ফারজানা সিদ্দিকা

০৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০৩

সিলেটে রবীন্দ্রনাথ : শতবর্ষে ফিরে দেখা

রবীন্দ্রনাথের সিলেট আগমনের শতবর্ষ উপলক্ষে সিলেট নগরীর চাঁদনীঘাট এলাকায় নির্মিত ম্যুরাল

১৯১৯-এ শিলং থেকে সিলেটে আসার সড়কপথ নির্মিত হয়নি। শিলং থেকে তখন চেরাপুঞ্জি পর্যন্ত মোটরগাড়ি বা ঘোড়ার গাড়িতে আসতে হতো। তারপর সেখান থেকে সিলেটের উদ্দেশে খাসিয়া শ্রমিকের পিঠে বেতের চেয়ার বাঁধা 'থাপা'য় চড়ে পাহাড় থেকে নামতো লোকে। রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই 'এই দুর্গম পথে মানুষের পিঠে চেপে' পাহাড় থেকে নামতে রাজি হলেন না। ফলে, আসাম-বেঙ্গল রেলপথে লামডিঙ ঘুরে সিলেটের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। সঙ্গী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা দেবী। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনীর তৃতীয় খণ্ডে 'আসামে এক মাস' অংশে রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। প্রশান্তকুমার পালও লিখেছেন তাঁর 'রবিজীবনী'তে। তবে প্রভাতকুমারের মতো বিস্তৃত বিবরণে নয়।

রেল যেখানে যেখানে থেমেছে সেখানেই 'কবির দর্শনপ্রার্থী জনতার ভিড়'। সিলেট স্টেশনে রেল পৌঁছায় ৫ নভেম্বর সকালে। সেখানে তখন হাজার হাজার মানুষ কবিকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য প্রতীক্ষা করছে। 'সুসজ্জিত' বোটে সুরমা নদী পার হয়ে চাঁদনিঘাটে নামেন। সেদিন 'চাঁদনিঘাট পত্র-পুষ্প-পতাকা মঙ্গলঘটে সুসজ্জিত, ঘাটের সবগুলো সিঁড়ি লালসালুতে মোড়া।' সেখানে একটা ফিটন গাড়িতে তোলা হলো তাঁকে। কিছুক্ষণ পরই তিনি বুঝতে পারলেন সেই ফিটন গাড়ির ঘোড়া খুলে দিয়ে ছাত্র আর যুবকেরা নিজেরাই টেনে নিয়ে চলছে। যে কারণে তিনি 'থাপা'য় উঠলেন না, সেই কারণটিই ঘটছে বলে প্রতিবাদ করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর সে প্রতিবাদ বিপুল জয়ধ্বনির মধ্যে হারিয়ে যায়। বর্তমান সিলেটের কাজিটুলা এলাকায় পাদ্রি টমাস সাহেবের বাড়ির পাশে একটা সুন্দর বাংলোতে তাঁর থাকবার ব্যবস্থা হয়। দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি থাকলেও সেদিনই সন্ধ্যা সাতটায় 'শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজ-মন্দির'-এ উপাসনা করেন রবীন্দ্রনাথ। ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের অনুরোধে উপাসনার শুরুতেই 'বীণা বাজাও হে মম অন্তরে/সজনে বিজনে, বন্ধু, সুখে দুঃখে বিপদে-/ আনন্দিত তান শুনাও হে মম অন্তরে' প্রার্থনা-সংগীতটি গেয়ে শোনান।

পরের দিন ৬ নভেম্বর সকাল ৮টায় টাউন হল প্রাঙ্গণে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। শীতের সেই ভোরে প্রাঙ্গণ উপচে পড়ছে। প্রায় পাঁচ হাজার দর্শক উপস্থিত। সভার শুরুতেই সংবর্ধনা-সমিতির সভাপতি সৈয়দ আবদুল মজিদ উর্দু ভাষায় 'কবিপ্রশস্তি' করেন। অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন নগেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। এই সমস্ত অভিনন্দনের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণটি দেন সেটি 'বাঙালীর সাধনা' নামে বাংলা ১৩২৬ 'প্রবাসী' পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ছাপা হয়।

সভা শেষে দুপুরে অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ শেষে পুনরায় ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে যান। সেখানে তাঁকে মহিলা সমিতি অভিনন্দন জানায়। 'শ্রীহট্ট মহিলাগণের' পক্ষ থেকে নলিনীবালা চৌধুরী অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন। মহিলা সমিতির উদ্দেশ্যে ধন্যবাদসূচক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন তিনি।

মণিপুরি সম্প্রদায়ের তাঁত বস্ত্র-বয়ন নৈপুণ্য, নৃত্যকলা এবং তাদের জীবনযাত্রার ব্যাপারে কৌতূহল ছিল রবীন্দ্রনাথের। সুতরাং সিলেট ভ্রমণে এসে সেই সুযোগটি তিনি হারাতে চাইলেন না। মহিলা সমিতির অনুষ্ঠান শেষেই সিলেটের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল মাছিমপুর পরিদর্শনে যান। সেদিন মাছিমপুরে মণিপুরিরা পলল্গীর 'প্রবেশপথে সারি দিয়ে কলাগাছ পুঁতে কাগজ-কাটা ফুল-লতা-পাতা দিয়ে একটি সুন্দর তোরণ নির্মাণ করেছিল।' মণিপুরি বালকদের রাখালনৃত্য দেখে মুগ্ধ হন তিনি। কিন্তু সময়ের অভাবে মেয়েদের নাচ তখন দেখতে পারেননি। কেননা তাকে সন্ধ্যায় 'টাউন হলে' আরেকটি সভায় অংশগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সেই বিশেষ নাচ দেখার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিতও করতে চাননি তিনি। তাই, মণিপুরি নাচের মেয়েদের রাতে আমন্ত্রণ জানালেন যেখানে তাঁর থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে সেই বাংলোতে। বেশকিছু মণিপুরি তাঁতের কাপড়ও কিনেছিলেন। পরে, সন্ধ্যার সভা শেষে বাংলোতে মণিপুরি মেয়েরা নাচ পরিবেশন করেছিলো। রবীন্দ্রনাথ মণিপুরি নৃত্যকলায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, কলকাতায় ফিরবার পথে ত্রিপুরার রাজার সাহায্য নিয়ে একজন নাচের শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান সেখানকার শিক্ষার্থীদের নাচ শেখাবার জন্যে।

কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় টাউন হলে তিনি যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন, সেটি সিলেটে প্রদত্ত সবগুলো বক্তৃতার মধ্যে সবচেয়ে 'গুরুত্বপূর্ণ' হলেও এই বক্তৃতার কোনো অনুলিখন মেলেনি। সভায় উপস্থিতদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে সেই বক্তৃতার বিষয় সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন। তারা জানান, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতি উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা ও অপ্রীতিই ভারতের দুর্দশার কারণ। ভারতবর্ষের পক্ষে সর্বাধিক প্রয়োজন একতাবদ্ধ হওয়া।...'

৭ নভেম্বর ভোরবেলা পুত্র এ পুত্রবধূসহ ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক গোবিন্দনারায়ণ সিংহের বাড়িতে 'শুভ নামকরণ' অনুষ্ঠানে যোগ দেন। শিশুটির নাম রাখেন 'শুভব্রত'। এদিনই দুপুরের পরে ছিল মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্রাবাসের উদ্যোগে কবি-সংবর্ধনার আয়োজন। সেই ছাত্রাবাস তখন 'সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল'। [পরে ১৯২৫-এ দুর্গাবাড়ির টিলার ওপর কলেজটির স্থায়ী ভবন নির্মিত হয়। বর্তমানে স্থানটির নাম টিলাগড়। এখানে রবীন্দ্রনাথ যাননি।] কলেজের 'ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে তাঁকে নিয়ে আসে সুসজ্জিত সভামণ্ডপে। সভায় প্রায় চার হাজার লোক হয়েছিল, তার মধ্যে অর্ধেকই ছাত্র।' এখানে রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন তারই সারমর্ম 'আকাঙ্ক্ষা' নামে পরবর্তীকালে বাংলা ১৩২৬ পৌষ 'শান্তিনিকেতন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মুরারীচাঁদ কলেজের ৫০ বছর পূর্তিতে কলেজ বার্ষিকীতেও ছাপা হয়েছিল।

এদিন সভাশেষে অধ্যক্ষ অপূর্বচন্দ্র দত্তের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হয় তাঁকে। পরে সন্ধ্যায় রায়বাহাদুর নগেন্দ্র চৌধুরীর বাসভবনে সিলেটের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে এক প্রীতিসম্মেলনে যোগ দেন।

পরের দিন, ৮ নভেম্বর রেলপথে সিলেট থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার পথে যাত্রা করেন রবীন্দ্রনাথ।

খ.
সিলেটে দেয়া বক্তৃতা দুটো লিখিত ছিল না। 'বাঙালীর সাধনা' ও 'আকাঙ্ক্ষা' নামে বক্তৃতা দুটো অনুলিখন থেকে সে বছরেই 'প্রবাসী' আর 'শান্তিনিকেতন'-এ ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথের রচনাবলীতে এ লেখা দুটো নেই। কেবল এ লেখা দুটোই নয়, অনুলিখনের কোনো বক্তৃতাই এখন পর্যন্ত রচনাবলিভুক্ত হয়নি। এমনকি, 'কবি প্রণাম'- এ ১৩৪৮-এ 'কবির হস্তলিপি মুদ্রিত' সিলেট নিয়ে লেখা কবিতাটিও তাঁর কোনো গ্রন্থে নেই। ফলে, কবিতাটি কবে, কোথায় বসে লিখেছেন সে সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ধারণা, কবিতাটি ১৯৩২-এর পরে লেখা। সিলেট ভ্রমণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেই কবিতাটি লেখা নয়। বাঙালির ভূ-সীমা নির্ধারণ জরুরি ছিল বাঙালির একতাবদ্ধ হবার প্রয়োজনেই- এ কথা নানাভাবে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছেন। এ কবিতায়ও সেই একই উচ্চারণ-

মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি।
ভারতী আপন পুণ্য হাতে
বাঙালির হৃদয়ের সাথে
বাণীমালা দিয়া
বাঁধে তব হিয়া
সে বাঁধনে চিরদিনতরে তব কাছে
বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা আছে।

কী বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ 'বাঙালীর সাধনা' ও 'আকাঙ্ক্ষা'র বক্তৃতায়? ১৯১৯-এর নভেম্বরে সিলেটের বক্তৃতায় যা কিছু বলেছিলেন তিনি, সে বলার শুরু হয়েছিলো আরও আগে, ১৯১৯-এর মধ্য এপ্রিল থেকেই। ১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিলের পর থেকে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা ও চিঠিপত্র একই পথে আহ্বান করে গেছে বাঙালি তথা ভারতবাসীকে। সে আহ্বান আত্মজাগরণের। অন্যায়ের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াবার। আত্ম-পরিচয় চিহ্নিত করবার। ১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি অন্ধকার দিন। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে বৈশাখী পূর্ণিমার মেলায় সেদিন ৩৭৯ জনকে বিনা সতর্কতায় হত্যা করা হয়। কেবল হত্যাকাণ্ড নয়, জালিয়ানওয়ালাবাগ জুড়ে এমনসব অত্যাচার করা হয় যা মনুষ্যত্বের পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথ এরই প্রতিকার চেয়ে মহাত্মা গান্ধীকে যে চিঠিটি লেখেন সেটি ১৬ এপ্রিল কলকাতার 'ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ'-এ প্রকাশ পায়। তিনি লিখেছিলেন, 'আপনার শিক্ষা এই যে, মানুষ সত্যের দ্বারা, কল্যাণের দ্বারা অন্যায় ও মঙ্গল প্রতিহত করবে। কিন্তু এ সংগ্রাম বীরের সংগ্রাম। যারা প্রবৃত্তির তাড়নায় চালিত হয় এ-সংগ্রাম তাদের জন্য নয়। এক পক্ষের পাপ অন্য পক্ষের পাপকে ডেকে আনে, এক পক্ষের অবিচার ও অন্যায় লাঞ্ছনা অন্য পক্ষকে হিংসার পথে প্রবৃত্ত করে। দুঃখের কথা, এই রকম এক অমঙ্গলের শক্তি উপস্থিত হয়েছে আমাদের দেশে। ...অন্যায় যখন বিপুল আকার ধারণ করে প্রবল হয়ে আসে, তখন অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের মুখে সাহস করে দাঁড়ানোটাই আদর্শনিষ্ঠ পুরুষের আত্মিক জয়। ...আমি বার বার বলেছি, স্বাধীনতা এমন এক অমূল্য সম্পদ যা ভিক্ষা দ্বারা কিছুতেই লভ্য হতে পারে না। স্বাধীনতা পেতে হলে তাকে অর্জন করে নিতে হয়। ... ন্যায়নিষ্ঠার পুণ্য কবচ ধারণ করে তাকে কুণ্ঠাবিহীনভাবে দাঁড়াতে হবে সেই তাদের সামনে, অবিনয়ের দ্বারা, যারা আত্মার শক্তিকে লাঞ্ছিত করতে চায়। ...আমরা ময়ূরপুচ্ছ বায়সের মতো ভাবছি যে, পশ্চিম থেকে ধার-করা কূটনীতির অপকৌশল আমাদের উদ্দেশ্যসাধনে সহায়তা করবে। এই হীনতা থেকে আপনি দেশকে উদ্ধার করুন।...সত্য লাভের জন্য আপনি যে আত্মদান-যজ্ঞে ব্রতী হয়েছেন, সে ব্রত যেন বৃথা বাগাড়ম্বরে পণ্ড না হয়, ধর্মের নামে আত্মপ্রবঞ্চনার মোহ যেন আমাদের গ্রাস না করে।' এ চিঠি লিখেও কি শান্ত হলো তাঁর মন? কলকাতা-শান্তিনিকেতন আসা-যাওয়া করলেন আরও কয়েকদিন। শেষে, ২৯ মে কলকাতায় এসে পাঞ্জাব-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সভা আহ্বান করলেন। সে সভায় তেমন সাড়া পেলেন না যখন, তখন নিজের কর্তব্য স্থির করলেন। ২৯ মে গভীর রাতে ভাইসরয় লর্ড চেম্স্ফোর্ডের কাছে চিঠি লিখতে বসলেন। চিঠিতে জানালেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ ১৯১৫ সালের ৩ জুন সম্রাট পঞ্চম জর্জের জন্মদিনে তাকে যে নাইটহুডের প্রতীক 'স্যার' উপাধি দেয়া হয়েছিল, তা তিনি বর্জন করলেন। (রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি এ উপাধি পেয়েছিলেন।) এ চিঠির কথা কাউকে জানাননি তিনি। এমনকি নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথকেও না। কেবল এনডুজ সাহেব জানতেন। তিন দিন পর ১৯১৯ সালের ২ জুন এ চিঠি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভারতবাসীসহ সারা বিশ্ব দেখে একজন কবির দ্বিধাহীন অটল প্রতিবাদ।

সেই একই বছর সিলেটের বক্তৃতায়ও রবীন্দ্রনাথের এই অনমনীয় অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, আত্মশক্তির সন্ধান, আত্মত্যাগ ও আত্মজাগরণে মধ্য দিয়ে নিজের দেশের আত্ম-পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্যে 'বাঙালীর সাধনা'য় তিনি বললেন, 'অনেকে বলেন ব্যবসা-বাণিজ্যের মিলনে কিংবা রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলনে আমাদের দেশে একতা ঘটবে। বস্তুত বিষয়বুদ্ধির দ্বারা যে মিলন ঘটে, সেটা ক্ষণস্থায়ী। মিলনের দরকার চলে গেলেই সম্বন্ধ ছুটে যায়। আজ ফরাসি-ইংরেজে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব, আর এক সময়ে এই দুই জাতের মধ্যে ঘোর শত্রুতা হওয়া কিছুই অসম্ভব নয়। য়ুরোপের ইতিহাসে এই রকম গরজের বন্ধুত্ব গড়ছে, একবার ভাঙছে- এ তো বারম্বার দেখা গেছে। তাই আর একবার আমাকে বলতে হবে- সকলে মিলে আমরা পাব সেই হিসাবের উপর আমাদের পাকা মিলন হবে না। পরস্পর পরস্পরের জন্যে দেবো এই বেহিসাবি প্রেমের সম্বন্ধেই আমরা মিলতে পারব। যতদিন দেশের অভাব দূর করার জন্যে প্রধানত বিদেশি গভর্নমেন্টের দিকে করুণ দৃষ্টিতে বা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকব, ততদিন আমাদের সেই দেওয়ার চর্চাটা বন্ধ থাকবে যে-দেওয়ার দ্বারা জাতির সৃষ্টি হয়। বিদেশি গভর্নমেন্ট যা তৈরি করতে পারে, তা কলের জিনিস, তাতে ব্যবস্থামাত্র তৈরি হয়। কিন্তু জাতি প্রাণবান পদার্থ- তাকে মানুষ করতে গেলে প্রেম চাই। বহু উপকরণের চেয়েও অল্প প্রেম বড়ো।'

ছাত্রদের উদ্দেশে যে বক্তৃতাটি 'আকাঙ্ক্ষা' নামে প্রকাশ পেয়েছে, সেখানে শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বয়েস নিয়ে স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি করেছেন। তিনি যে বুড়োদের দলভুক্ত নন, জড় নন, স্থির নন বরং ঠিক উল্টো গতি-পরিবর্তন ও তারুণ্যের পক্ষে সেটা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যেমনটা ছিল তাঁর 'সবুজের অভিযান' কবিতায়। সুতরাং, ছাত্ররা যেন তাঁকে বৃদ্ধ বলে ভ্রম না করে! 'বৃদ্ধ সেজে' ছাত্রদের কোনো উপদেশ দিতে রাজি নন তিনি। বললেন, 'মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীনে। এই মনুষ্যত্ব হচ্ছে আকাঙ্ক্ষার ঔদার্য, আকাঙ্ক্ষার দুঃসাধ্য অধ্যবসায়, মহৎ সংকল্পের দুর্জয়তা।' কিন্তু মহৎ আকাঙ্ক্ষার জন্যে তো প্রস্তুতিরও দরকার। চারপাশে দেখছেন, '...বিদ্যালয়ে কেবল দেখতে পাই, ছাত্র নোট বুকের পত্রপুট মেলে ধরে বিদ্যার মুষ্টিভিক্ষা করছে, কিংবা পরীক্ষায় পাশের দিকে তাকিয়ে টেক্সট বইয়ের পাতায় পাতায় বিদ্যার উঞ্ছবৃত্তিতে নিযুক্ত, যে-দেশে মানুষের বড়ো প্রয়োজনের সামগ্রী মাত্রেই পরের কাছে ভিক্ষা করে সংগ্রহ করা হচ্ছে, নিজের হাতে লোকে দেশকে কিছুই দিচ্ছে না- না স্বাস্থ্য, না অন্ন, না জ্ঞান, না শক্তি, যে-দেশে কর্মের ক্ষেত্র সংকীর্ণ, কর্মের চেষ্টা দুর্বল, যে-দেশে শিল্পকলায় মানুষ আপন প্রাণমন আত্মার আনন্দকে নব নব রূপে সৃষ্টি করছে না, যে-দেশে প্রশ্ন করা, বিচার করা, নতুন করে চিন্তা করা ও সেই চিন্তা ব্যবহারে প্রয়োগ করা কেবল যে নেই তা নয়, সেটা নিষিদ্ধ এবং নিন্দনীয়, সেই দেশে মানুষ আপন সমাজে সত্যকে দেখতে পায় না, কেবল হাতের হাতকড়া বেড়ি এবং মৃতযুগের আবর্জনা রাশিকেই চারিদিকে দেখতে পায়, জড় বিধিকেই দেখে, জাগ্রত বিধাতাকে দেখে না।' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের সকল জ্ঞানই যেন একদিকে ধেয়ে চলছে। আমাদের যে দারিদ্র্য 'সে আত্মারই দারিদ্র্য।' সে দারিদ্র্য কেবল শিক্ষা দ্বারা নিজের স্বার্থ খুঁজে ফেরে। 'দারোগাগিরি', 'কেরানিগিরি', 'ডিপুটিগিরি' করবার বাসনায় নিয়ত প্রতিযোগিতায় নামে। অথচ জ্ঞানের যজ্ঞে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে আমাদের বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়! 'আপিসের বড়ো বাবু হয়েই কি আমাদের এই অপমান ঘুচবে?' প্রশ্ন করলেন ছাত্রদের উদ্দেশে, 'যে সমাজে কিছুই ভাববার নেই, কিছুই করবার নেই, সমস্টত্মই ধরাবাঁধা সে সমাজ কি বুদ্ধিমান শক্তিমান মানুষের বাসের যোগ্য?' এই ঘোর লজ্জা ও সংকটের হাত থেকে বাঁচার পথের সন্ধান দিলেন নিজেই। বললেন, 'তোমাদের বয়স কাঁচা, তোমাদের বয়স তাজা, তোমাদের উপর এই লজ্জা দূর করবার ভার। তোমরা ফাঁকি দেবে না ও ফাঁকিতে ভুলবে না, তোমরা আকাঙ্ক্ষাকে বড়ো করবে, সাধনাকে সত্য করবে। তোমরা যদি উপরের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে প্রস্তুত হও, তা হলে সকল বড়ো দেশ যে ব্রত নিয়ে বড়ো হয়েছে আমরাও সেই ব্রত নেব। কোন ব্রত? দান ব্রত। যখন না দিতে পারি তখন কেবল হয়ত ভিক্ষা পাই, যখন দিতে পারি, তখন আপনাকে পাই।'

১৯১৯-এ রবীন্দ্রনাথ সিলেটে বড়ো আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে বাঙালিকে আপনাকে পাবার সাধনার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন। শতবর্ষ পরে, প্রশ্ন জাগে, বাঙালি কি আজও সেইভাবে পেয়েছে আপনারে?

  • ফারজানা সিদ্দিকা: লেখক; অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত