চয়ন চৌধুরী

১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২১:২৫

‘খামোশ’! ‘খবিশ’ সাংবাদিক শুধু পয়সা খায়!

বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠান কোনটি? বিভিন্ন গবেষণায় নানা প্রতিষ্ঠানের কথা আসে। তার কতটুকু সত্য আর কতটুকু সত্যের অপলাপ- তা ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে ঢালাওভাবে কেউ এখনও এমন কোন অভিযোগ করেছেন বলে শোনা যায়নি। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরাও ‘শর্ষেতে ভুত’ থাকার কথা স্বীকার করেন না।

এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী গণমাধ্যমকর্মী! এই পেশায় যুক্তদের ‘হলুদ সাংবাদিক’ বলা নিত্য ঘটনা! সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ-ই ‘হলুদ সাংবাদিকের’ উপস্থিতি স্বীকার করে নেন। কতিপয় মানুষ সাংবাদিকতার নামে তথ্য সন্ত্রাসে যুক্ত হয়ে পড়েন- তাও স্বীকার করে নেন তারা। এই কলুষতা থেকে মুক্তির আকুতি জানিয়েও কাজ হয় না।

২০১৪ সালে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী (প্রয়াত) সাংবাদিকদের ‘খবিশ’ ও ‘চরিত্রহীন’ আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই সময় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও এবারে সবাই কেমন যেন নিশ্চুপ! হ্যাঁ, ড. কামাল হোসেনের ‘খামোশ’ বলার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি! ঢাকায় সাংবাদিকদের শীর্ষ দুটি সংগঠন ছাড়া আর সবাই বিস্ময়করভাবে ‘খামোশ’ হয়েই আছেন!

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জামায়াতের সঙ্গে ভোট করা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। তিনি এই প্রশ্ন প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ‘খবিশ’ সাংবাদিকেরা নাছোড়বান্দা! তাই বাধ্য হয়ে কামাল সাহেব তাদের থামাতে নিজের আসল রূপ প্রকাশ করতে বাধ্য হলেন!

একপর্যায়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানের অভিযোগের সূত্র ধরে প্রশ্নে ক্ষুব্ধ ড. কামাল হোসেন প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে বললেন, “চুপ করো। চুপ করো। খামোশ। তোমার নাম কী?...  চিনে রাখলাম...।” ‘খামোশ’ বলে থামিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিশিষ্ট অাইনজীবী সংশ্লিষ্টদের ‘চিনে রেখে’ হুমকিও দিয়েছেন! ড. কামাল ‘চিনে রাখা’ সেই সাংবাদিককে দেখে নেওয়ার ক্ষমতাও রাখেন!

সবসময় আইনের কথা বলে আসা ড. কামাল সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে প্রকাশ্যে না হলেও ‘হলুদ’ বলতেও দ্বিধা করেননি। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে তিনি প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে তিনি বলেছেন, “কত পয়সা পেয়েছো এই প্রশ্নগুলো করতে? কার কাছ থেকে পয়সা পেয়েছো? তোমার নাম কী? জেনে রাখবো তোমাকে, চিনে রাখবো। পয়সা পেয়ে শহীদ মিনারকে অশ্রদ্ধা করো তোমরা।...”

নিজেদের প্রয়োজনে রাজনীতিবিদেরা অহরহ সত্য-মিথ্যা বলেন। তাদের এই সত্য-অর্ধসত্য-অসত্য তথ্য সাংবাদিকেরা প্রচার-প্রকাশ করবেন; তাই আশা করেন। এমন হলেই সাংবাদিকেরা ‘সমাজের দর্পণ’। আর কোন সংবাদ বিপক্ষে গেলে ‘হলুদ সাংবাদিক’ তকমার সঙ্গে গালিগালাজ জোটে! প্রতিনিয়ত টাকা-পয়সা দিয়ে সাংবাদিকদের কিনে ফেলার বা নেওয়ার অভিযোগও করেন।

সাংবাদিকদের ‘খামোশ’ বলার একদিন পর গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এক বিবৃতিতে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমার বক্তব্য কোনোভাবে কাউকে আহত বা বিব্রত করে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” কিন্তু এতে তিনি জামায়াত ইস্যুতে কোন মন্তব্য করেননি! অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে উনার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে সবাই আগ্রহী।

সারাবিশ্বে-ই সিংহভাগ সংবাদের দুটি পক্ষ থাকে। ফলে যেকোন সংবাদে সুবিধাভোগীদের বিপরীতে বিক্ষুব্ধ পক্ষ থেকেই যায়। এখন বিক্ষুব্ধ পক্ষ প্রভাবশালী হলে সাংবাদিকদের ভাগ্যে নূন্যতম গালিগালাজ থেকে শুরু করে হুমকি-ধামকি, মামলা-হামলা পর্যন্ত মোকাবেলা করতে হয়। টাকার বিনিময়ে ‘মিথ্যা’ ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ ও ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ সংবাদের অভিযোগ সবসময় শোনা যায়!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে ‘টাকা-পর্যসার বিনিময়ে’ সংবাদ করলে সমাজে সবচেয়ে ধনী শ্রেণী হওয়ার কথা সাংবাদিকদের। কিন্তু মফস্বল পর্যায়ে প্রায় দেখা যায়, টাকা-পয়সার অভাবে জীবনযাপন করছেন একজন সাংবাদিক। বিত্ত-বৈভব তো দুরের কথা, নিজে ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন! ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাতে গিয়েও গলদঘর্ম অবস্থা!

সমাজে ‘সবচেয়ে সম্মানী’ পেশাদার হিসেবে পরিচিতি পান একজন সাংবাদিক। কিন্তু সেই সাংবাদিক অসুস্থ হলেই আসল চিত্র ফুটে উঠে! সারাজীবন ‘টাকা-পয়সা’ খাওয়ার দায়ে অভিযুক্ত সেই ‘হলুদ’ সাংবাদিকের চিকিৎসায় সাহায্য তহবিল গঠন করতে হয়! মফস্বলে অনেক বড় সাংবাদিককেও হাত পাততে হয়! কিন্তু সাধারণত প্রভাবশালী কোন আইনজীবীর চিকিৎসায় ‘সাহায্য তহবিল’ গঠনের কথা শোনা যায় না!

সারাজীবন জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলে আসা একজন মানুষ হঠাৎ করে তাদের সঙ্গে রাজনীতির যুদ্ধে নেমে পড়ায় তো প্রশ্ন উঠবেই! এখানে তো আইন পেশার বিষয় নয় যে, পেশাদার হিসেবে যেকোন মামলায় কারো পক্ষে নেমে যাওয়া যাবে! রাজনীতি মানেই তো আর্দশের বিষয়! এখন প্রকাশ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্দশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে পথ চলতে দেখে কেউ কী বলবে, কত টাকা-পয়সা নিয়েছেন মশাই?
লেখক: সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত