আব্দুল করিম কিম

২৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০১:৫০

নির্বাচন আসছে, নানান খেলা চলবে...

শমসের মবিন চৌধুরী বিকল্পধারায় যোগদান করা বেশ কৌতূহলের। মামলা মোকদ্দমায় ক্লান্ত শমসের মবিন ২০১৩ এর নির্বাচনের পর রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণার পর থেকে রাজনীতির মাঠে তাঁর উপস্থিতি নেই। কোন আলোচনায় তিনি নেই। সেই ব্যক্তি আজ বিকল্পধারায় যোগ দিয়ে রাজনীতিতে ফিরলেন। কোন কারণে তাঁর এই ফিরে আসা?

তাঁর ভূতপূর্ব দলের দুই কাণ্ডারি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বা ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, এদের কারো সাথেই কোন সমস্যা থাকার কথা কখনো শোনা যায়নি। বরং শোনা গেছে, মামলা-মোকদ্দমা ও কারাবন্দিত্বের ভয়ে চৌধুরী সাহেব রাজনীতির মাঠ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের পরাজিত প্রার্থী সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সড়ক দুর্ঘটনায় আকস্মিক মৃত্যু হলে, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী শূন্যস্থান পূরণে সিলেট-১ আসনে হোমওয়ার্ক করে যাচ্ছিলেন । দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বের চার দলীয় জোটের প্রায় প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল শমসের মবিন চৌধুরীর।

কিন্তু সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করে, হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে সহিংস আন্দোলন শুরু করলে লাগাতার মামলার দায় চারদলীয় জোটের ঘাড়ে বর্তায়। একের পর এক নেতারা সহিংসতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে কোণঠাসা বিএনপি'র এই নেতা নীরব হতে থাকেন। আকস্মিকভাবে একদিন রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। সেই থেকে তিনি একেবারেই রাজনীতির অঙ্গন থেকে লাপাত্তা হয়ে যান।

তাঁর এই শূন্যস্থান পূরণ করতে ২০১৩ সালের পর থেকে সিলেট-১ আসনের সম্ভাব্য বিএনপি প্রার্থী হিসাবে মাঠ চষতে থাকেন বিএনপি চেয়ারপারসনের অনেক উপদেষ্টার অন্যতম খন্দকার মোক্তাদির । যিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে জয় পাওয়া সাংসদ খন্দকার আব্দুল মালিক-এর পুত্র । সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে একমাত্র ঐ আসনেই বিএনপি জয় লাভ করে । জামায়াতের সমর্থন নিয়ে পরবর্তীতে বিএনপি সরকার গঠন করে । ২০১৩ সালের পর থেকে খন্দকার মোক্তাদির সিলেট-১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে নিজেকে প্রচার করে গেলেও ২৪ অক্টোবরের জাতীয় ঐক্যজোটের সমাবেশে তাঁকে নিষ্প্রভ দেখা গেছে। যদিও সমাবেশ শেষে তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলের বর্তমান সাংসদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ করে ঘোষণা দেন ভবিষ্যতে নির্বাচন না করার। তিনি ঘটা করে স্বীয় অনুজ সাবেক কূটনীতিক আব্দুল মোমেনকে সিলেট-১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তীতে সিলেটে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে আব্দুল মোমেন অংশ নিতে থাকেন। নগরজুড়ে বিশাল সব বিলবোর্ডে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে প্রচারণা করতে থাকেন। বিভিন্ন নির্বাচনী প্রকল্পে মোমেন সাহেব দলীয় পদ-পদবি না থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বের সাথে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে থাকেন। এ অবস্থায় জাতীয় রাজনীতিতে হয় নতুন মেরুকরণ।

ড. কামাল হোসেন-এর নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যজোটের সৃষ্টি হয় এবং সিলেটে ২৪ অক্টোবর ঐতিহাসিক রেজিস্টারি মাঠে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জনসভা। যা রাজনীতির চলমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে দেয়। বাতাসে গুঞ্জন ওঠে জাতীয় ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে সিলেট-১ আসনে নির্বাচন করছেন ডাকসুর সাবেক সহ-সভাপতি আওয়ামী লীগের সংস্কারবাদী সাবেক নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর।

দীর্ঘ একযুগ রাজনীতি থেকে নির্বাসিত সাবেক ছাত্রনেতা সুলতান মনসুর ১/১১-এর সরকারের সময়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা'র দুঃসময়ে অবিশ্বস্ত আচরণের অভিযোগে অভিযুক্ত। দলে ফেরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছিলেন। বর্তমান সরকার বিরোধী জাতীয় ঐক্যজোট গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আবার পাদপ্রদীপের আলোয় ফিরে আসেন। এক যুগ পর সিলেটে প্রকাশ্য জনসভায় সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। যদিও দীর্ঘদেহী সুদর্শন সুলতান মনসুর মুজিব কোট গায়ে দিয়েই বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যের শেষে হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীর সম্মুখে বক্তৃতার শেষে উচ্চারণ করেন 'জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে যোগ দেয়া জনতা করতালি দিয়েই এই উচ্চারণকে স্বাগত জানায়।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সদ্যবিজয়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐক্যজোটের প্রথম সমাবেশে একাদশ সংসদ নির্বাচন বয়কটের সম্ভাবনা নেই স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়া হয়। এ অবস্থায় সিলেট-১ আসনে জাতীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী যে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর হচ্ছেন, তা ধরে নেয়া হয়েছে।

এক যুগ পর সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এই ফিরে আসা নিয়ে সিলেট'সহ দেশের রাজনীতিতে নানান আলোচনার জন্ম দিয়েছে । সিলেট-১ আসনে সুলতান মনসুরের প্রার্থিতা ক্ষমতাসীন মহলে দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে।

শুক্রবার সিলেট সদর উপজেলার খেলার মাঠে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, মুহিত সাহেব ইতোমধ্যে ১২টি জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন। আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় গেলে আরেকটি বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে মুহিত সাহেব রেকর্ড সৃষ্টি করবেন।

অর্থমন্ত্রী নির্বাচন না করার কথা একাধিকবার বলার পরেও জাতীয় ঐক্যজোটের বিষয়ে বৃহস্পতিবার সিলেট সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেন, 'বিএনপি আছে বলেই ঐক্যফ্রন্ট দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জিতবে।' একই সাথে সুলতান মনসুরের সিলেট রেজিস্ট্রারি মাঠে দেয়া বক্তব্যের সূত্র ধরেই অর্থমন্ত্রী স্বভাবসুলভ ভাবে উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ঐক্যফ্রন্টের নেতার মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'স্বপ্নের দেশ গড়তে' চাওয়ার প্রত্যাশা 'হিপোক্রেসি'।

এ অবস্থায় ২৪ অক্টোবর খন্দকার মোক্তাদিরের অকারণ গ্রেপ্তার, শমসের মবিন-এর রাজনীতিতে ফিরে আসা ও বিকল্পধারায় যোগদান এবং সিলেটে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের অর্থমন্ত্রীর পুনরায় বাজেট প্রদানের প্রত্যাশা সিলেট-১ আসন কেন্দ্রিক লড়াইয়ের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলছে।

রাজনীতির নানান হিসেব নিকেশ মেলানোর চেষ্টা সবে তো শুরু। নির্বাচন আসছে, নানান খেলা চলবে। সিলেট-১ আসন কেউ হারাতে চায় না। আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এ ধারনা বদ্ধমূল হয়েই গেছে যে, সিলেট-১ যার, সরকার হবে তার।

  • আব্দুল করিম কিম: সংগঠক, পরিবেশকর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত