ড. মো. নায়ীম আলীমুল হায়দার

২৬ নভেম্বর, ২০১৮ ২১:৪১

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন

চলচ্চিত্র এক প্রকারের দৃশ্যমান বিনোদন মাধ্যম। চলমান চিত্র তথা "মোশন পিকচার" থেকে চলচ্চিত্র শব্দটি এসেছে। এটি একটি বিশেষ শিল্প মাধ্যম। বাস্তব জগতের চলমান ছবি ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করে বা এনিমেশনের মাধ্যমে কাল্পনিক জগত তৈরি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়।

চলচ্চিত্রের ধারণা এসেছে ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে। আর এনিমেশন চিত্রের ধারণা এসেছে আরও পরে। বাংলায় চলচ্চিত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে ছায়াছবি, সিনেমা, মুভি বা ফিল্ম শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। চলচ্চিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ। যে সংস্কৃতিতে তা নির্মিত হয় তাকেই প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্র। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে চলচ্চিত্রের। ছায়াছবির সাথে ভিজুয়াল বিশ্বের সমন্বয় থাকায় সাধারণ মানুষের সাথে সবচেয়ে ভাল যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। অন্য কোন শিল্পমাধ্যম সাধারণের সাথে এতোটা যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম নয়। অন্য ভাষার চলচ্চিত্রের ডাবিং বা সাবটাইটেল করার মাধ্যমে নিজ ভাষায় নিয়ে আসার প্রচলন রয়েছে।

চলচ্চিত্র মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটি মাধ্যমও বটে এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ এ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সিনেমাটোগ্রাফ আইন, ১৯১৮ এবং সেন্সরশিপ অব ফিল্ম আইন ১৯৬৩ বিদ্যমান রয়েছে চলচ্চিত্র সম্পর্কিত আইন হিসেবে। যদি কোন চলচ্চিত্রে কপিরাইট সম্পর্কিত কোন বিষয় থাকে তাহলে কপিরাইট আইন ২০০০ ব্যবহার করা যেতে পারে। মেধাস্বত্ব বা কপিরাইট (Copyright) হল কোন একটি বিশেষ ধারণার প্রকাশ বা তথ্য ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণকারী বিশেষ কিছু অধিকারের সমষ্টিগত নাম হলো মেধাসত্ত্ব। এটি একটি আইনি ধারণা। সাধারণত কোন দেশের সরকার এই ধারণাটির বাস্তবায়ন করে।

কপিরাইট বলতে কোন কাজের মূল সৃষ্টিকর্তার সেই কাজটির উপর একক, অনন্য অধিকারকে বোঝানো হয়। কপিরাইট সাধারণত একটি সীমিত মেয়াদের জন্য কার্যকর হয়। ঐ মেয়াদের পর কাজটি পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্গত হয়ে যায়।
সৃষ্টিশীল, বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা শিল্পের বিভিন্ন প্রকার কাজের একটা বিরাট পরিব্যাপ্তিতে মেধাস্বত্ব থাকতে পারে বা হওয়া সম্ভব। কবিতা, থিসিস, নাটক এবং অন্যান্য সাহিত্যকর্ম, চলচ্চিত্র, কোরিওগ্রাফির কাজ (নাচ, ব্যালে ইত্যাদি), মিউজিকাল কম্পোজিশন, অডিও রেকর্ডিং, চিত্র বা পেইন্টিংস, আঁকা বা ড্রইং, স্কাল্পচার বা মূর্তি/প্রতিকৃতি বানানোর শিল্প, ফটোগ্রাফ, সফটওয়্যার, রেডিও ও টেলিভিশনের সরাসরি ও অন্যান্য সম্প্রচার, এবং কিছু কিছু এখতিয়ারে শিল্প-নকশা (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন) এর অন্তর্গত।

আমরা যদি একটু চিন্তা করি তাহলে দেখব যে, চলচ্চিত্রের পুরো বিষয়টি কপিরাইটের সাথে খুবই সম্পর্কযুক্ত। চলচ্চিত্রের সাথে আরও অন্য যে আইনগুলো সম্পর্কযুক্ত সে গুলো হচ্ছে; দণ্ড বিধি ১৮৬০, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, চুক্তি আইন ১৮৭২, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯, বৈদেশিক সম্পর্ক আইন ১৯৩২, আদালত অবমাননা আইন ২০১৩, শিশু আইন ২০১৩, দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ এবং ডিজিটাল সুরক্ষা আইন ২০১৮ উল্লেখযোগ্য।

মানুষের বস্তুগত সম্পদ যেমন মালিক বৈ অন্য কেউ প্রকৃত মালিকের অনুমতি বা মূল্য পরিশোধ ছাড়া ভোগ বা ব্যবহার করতে পারে না, মেধা সম্পদের রক্ষায় সারা পৃথিবীর মানুষ ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যতটা সচেতন ও কর্তব্য পরায়ণ, মেধাসম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে ঠিক যেন তার বিপরীত, বিশেষ করে এশীয় প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে। মেধাসম্পদের রক্ষা এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যে শব্দটি সংশ্লিষ্ট তা হচ্ছে বা Copyright কর্মের অধিকার। ইংরেজি Copyright শব্দটির মধ্যেই এর অন্তর্নিহিত অর্থটি লুকিয়ে আছে। আমরা যদি Copyright ও Right এভাবে শব্দটি বিশ্লিষ্ট করে অর্থ বিশ্লেষণ করি তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় Copy করার অধিকার। অর্থাৎ সকল ধরণের সৃষ্টিশীল কর্মই (যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) কর্মের স্রষ্টা বা রচয়িতার অনুমতি ছাড়া কপি করা বা পুনরুৎপাদন করা, অনুবাদ করা, উপযোগী করা, রূপান্তর করা বা অভিযোজন করা, তা বাণিজ্যিক বা ব্যক্তিগত, যে পর্যায়েই হোক না কেন, তা কপিরাইট ধারণা, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক চুক্তি, দেশিয় আইন, নৈতিকতা ও ইতিবাচকবোধের চরম পরিপন্থী।

কপিরাইট সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সবসময় একাধিক পক্ষ সংশ্লিষ্ট। সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রধানত লেখক, প্রকাশক ও পাঠক, সংগীতের ক্ষেত্রে গীতিকার, সুরকার, গায়ক, যন্ত্রী ও সংগীতকর্মের প্রকাশক বা উৎপাদক, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে কাহিনীকার, স্ক্রিপ্ট রাইটার, প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক, সহশিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এমনভাবে সৃষ্টিশীল প্রতিটি কর্মপরিসরে অসংখ্য মানুষ সম্পৃক্ত থাকেন। যন্ত্র ও প্রযুক্তির যত উৎকর্ষ হচ্ছে, বিশেষ করে কম্পিউটার-ডিজিটাল বিশ্বে এ যুগে কার সৃষ্টিকর্ম কিভাবে চৌর্যবৃত্তির ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে তা সবসময় ঠিকভাবে অনুসরণ করাও সম্ভব না। বিশেষ করে বর্তমান ইন্টারনেট যুগে ঘরে বসেই আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মের উপাদান বা উৎস হাতে পেয়ে যাচ্ছি। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই সেই সৃষ্টিশীল কর্মের রচয়িতাই বঞ্চিত হচ্ছে তার যথাযথ Royalty থেকে।

চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রণেতা হলেন চলচ্চিত্রের প্রযোজক। তিনি কপিরাইটের অধিকারী। যে বছর চলচ্চিত্রটি প্রথম প্রকাশিত হবে তার পরবর্তী পঞ্জিকাবর্ষের শুরু থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত মালিকানা বহাল থাকে। চলচ্চিত্রের কপিরাইটের আবেদনের প্রক্রিয়া অন্যান্য কর্মের আবেদনের মতোই। তবে চলচ্চিত্রের সেন্সর ছাড়পত্র জমা দিতে হবে এবং চলচ্চিত্রটি সিডি আকারে দুই কপি জমা দিতে হবে। এ ছাড়া যেকোনো রেকর্ড-কর্মের জন্যও কপিরাইট নিবন্ধন করানো যায়। কেউ যদি কোনো লেখক বা প্রণেতার বই বা কোনো সৃষ্টিকর্ম নকল করেন, তাহলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রতিকার চাইতে পারবেন। শাস্তি হিসেবে কপিরাইট ভঙ্গকারীর হতে পারে চার বছরের জেল ও সর্বনিম্ন ছয় মাসের জেল। সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকার জরিমানা ও সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এ শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর ও সর্বনিম্ন এক বছর এবং সর্বোচ্চ ৫ লাখ ও সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা জরিমানা। ফৌজদারি বিচার হবে দায়রা জজ আদালতে। এ ছাড়া জেলা জজ আদালতেও ক্ষতিপূরণ ও নিষেধাজ্ঞার প্রতিকার চাওয়া যাবে।

যদি কোন চলচ্চিত্র নির্মাতা অন্য কোন চলচ্চিত্র বা গল্প থেকে ধারণা নিয়ে নিজের মত করে চলচ্চিত্র তৈরি করেন তাহলে তিনি কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করেছেন বলে ধরা হবে না। কিন্তু কিছু গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা নকল চলচ্চিত্র তৈরি করছেন তা হোক দেশি চলচ্চিত্র থেকে বা বিদেশি চলচ্চিত্রের হুবহু নকল। দর্শকরাও বুঝতে পারেন এটা নকল চলচ্চিত্র। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতা বা এর সাথে সম্পর্কিত সবাই কপিরাইট আইনকে পাশ কাটিয়ে চলে যান। কিছু উদাহরণ হল; ৯০ এর দশকে নির্মিত ‘পিতা মাতার সন্তান’ আসলে ভারতের ‘আবতার’ চলচ্চিত্র থেকে নকল করা যা ১৯৮৩ সালে মুক্তি পায়, ২০১৭ সালের চলচ্চিত্র ‘অহংকার’ হল ভারতীয় কান্নাড়ি চলচ্চিত্র ‘অটো শঙ্কর’ এর নকল যা ২০০৫ সালে মুক্তি পায়, ‘রাজা বাবু’ ২০১৫ এ মুক্তি পায় যা আসলে ২০১২ সালের তেলেগু চলচ্চিত্র ‘ধাম্মু’ এর নকল, ২০১৫ সালের ‘আশিকি’ চলচ্চিত্র হচ্ছে ২০১২ সালের তেলেগু চলচ্চিত্র ‘ইশক’ এর নকল, ২০১৪ সালের ‘ফুল অ্যান্ড ফাইনাল’ চলচ্চিত্রটি ২০০৬ সালের কোরিয়ান চলচ্চিত্র ‘ডেইজি’ এর নকল।

২০১৪ সালের ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রটি জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয় কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় উক্ত চলচ্চিত্রটি ছোট গল্প ‘গাছটা বলেছিল’ এর নকল। ফলে উক্ত পুরস্কার বাতিল করা হয়। এছাড়া ১৯৯৫ সালের ‘অন্য জীবন’ চলচ্চিত্র নিয়ে মামলা হয় কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে। তবে কপিরাইট আইন মেনে ভারতীয় চলচ্চিত্র ও হুবহু এদেশে নির্মিত হয়েছে, যেমন; কেয়ামত থেকে কেয়ামত যা ভারতীয় কেয়ামত সে কেয়ামত তাক থেকে নির্মিত করা হয়েছে, ভারতীয় দিল চলচ্চিত্রটিও এদেশে আমার ঘর আমার বেহেশত হিসেবে নির্মিত হয়েছে এবং ভারতের সাজান চলচ্চিত্রটি এদেশে স্বজন হিসেবে নির্মিত হয়। দেখা গেছে এই সবগুলো চলচ্চিত্রই দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করেছে।

আরেকটি বিষয়, ভারতও আমাদের কিছু চলচ্চিত্র কপিরাইট আইন মেনে তাদের দেশে পুনরায় নির্মাণ করেছে, যেমন; বাংলাদেশের ‘সত্য মিথ্যা’ এবং ‘মায়ের দোয়া’ চলচ্চিত্রগুলো কলকাতায় পুনরায় নির্মাণ করেছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র পাইরেসি আরেকটি অপরাধ যা কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। এতে চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে বাজারে বেআইনি ভাবে চলে আসে এতে নির্মাতা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হন।

পরিশেষে বলা যায়, যদিও বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তারপরও ভাল মানের নকলমুক্ত চলচ্চিত্র বা কপিরাইট আইন মেনে চলচ্চিত্র খুবই কম। এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনগুলোকে শক্তিশালী করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা, শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করা, চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যারা যুক্ত তাদেরকে কপিরাইট আইনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত করা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কপিরাইট আইন সম্পর্কে পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করা, সাধারণ জনগণকে কপিরাইটের প্রয়োজনীয়তা এবং তা লঙ্ঘন এর কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যেন সকল আইন বিশেষ করে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে তৈরি করা হয় তার জন্য রাষ্ট্রের আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগকে সমন্বিত ভাবে কাজ করতে হবে।

ড. মো. নায়ীম আলীমুল হায়দার: সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত