মো. মোফাজ্জল হোসেন টিপু

২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১০:২৪

সমাজ ও আমরা

সামাজিক জীব হিসেবে সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মানুষ একসাথে বাস করে আসছে। প্রাণিজগতের অন্যান্য সদস্যদের মতো মানুষও রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, ভয়-জরা তাকে গ্রাস করে। মানুষের যত ভয় আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয় হলো সমাজের ভয়। আমরা কোনকিছু করতে গেলে প্রথমে ভাবি সমাজ কী বলবে, সমাজ কী ভাববে। উদাহরণ দিতে গিয়ে আমরা বলি, এ সমাজের অবস্থা খুব খারাপ, সমাজটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

ছেলেমেয়েরা যখন পরীক্ষায় খারাপ করে বা কোন ভুল করে কিংবা কোন অপরাধ করে তখন বাবা-মায়ের মূল চিন্তা থাকে সমাজ তাদের কী বলবে, সমাজে তারা কীভাবে মুখ দেখাবে। ভালো চাকরি না করলে, ধনী না হলে সমাজ আমাকে দাম দেবে না, এমন চিন্তাই আমাদের মাথায় সবসময় ঘুরে।

কিন্তু আমরা কি কখনো একটি বারের জন্যও ভেবে দেখেছি সমাজ কী? কিংবা ভাবতে চেয়েছি আসলে সমাজ বলতে কী বোঝায়? উত্তরটা সবারই জানা- না, ভাবিনি, অথবা ভাবতে চাইনি। কিংবা হয়তো আমাদের মনেই হয়নি যে এটা ভাবার মতো কোন বিষয়।

আমাদের শেখানো হয় সমাজের পা আটটি। আট পা-ওয়ালা সমাজের ভয় নিয়ে যে শিশু বড় হয় সে কীভাবে সমাজ নিয়ে ভাববে?

আসলে সমাজের কোন পা নেই। আমার আপনার পায়ের উপর ভর দিয়েই সমাজ দাড়িয়ে আছে। আপনি, আমি কিংবা আমরা মিলেই কি সমাজ নই? সমাজ কি আলাদা কোন অস্তিত্ব? কেউ কি আপনাকে আমাকে আট পা-ওয়ালা কোন ভিনগ্রহী প্রাণির সামনে দাড় করিয়ে বলেছে- “এই হলো সমাজ। এটাকে ভয় করবে।” না, বলেনি। কেউ কোনদিন বলেনি। বলার কোন কারণও নেই। কারণ সমাজ বলে আলাদা কিছু নেই। আমিই সমাজ, আমরাই সমাজ। আমরা যা চিন্তা করি, সমাজও তাই চিন্তা করে। আমরা যা ভাবি, সমাজও তাই ভাবে। প্রকৃতপক্ষে, সমাজ কিছু ভাবে না, আমরাই ভাবি।

সমাজ নিজে কিছু ভাবে না বলেই তো স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সমাজ ভিন্ন রকম হয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথাই ভাবুন না। আজ যেমন নারী শিক্ষার জয়জয়কার, পঞ্চাশ বছর আগে কি সেটা ছিল? কিংবা ১০০ বছর আগে? ছিল আজকের মতো? না- ছিল না। এমন পরিবর্তন কেউ হয়তো ভাবতেই পারতো না। কিন্তু যারা পারতো তারা এগিয়ে গিয়েছেন, স্মরণীয় হয়ে আছেন ইতিহাসে।

আজ থেকে ২০০ বছর আগে মানুষ পড়াশুনা শেখার চেয়ে পয়সা অর্জন করাটাই বেশি জরুরি মনে করতো। কিন্তু আজ! কোন বাবা যদি তার সন্তানকে পড়াশুনা না শিখিয়ে ওই বয়সে কাজে পাঠায় তবে কেউ কি তাকে গলায় ফুলের মালা দেবে? তাহলে ২০০ বছর আগের সমাজ কোথায় গেল? আসলে ২০০ বছর আগে মানুষ পয়সা অর্জনকে বেশি মূল্য দিতো। আজকের মানুষ তেমনটা ভাবে না, তাই আজকের সমাজও সেটা ভাবে না।

একটা সময় ছিল যখন হিন্দু সমাজে ১০ বছর পার হলেই মেয়ে আইবুড়ো হয়ে যেত। তখন প্রতিটি বাবা মা-ই ১০ বছরের আগে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে চিন্তিত থাকতো। আর আজকের প্রেক্ষাপট সবারই চোখের সামনে। ১০ বছরের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কথা কোন বাপ চিন্তাও করে না। কারণ- সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, লোকে খারাপ বলবে।

আজ যে জিপিএ ৫ কিংবা গোল্ডেন এ+ পাওয়ার এত প্রতিযোগিতা সেটা যতটা না ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার চেয়ে বেশি পাশের বাসার ভাবি কী বলবে, বা পাড়ার তমুক সাহেব কী বলবেন সেটার জন্য। সে জন্যই হয়ত প্রতিবার এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার পর, “জিপিএ ৫ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা”- এমন শিরোনামে পত্রিকায় খবর হয়। এতটুকু জীবনে তাকে এই শেখানো হয়েছে যে জিপিএ ৫ না পেলে জীবন মূল্যহীন। কিন্তু কেউ তাকে এটা শেখায় নি যে সার্টিফিকেটই জীবনের সব কিছু নয়। যে ছেলেটা বড় হয়ে সমাজের হাল ধরার কথা, সে সমাজের ধিক্কারের ভয়ে বেঁচে থাকার সাহসটা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলছে। কিছুদিন আগেও কিন্তু এটা ছিল না। আজ আমরা জিপিএ ৫ ছাড়া জীবন মূল্যহীন ভাবি বলেই সমাজ নামক অদৃশ্য বস্তুর হাতে ছেলেমেয়েরা বলি হচ্ছে।

৫০ বছর আগের আচার ব্যবহার যেমন আজকের মতো ছিলো না, ৫০ বছর পরের সমাজটাও আজকের মতো থাকবে না। সমাজ বদলায় না, তাকে বদলানো হয়। যে যুগে যার জয়জয়কার, সে যুগের সমাজ তার মতো করে ভাবে।

সমাজ বলতে যেমন আলাদা কিছু নেই, আমরাই সমাজ, তেমনি সমাজ নামক এ ব্যবস্থাটিকেও আমাদেরই বদলাতে হবে। সমাজ আমাদেরই কাজের, মনোভাবের, আচার ব্যবহারের, বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রতিফলন। আমরা ভালো থাকলেই সমাজ ভালো থাকবে। আমরা ভালো কিছু করলেই সমাজ থেকে ভালো কিছু বেরিয়ে আসবে। আমরা পরিবর্তন হলেই সমাজ পরিবর্তন হবে, সমাজ বদলাবে।

সমাজকে ভয় পাবেন না। নিজের যা হতে ইচ্ছা হয় তাই হোন। সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে যান, সামনের সময়, সমাজ- দুটোই আপনার হবে। মানুষই সমাজ, মানবতাই সমাজের আদর্শ, মানুষই সমাজ পরিবর্তনের একমাত্র হাতিয়ার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত