনসুর

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২০:৩৮

জুয়েল-মুনির-তপন উত্তর প্রজন্মের শহীদ

২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮ সাল সিলেটের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সিলেটে একইদিনে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির হাতে শহীদ হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (জাসদ সমর্থিত)-তিন টগবগে তরুণ যারা আমার বিবেচনায় উত্তর প্রজন্মের তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কেননা, তাঁদের রক্তদানের বিনিময়েই যে সারাদেশে জামাত-শিবির-স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক মাত্রা যোগ হয় তারই ফলশ্রুতি আজকের বাংলাদেশ। তাঁদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যের যে বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছিল এবং তা পরবর্তীতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর থেকে তীব্রতর হয়ে মাত্র দু`বছরের মাথায় স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটায়। কিন্তু এরশাদ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয়তো তখনই ক্ষমতায় আসতে পারেনি, এসেছিল জামাত নিয়ন্ত্রিত বিএনপি। কিন্তু শেষ রক্ষা তাদের হয়নি, তাঁদেরকে পরাজিত হতে হয়েছে।

আজকে বাংলাদেশে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, রায় কার্যকর হয়েছে। জামাত-শিবিরের রাজনীতি আপাতত: নিষিদ্ধ না হলেও তারা কোণঠাসা, নির্বাচন করার অনুপযোগী। যদিও এখনও বিভিন্নভাবে নতুন করে জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান  জানান দেবার চেষ্টা করছে, অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। জনগণ তাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবে না। কেননা,  ইতিহাসের চাকা কখনোই পেছনে যায় না। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পূর্ব প্রজন্মের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে যেমন পাক-হানাদার বাহিনী আর জামাতি যুদ্ধাপরাধীদের পরাজিত করে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলাম তেমনি জুয়েল-মুনির-তপনদের রক্তের সিঁড়ি বেয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বে স্বাধীনতার চিহ্নিত পরাজিত শক্তি আর তাদের দোসরদের পরাজিত করে বিজয়ী হবই। এ যুদ্ধে ইতোমধ্যেই আরো যাদের নাম যুক্ত হয়েছে তাঁরাও উত্তরপূর্বের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যেমন-জগতজ্যোতি, নিলয়, অভিজিত, রাজিব, সেলিম-দেলোয়ার, দীপালী সাহা, শাহজাহান সিরাজ, রাজু প্রমুখেরা।

আমরা ইতিহাস বিস্মৃত কিংবা ইতিহাস বিকৃতিকারী জাতি বলে দুনিয়া জুড়ে বদনাম আছে অনেকেই তা বলে থাকেন। আমি তাঁদের সাথে দ্বি--মত পোষণ করি। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ হয়তো তাদের রাজনৈতিক কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থ বিবেচনায় ইতিহাস বিস্মৃত হতে পারে কিংবা ইতিহাস বিকৃতি ঘটাতে পারে সেজন্য পুরো জাতি দায়ী হতে পারে না। জাতি হিসেবে বাঙালি কখনোই অকৃতজ্ঞ কিংবা ইতিহাস বিস্মৃত বা বিকৃতিকারী নয়। তাঁরা যখনই সময়-সুযোগ পেয়েছে তখনই ঐ সব বিস্মৃতি আর বিকৃতিকারীকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে ইতিহাসকে স্ব-মহিমায় উজ্জীবিত করেছে। আবার কেউ কেউ আছেন বাস্তবতার কারণে কিংবা স্মৃতি বিভ্রাটের কারণে অনেক সময় অনেক বিষয়ই মনে করতে পারেন না কিংবা সময় পেরিয়ে গেলে মনে হয়, হায়! এদিনটি কেমন করে ভুলে গেলাম।

ধন্যবাদ সিলেটটুডে২৪.কম আর প্রতিবেদক জাকির জাহামজেদকে শহীদ জুয়েল-মুনির-তপন ও বাংলাদেশে জামাত-বিএনপি-স্বৈরাচার বিরোধী রাজনীতির অন্যতম মাইলফলক ২৪ সেপ্টেম্বরকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যে। প্রতিবেদনটিতে ঐদিনকার পূর্বাপর ঘটনাবলী অত্যন্ত আবেগ দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বিচারহীনতার বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমিও আবেগময় প্রতিবেদনের মর্মার্থের সাথে শতভাগে একমত। বিষয়টির সাথে আমাদের অনেক আবেগই জড়িয়ে আছে। আছে স্বজন হারানোর আবেগ, বন্ধু হারানোর আবেগ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে উঠার আবেগ। আর বিচারহীনতার যে রাজনীতি তা অনেক পুরনো। তা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট জাতিরজনকে হত্যা এবং তৎপরবর্তী বিএনপি-জামাত-স্বৈরাচারী সরকারগুলো তাঁর বিচার না করা। শুধু কি তাই জেলহত্যা, প্রহসনের বিচারের নামে কর্নেল তাহেরকে হত্যার বিচার না হওয়া। আর তা যদি হয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সেগুলোর বিচার খুব কমই হয়ে থাকে। কেননা, সাক্ষী পাওয়া যায় না। কোন ধরনের আলামত সংরক্ষিত থাকে না। এ বিষয়গুলোও প্রতিবেদনে বিচার না হবার অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

এবার আসি প্রতিবেদনের কিছু দ্বি-মতের জায়গায়। না, দ্বি-মতও বলা যাবে না। যা বলা যাবে তাহলো কিছু সংযোজন এবং কিছুটা তথ্য বিভ্রান্তি দূরীকরণ। প্রথমত: শিরোনামটি যদি হতো এরকম, `তিন তরুণকে হত্যা মাধ্যমে জামাত-শিবির সিলেটে তাদের অবস্থান মজবুত বা সংহত করে` তাহলেই সঠিক হতো বলে মনে করি। কেননা, সিলেটে জামাত-শিবিরের উত্থান অনেক আগেই হয়েছিল। এমসি কলেজ ছাড়া সব কলেজেই তারা সরবে বিরাজমান ছিল। শুধুমাত্র ঐ সময় পর্যন্ত তারা সিলেট সরকারী কলেজে(বর্তমান এমসি কলেজ) তলে তলে সংগঠিত হলেও প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাতে পারতো না। তার অন্যতম কারণ হলো এমসি কলেজের পার্শ্ববর্তী এলাকা টিলাগড় কিংবা মেজরটিলায় আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান।

টিলাগড়ের সালাম ভাই, মানিক ভাই, সাজু হামিদ-কুটুরা সব সময়ই আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। যেদিন এমসি কলেজে শিবিরের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয় সেদিনও কিন্তু যার যা ছিল তাই নিয়ে টিলাগড়বাসী আমাদের পাশে অবস্থান নিয়েছিল। নতুবা জুয়েল-মুনির-তপন শহীদ হবার আগে আমরাই হয়তো শহীদ হতাম সংখ্যায় অনেক। এছাড়া এমসি কলেজে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠনগুলো বরাবরই ছাত্রশিবিরের সাথে সহবস্থান করে রাজনীতি করার পক্ষপাতি ছিল না, মেনেও নিতে পারেনি। যদিও আমাদের মাঝেও জামাত-শিবিরের প্রতি সহানুভূতিশীল দালালের সংখ্যা একেবারেই কম ছিল না। যারা পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দেয়। তাই বলা যায় আমরা সংগঠিতভাবে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি বলে এবং প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা থাকার কারণে ঐদিনের ঘটনার পর জামাত-শিবির উত্থান নয় অবস্থান সংহত করেছে। তাঁদের উত্তান মূলত: শুরু হয় সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর তাফসির মাহফিলের মাধ্যমে। সেদিন যদি সাঈদীর লাগাম টেনে ধরা যেত তাহলে হয়তো সিলেট কেন সারাদেশেই জামাত-শিবিরের উত্থান ও বিস্তার ঘটতো না।

এবার দৃষ্টি দেয়া যাক প্রতিবেদনটির কিছুটা কিন্তু মারাত্মক তথ্য বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে। প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আমার প্রশ্নটা হলো তিনি বা যিনি উনাকে তথ্য সরবরাহ করেছেন তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে (যাদেরকে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ মুজিববাদী ছাত্রলীগ বলে চিহ্নিত করে) তারা কি বামধারার রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করেছেন?  ছাত্রলীগকে যদি বামধারার ছাত্র সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তা হলে বুঝতে হবে বামধারার রাজনীতির সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে।

প্রতিবেদক আরেকটি মারাত্মক তথ্য বিভ্রান্তি ঘটিয়েছেন, তাহলো- ১৯ বা ২০ তারিখে ছাত্রলীগকে এমসি কলেজের ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা দেয় বলে। এ তথ্যটিও সঠিক নয়। কেননা আমি এই ঘটনার সাথে পুরোপুরি জড়িত ছিলাম এবং মূলত: বলা যায় আমি এবং জাসদ ছাত্রলীগের শাহজাহান(বর্তমানে আমার মতো বিলেত প্রবাসী) ওদেরকে প্রথম বাঁধা দেই। শাহজাহান সম্ভবত তখন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আমি জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক কিংবা সাধারণ সম্পাদক। দুজনই এমসি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত। ছাত্র শিবির সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা এমসি কলেজে প্রকাশ্য সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারতো না। কিন্তু তাদের গোপন তৎপরতা অব্যাহত ছিল।

ঐদিন আমি কলাভবনের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় লক্ষ্য করি কলাভবনের একটি কক্ষে শিবির কর্মীসভা করছে এবং নুরুজ্জামান নামক এক ছাত্রশিবির নেতা বক্তৃতা করছে। দেখেই আমার রক্ত মাথায় উঠে যায়। তাৎক্ষণিক শাহজাহানকে ডেকে আনি এবং তাকে বিষয়টি অবহিত করি। শাহজাহান আমাকে প্রথমে প্রতিবাদ না করতে নিষেধ করে, কেননা সে হয়তো বুঝতে পেরেছিল ওরা প্রস্তুত হয়েই এসেছে এবং আমাদের কোন প্রস্তুতি ছিল। সুতরাং সামলাতে পারব না। শাহজাহানের আশংকাই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়। আমি নাছোড়বান্দা তাই শাহজাহানও আমার সঙ্গী হয় এবং আমরা সম্মিলিতভাবে গিয়ে তাদেরকে বাধা দেবার চেষ্টা করি। কিন্তু আগে থেকেই প্রস্তুত থাকার কারণে আমাদেরকে ধাওয়া করে।

আমরা দৌড়ে রসায়ন বিল্ডিং-এর বারান্দায় চলে আসি। ইতোমধ্যে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীরাও আমাদের সাথে যুক্ত হয়। শিবিরের দেলোয়ার কলাভবনের সামনে থেকে আমার আর শাহজাহানের দিকে শটগান তাক করে। আমরা শেষ পর্যন্ত কলেজ ক্যাম্পাসে টিকতে না পেরে টিলাগড় পয়েন্টে এসে অবস্থান নেই। আমাদের সাথে বরাবরের মতোই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এসে যোগ দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ প্রহরায় তারা হোস্টেলের সামনে দিয়ে ঈদগাহ হয়ে আলিয়া মাদ্রাসাতে তাদের ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ আরো সংঘর্ষ এড়াতে কয়েকদিনের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে।

এরপরের ঘটনা সবারই জানা। প্রতিবেদনটিতেও সেটা বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি পড়ে আমার মনে হয়েছে প্রতিবেদক খুব তাড়াহুড়া করে হয়তো তা করেছেন। তিনি যদি ঐ সময় যারা জামাত-শিবির বিরোধী এই সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন যেমন ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি তাপস ভট্টাচার্য, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইখতিয়ার উদ্দিন, ছাত্রলীগের বিজিত চৌধুরী, বর্তমানে সিলেট বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের শামীম, বাসদ ছাত্রলীগের কোন নেতার সাথে যোগাযোগ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করতেন তাহলে বিভ্রান্তি সুযোগ ছিল না।

তিনি মূলত: জাকির ভাইর বক্তব্যের ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বলেই মনে হয়েছে। তারপরও প্রতিবেদক ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ তারা অন্তত: চেষ্টা করেছেন ঐ সময়ের ভয়াবহ চিত্রটি তুলে ধরতে।

আর যারা প্রতিবছর দিনটিকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস হিসেবে পালন করেন তাদের প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা আর রক্তিম শুভেচ্ছা। পূর্ব-প্রজন্মের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত যেমন বৃথা যায়নি তেমনি উত্তর-প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তও বৃথা যাবে না। আমরা বিজয়ী হবই। আর অন্ধকারের নারকীয় কীটেরা পরাজিত হতে বাধ্য। কেননা পৃথিবীটা সৃষ্টি হয়েছে মানবের জন্য, দানবের জন্য নয়।

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত