দিলীপ রায়

২৯ মার্চ, ২০২০ ১৮:২৭

শিক্ষকের দায়মুক্তি

বর্তমান বিশ্বব্যাপী এক আতংকের নাম কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাস। বাংলাদেশ সরকার দেশের মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দেশবাসীকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রদত্ত ভাষণে ঘরে থাকার আহবান জানিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মী, আইনশৃংখলা বাহিনী, প্রশাসন, শিক্ষা ক্যাডারসহ দেশের সবাই এই দুর্যোগে সহযোগিতায় এগিয়ে আসছেন। যারা প্রশাসনের আদেশ মেনে ঘরে থাকছেন তারাও কিন্তু বড় একটা সহযোগিতা করছেন।  

এরই মাঝে গত তিন-চার দিন যাবৎ বাংলাদেশে অনেকগুলো আলোচিত ঘটনার জন্ম হয়েছে। পিপিই (Personal Protective Equipment) বিতরণ নিয়ে ঘটে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। পিপিই সংকট থাকার কারণে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ পিপিই পাচ্ছিল না। তাই স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত কর্মীগণ জীবনের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন স্হানে সেবা দিতে ধর্মঘট পর্যন্ত ডাকেন। এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় জেলা প্রশাসন পিপিই পরিধান করে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে। এই বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারের দুই কর্মকর্তা ফেসবুকে পোস্ট দেন। এই পোস্টের কারণে ২৫ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে এক আদেশে ঐ দুই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে শোকজ করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ২৭ মার্চ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরামের আটশতাধিক শিক্ষক যৌথ বিবৃতিতে প্রতিবাদ ও এই আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান। এই আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

২৫ মার্চ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব স্বাক্ষরিত চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার ও নার্সদের বিরুদ্ধে সেবা প্রদানে অনীহা করলে শাস্তিস্বরূপ এক পরিপত্র জারি করেন। পরবর্তীতে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের দাবির মুখে ঐ দিনই এ পরিপত্র প্রত্যাহার করে নেয়।

গত ১৫ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হা এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) এর সহযোগিতায় 'করোনা ভাইরাস ২০১৯ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পিপিই এর যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার' মর্মে একট নির্দেশনা প্রচার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশনায় বলা হয় বিশ্বব্যাপী পিপিই তথা স্বাস্থ্য সেবা দাতাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে এবং এ পরিস্হিতিতে জরুরি ভিত্তিতে দেশের স্বাস্থ্য সেবাদাতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সঠিক নিয়মে যৌক্তিকভাবে সামগ্রীসমূহ ব্যবহার করতে হবে।

২৬ মার্চ সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ফেসবুকে একটা ছবি পোস্ট করেন। সেখানে দেখা যায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা পিপিই পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মহোদয় বলেন, 'প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের, এমনকি আমারও পিপিই ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কারণ, আমরা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে যাই না। এগুলো তাদেরই দরকার যারা আক্রান্ত রোগীকে সরাসরি সেবা দেবেন।'

মানুষের জীবন-মরণের এই সংকটকালীন মুহূর্তে কোনো কোনো দেশ ডাক্তারগণকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করেছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন এক খোলা চিঠিতে প্রিয় ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টাকে সালাম জানিয়ে  বলেছেন, 'খেলার মাঠে ক্রিকেটারদের পারফর্ম করার জন্য ম্যাচ জেতার চাপ নিয়ে খেলতে হয় কিন্তু জীবনে আসল চাপ নেন ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে অন্যের জীবন বাঁচানোটাই আসল চাপ।'

২৭ মার্চ লাহুরের মায়ো(Mayo) হসপিটালে ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকেল স্টাফদের গার্ড অব অনার প্রদান করে পাঞ্জাব পুলিশ, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।

সময়ের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে ইন্দোনেশিয়ায়। ডা. হাইদি আলীর শেষ ছবিটি অনেকেই দেখেছেন। মৃত্যুর আগে বাড়িতে এসে বাচ্চাদের গেটের বাইরে থেকে দেখে চলে যান। তারপর তিনি বিশ্বকে বিদায় জানান। কষ্ট হলেও তিনি নিজের বুকের মাঝে শেষবারের মতো বাচ্চাদের নিতে পারেন নি। এই বেদনাময় চিত্রটি নিশ্চয়ই ডাক্তারদের ত্যাগের জ্বলন্ত উদাহরণ। ভারতে ডাক্তারদের জন্য বীমা ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সারা বিশ্বে ১০০জনের উপরে ডাক্তার সেবা দিতে গিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এতে করে কি ডাক্তারদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাগ্রে চলে আসে না?

পিপিই ই বা সবার আগে কার দরকার?
এবার আরও কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া যাক। রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৩৯ বিসিএস এর একজন ডাক্তার অভিযোগ করেন যে, তিনি হাসপাতাল থেকে ভ্যানে করে ফেরার সময় পথ আগলে পুলিশ তার পায়ে বেত্রাঘাত করে। বাংলাদেশ পুলিশের যেকোনো দুর্যোগে কাজ করার ইতিহাস বেশ গৌরবোজ্জ্বল। কিন্তু ডাক্তার পরিচয় দেবার পরও তার উপর বেত্রাঘাত, এমনতর দু'একজন পুলিশের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সেবাকার্যে দক্ষ পুলিশের মহিমাকে কিছুটা হলেও ম্লান করে বৈ কি!

২৭ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকা এক রিপোর্টে লেখে, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার কালুপীর বাজারে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জনসমাগম ঠেকাতে শুক্রবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত গ্রাম পুলিশ ও থানার এসআইসহ সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে অভিযান চালান ইউপি সদস্য। সন্ধ্যার দিকে তারা একটি ফলের দোকান থেকে কিছু ফল কিনে খাচ্ছিলেন। এই সময় উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত এসি(ল্যান্ড) গাড়ি নিয়ে সেখানে যান। এসময় ইউপি সদস্য এগিয়ে আসলে কোনো কিছু বোঝে উঠার আগেই অশ্লীল ভাষায় গালাগালাজ করতে করতে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকেন।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার চিনাটোলা বাজারে। মাস্ক না পরার কারণে তিনজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠবস করান উপজেলার ৩৪ বিসিএস এর এক এসি(ল্যান্ড)। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এই ছবি দেখে দেশ বিদেশে সচেতন মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে।  জনপ্রশাসন সচিব  মহোদয় এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ওই এসি(ল্যান্ড)কে প্রত্যাহার করে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। মনিরামপুরের ইউএনও বিকেলেই ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের বাড়ী গিয়ে ক্ষমা চান এবং তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩য় ভাগে মৌলিক অধিকার এর বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ, ৩৫(৫) এ বলা হয়েছে ' কোনো ব্যাক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহার সহিত অনুরূপা ব্যবহার করা যাইবে না। '

সংবিধান যেখানে নাগরিকদের সুরক্ষা দিয়েছে সেখানে আমরা কতিপয় ব্যক্তি এমন অমানবিক আচরণ করছি কিসের জন্যে? সরকারের সমূহ অর্জনকে কি বিতর্কিত করবার জন্যে?

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ১৯৭৫ সালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, 'সরকারি কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ, এটা ব্রিটেনের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। যে লোককে দেখবে,  তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজেরা কামাই করে খায়।'

এই যে বিচারের নামে বারাবারি তা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু ঘটছে। এটা কিন্তু প্রশাসনের সবাই করছেন না।(রাজশাহীর ডিসি মহোদয় এক অসহায় বৃদ্ধকে বুকে টেনে নিয়েছেন। এটি ভাইরাল হয়েছে। এটি অবশ্যই প্রসংশার দাবি রাখে।) যে দু'একজন করছেন, তারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্রেডিট নেয়ার জন্যই হয়তো করছেন। কিন্তু হচ্ছে হিতে বিপরীত।

এত বড় ঘটনা ঘটানোর পর কর্ম থেকে দেওয়া হয় অব্যাহতি আর ফেসবুকে ডাক্তারদের পক্ষে পোস্ট দেওয়ায় চাকুরী থেকে হয় বরখাস্ত। এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলছেন।

প্রশ্ন তোলছেন এসি(ল্যান্ড)-এর শিক্ষা নিয়ে। তাই, সঙ্গত কারণেই একজন শিক্ষক হিসেবে এই দায় খানিকটা আমারও। আমরা হয়তো যথাযথ মৌলিক এবং মানবিক শিক্ষা দিতে পারছি না। যারা দেশের জন্য কর্মোপযোগী  ব্যক্তি তৈরি করবে তারা যদি সঠিক ব্যক্তিটি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, তবে দেশ কার উপর ভরসা করবে?

 বাংলাদেশের ২৭ টি ক্যাডার রয়েছে। সেখানে নিয়োগ হয় মেধা এবং কোটার (বর্তমানে কোটা রহিত করা হয়েছে)  ভিত্তিতে। সবচেয়ে মেধাবী সন্তানটি না কি যায় প্রশাসনে। প্রশ্ন হলো, সবচেয়ে মেধাবীটি শিক্ষায় নয় কেন? যে ব্যক্তিটি রাষ্ট্রের জন্য প্রশাসক তৈরি করবে সে কম মেধার হবে কেন? তাই রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে এখনই ভাবতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীটিকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শিক্ষায় নিয়োগ দানের ব্যবস্হা করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। পদ্মা সেতুর মতো সেতু তৈরি করতে আমরা আর কতদিন বিদেশী কারিগরি সহায়তা নেবো? করোনা ভাইরাসের মতো ভাইরাস দমনে আর কত বিদেশের মুখাপেক্ষী হবো?  আমাদের দেশে কি সেই রকম মেধাবী সন্তান নেই? আমরা কি পারি না শিক্ষাকে সর্বাগ্রে প্রায়োরিটি দিতে? দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে এই বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে আহবান জানাই।
এবার আসি মূল কথায়। আমি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মচারী সর্বোপরী একজন শিক্ষক হিসেবে দুই জন বরখাস্তকারী শিক্ষকের ফেসবুকে প্রয়োগকৃত ভাষা এবং তদ্উত্তরে কমেন্টকারির ভাষার সাথে একমত নই। কিন্তু তাদের পোস্টের বিষয়বস্তু তথা এই দুর্যোগে স্বাস্থ্যসুরক্ষাকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের পাশে দাঁড়ানোর আকুতিকে অস্বীকার করতে পারি না।

অপরদিকে, এসি(ল্যন্ড) যে কাজটি করেছে তা কোনো বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই সমর্থন করবে না। কিন্তু তারা তো এই সমাজেরই সৃষ্টি । আমাদের কারো না কারো আপনজন। তাদের বিচারিক ক্ষমতার অপরিপক্ব মগজকে সংশোধন করবার সুযোগ দিতে হবে। আমরা 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, প্রভু নই'- এই অমীয় বাণী বুকে ধারণ করার সময় তো দিতেই হবে। শিক্ষা ক্যাডার কিংবা প্রশাসন এই দেশের উন্নয়নে আমরা কেউ কারো প্রতিপক্ষ নই। দিনশেষে আমরা সবাই সবার।

তাই, ক্ষমার মহত্তম উদারতা দিয়ে মাননীয়  কর্তৃপক্ষ উপরের বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন এই প্রত্যাশা করি।

লেখক: প্রভাষক, গণিত বিভাগ, মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত