শামীম আহমেদ

১২ মার্চ, ২০২০ ০১:২৪

করোনা পরিস্থিতির যে পর্যায়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্যানডেমিক’ ঘোষণা

World Health Organization (WHO) করোনা ভাইরাস সংক্রমণকে প্যানডেমিক (pandemic) ঘোষণা করায় নতুন কোন পরিস্থিতির তৈরি হয়নি। প্যানডেমিক মানে হচ্ছে একটা রোগ যদি বিশ্বের সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে যায় (সরলীকরণ করে বললাম বোঝার সুবিধার্থে)।

করোনা ভাইরাস প্রায় একমাস আগে যেভাবে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে করে এটি গত একমাস ধরেই প্যানডেমিক। WHO স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে ভীতি না তৈরি করার চেষ্টায় এটিকে প্যানডেমিক ঘোষণা করতে এতদিন সময় নিল।

প্যানডেমিক ঘোষণার ফলে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে, তবে সাথে সাথে সরকারগুলো আরও সচেতন হবে - এটা আশা করছি। এতদিন ধরে ব্যক্তিগত প্রস্তুতির কথা বলেছি, আজ আসুন বাংলাদেশ সরকারের কিছু করণীয় বিষয়ে আলাপ করা যাক।


পৃথিবীর অন্যতম ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশের জন্য বিমানবন্দরের চাইতেও অনেক ক্ষেত্রে স্থল ও নৌবন্দরগুলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কেননা আমদানি-রপ্তানির জন্য আমরা এই বন্দরগুলো বেশি ব্যবহার করে থাকি। সুতরাং বিমানবন্দরে নজরদারি জারি রাখার পাশাপাশি স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে সরকারের অস্থায়ী মেডিকেল পোস্ট স্থাপন ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা উচিৎ।


ঢাকা শহরের কিছু হাসপাতাল এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কিছুটা প্রস্তুত হলেও সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবা করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য অপ্রতুল। গতবছর ঢাকার বাইরে যেভাবে ডেঙ্গুর বিস্তার হয়েছে তাতে করে দেশের সবগুলো জেলা শহরে ও ইউনিয়ন পর্যায়ে একাধিক হাসপাতাল ও মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা দরকার। যেহেতু বিদেশ প্রত্যাগত শ্রমিক ও প্রবাসীগণ বেশিরভাগ সময়ে সরাসরি গ্রামে চলে যান, তাই তারা যাতে আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক সেবা ও পরামর্শ পেতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে।


টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর করোনা ভাইরাস বিষয়ক জরুরি তথ্য-উপাত্ত নিয়মিত প্রচার করা জরুরি। এছাড়াও বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে সব রোগীকে ভর্তি করে বিচ্ছিন্ন রাখার মতো পর্যাপ্ত বেড আমাদের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে নেই। তাই এই ক্ষেত্রে বর্তমানে ক্যানাডার গৃহীত পদক্ষেপ “self-isolation” কার্যকরী হতে পারে। এই ক্ষেত্রে রোগী করোনা ভাইরাস পজিটিভ হলে, সে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ১৪ দিনের জন্য নিজ ঘরে বিচ্ছিন্ন থাকবে। এমতাবস্থায়ও প্রয়োজনের সময় তৎক্ষণাৎ চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা দরকার।


সরকার চীনে প্রচুর হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টিসু, টয়লেট পেপার পাঠিয়েছিল, যা প্রশংসনীয়। নিজের দেশের জনগণও যাতে তাদের প্রয়োজনীয় মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান, টিসু, টয়লেট পেপার ইত্যাদি প্রয়োজনের সময় পায়, সেই ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে।


বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন দেশের সরকার যেভাবে মানুষকে self-isolation, অর্থাৎ নিজের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে বলছে, তাতে করে মানুষ বাজার-ঘাটে কম যেতে চাইবে, এবং ফলশ্রুতিতে জিনিসপত্র কিনে ঘরে রেখে দিতেও চাইবে। সরকারকে মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে যে নিয়মিত হাত ধুলে, ঘরের বাইরে কিছু স্পর্শ না করলে, বা স্পর্শ করে নাক-মুখ-চোখ ধরার আগে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিলে কোন চিন্তা নেই। সেইক্ষেত্রে একবারে একমাসের বাজার করে রাখারও প্রয়োজন নেই।


ইরান বা যুক্তরাজ্যে সরকারের শীর্ষ এমপি, মন্ত্রীরা করোনাতে আক্রান্ত হয়েছেন। এটাকে ভয় হিসেবে না দেখে সরকারের দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের করোনা টেস্ট করে মানুষকে রিপোর্ট জানানো উচিৎ স্বচ্ছতার খাতিরে। মিডিয়া হাউজগুলোও নিজ উদ্যোগে নিজেদের করোনা টেস্ট করে পত্রিকার মাধ্যমে মানুষকে জানাতে পারে।


এই প্যানডেমিকে চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের কিন্তু কোন মুক্তি নেই। তারা চাইলেও নিজেদের isolation-এ নিতে পারবেন না, যেমনটি পারেননি ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও। তাই ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা কিংবা জনস্বাস্থ্যসেবা পেশাজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন, আস্থা রাখুন। তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান। তারা যাতে নিজেদের অসহায়বোধ না করেন।

সবাইকে ভালোবাসুন। গুজব ছড়াবেন না। গীবত করবেন না। পৃথিবী করোনামুক্ত হোক।

শামীম আহমেদ: সোশাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত