আহমেদ নূর

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২২:৪৪

বাংলা সাহিত্যের গণনায়ককে প্রণত শ্রদ্ধা

চলে গেলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। চিকিৎসকরা তাঁকে সময় দিয়েছিলেন বাঁচবেন আর মাত্র ছয় মাস। তিনি ফিরে এসেছিলেন প্রিয় জন্মভূমিতে। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ‘পরানের গহীন ভিতর’ বলেছিলেন, লিখবেন নাটক ‘শেষ যোদ্ধা’। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।

এই বৈশাখের শুরুতেই দুঃসংবাদটি পেয়েছিলাম-‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’র কবি সৈয়দ শামসুল হক কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলেও চিকিৎসকরা আশার বাণী শোনাতে পারেনি। ‘হৃৎকলমের টানে’ জীবনের বেঁধে দেওয়া সময় কাটাতে দেশে চলে এলেন। কিন্তু মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ‘একমুঠো জন্মভূমি’র ‘বুকঝিম ভালোবাসা’ ত্যাগ করে তিনি চলেই গেলেন।

আমি সব সময়ই সৈয়দ শামসুল হকের লেখার মুগ্ধ পাঠক। তাঁর গল্প, কবিতা, উপন্যাস যতই পড়েছি একধরণের ঘোর অনুভব করেছি সবসময়। শুধু ভেবেছি, এমন হৃদয়ছোঁয়া লেখা কি করে সম্ভব? বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো বিরলপ্রজ লেখকের প্রস্থানে শুধু আমি নয়, এদেশের সাহিত্যপ্রিয় সবাই শোকে কাতর হবেন এটা স্বাভাবিক।

সব্যসাচী এই লেখক সিলেটে শেষবারের মতো এসেছিলেন ২০১৫ সালের ১ মে। আমার প্রথম গ্রন্থ ওয়ান-ইলেভেন: কারারুদ্ধ দিনগুলোর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। স্বভাবতই তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। পুরো একটি দিন তাঁর সাথে কাটিয়ে ছিলাম। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি সহজেই মানুষকে আপন করে কাছে টেনে নিতে পারতেন। আমার মতো একজন নগন্য সংবাদকর্মীর গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তাঁর মতো বড় মাপের একজন লেখকের উপস্থিতি আমার জন্য ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু তিনি সানন্দেই এসেছিলেন। এটাই সৈয়দ শামসুল হকের জীবন-দর্শন।

সিলেটে সেদিন দীর্ঘ সময় আমরা একসাথে কাটিয়েছি। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি বইটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেটি আমার জীবনের বড় পাওয়া। পরবর্তী সময়ে তিনি আমার বইটি সম্পর্কে মূল্যায়নধর্মী কিছু কথা লিখে দিয়েছিলেন। যা পরে আমার বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে ফ্ল্যাপে যুক্ত করি। সম্ভবত কোনো বইয়ের ফ্ল্যাপের জন্য এটাই ছিল তাঁর শেষ লেখা। সেদিন অনুষ্ঠান শেষে রাতে প্রায় তিনঘণ্টা আমরা একসাথে ছিলাম। তিনি খুটিয়ে খুটিয়ে আমার সম্পর্কে জেনেছেন। সিলেটের মানুষ এবং শাহজালাল (র.) এর মাজারের প্রতি তাঁর অন্যরকম আবেগের কথাও অকপটে বলেছিলেন। যে কারণে সিলেটে আসার আগেই জানিয়েছিলেন, শাহজালালের মাজারের পাশেই যেন কোনো একটা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করি। আমি তাই করেছিলাম। যদিও আমি চাইছিলাম তিনি সার্কিট হাউসেই থাকুন। আমি সেদিন দেখেছি রাতে এবং পরদিন সকালে তিনি মাজারে দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন।

সিলেট থেকে ফিরে যাবার পর মাঝেমধ্যে তাঁর সাথে কথা হতো এবং বিশেষ দিবসে মোবাইল খুদে বার্তা আদান-প্রদান হতো। মনে পড়ে, সর্বশেষ তাঁর আশিতম জন্মদিনে অভিনন্দন জানিয়ে একটি খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলাম। একদিন পর তিনি এর প্রত্যুত্তরও দিয়েছিলেন। সিলেট থেকে ফিরে যাবার সময় হক ভাই তাঁর প্রণীত জীবন গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠায় আমাকে একটি অটোগ্রাফ দিয়ে গিয়েছিলেন। তাতে ‘সাহসী সাংবাদিক এবং আত্মকথনের উজ্জ্বল একটি বইয়ের লেখক আহমেদ নূরকে প্রীতিসহ’ লিখে স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন। সৈয়দ শামসুল হকের মতো একজন লেখকের কাছ থেকে এমন শংসাবচন আমার জীবনে অনন্য হয়ে থাকবে।   

আর ছয় মাস বাঁচবেন সব্যসাচী লেখক-এই নিয়তি তো আমরা মেনে নিয়েছিলাম। তাই বলে এত দ্রুত!  মাত্র এক মাসের মধ্যেই চলে যাওয়া? তাঁর এই আকস্মিক চলে যাওয়ার শূণ্যতা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। তবে চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়। তাঁর সৃষ্টি দিয়েই যুগ যুগ ধরে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন বাংলা সাহিত্যের এই ‘গণনায়ক’।

হক ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন।
আপনার প্রতি আমাদের সকলের প্রণত শ্রদ্ধা।     

আহমেদ নূর : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত