অপূর্ব শর্মা

০২ এপ্রিল, ২০২০ ১৮:৩১

সব কিছুতেই কেন আমাদের এত বাড়াবাড়ি?

সব কিছুতেই কেন আমাদের এত বাড়াবাড়ি? মৃত্যুকে স্বাগত জানাতেও কেন কুণ্ঠিত নই আমরা। কোনও কিছু হলেই কেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে আমাদের? সরকারি নির্দেশনা মানতে কেনও উদাসীন আমরা? সারা বিশ্বে করোনা মহামারি আকার ধারণ করলেও আজো কেনো শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি আমাদের! খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়ার কথা বলা হলেও তা কেন মানছিনা আমরা?

ঘরবন্দি হলে, সাধারণ মানুষ যারা দিন আনে দিন খায়, যারা শ্রমজীবী, যারা অসহায়, দরিদ্র তাদের কি হবে? এনিয়ে যখন আমরা কথা বললাম, লিখলাম, তখন সরকার সেইসব মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, একজন মানুষও না খেয়ে মারা যাবেনা দেশে। ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেবেন তিনি। করলেনও তাই। দ্রুততর সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন খাদ্যসামগ্রী প্রতিশ্রুতদের কাছে পৌঁছানোর। প্রধানমন্ত্রী আরও আহ্বান জানিয়েছিলেন, বিত্তবান এবং সচ্ছলদের সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসার জন্য। মানুষ তাঁর আহ্বান এবং নিজের দায়বদ্ধতা থেকে এগিয়ে এসেছে। যে যার সাধ্যমত চেষ্টা করছে সহায়তার। কিন্তু এই সহায়তার ক্ষেত্রেও আমরা শুরু করেছি ‘বাড়াবাড়ি’। যথাযথ সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাদ্য বিতরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিনা আমরা। বন্যায় দুর্গতদের ত্রাণ বিতরণের কায়দায় শুরু করেছি করোনার কালেও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ। যে বিষয়টি উল্টো শঙ্কায় ফেলেছে আমাদের সুরক্ষিত থাকার বিষয়টিকে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না।

সরকার যখন ঘোষণা দিলেন, খুব প্রয়োজন ছাড়া আমরা যেনও বাইরে বের না হই। কোনও কোনও অঞ্চলের প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে একটু বেশি ‘বাড়াবাড়ি’ করে ফেলায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় উদ্যোগ। অঘোষিতভাবে শিথিল হয়, কড়াকড়ি। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে আমরা গা ভাসাতে শুরু করলাম গড্ডালিকা প্রবাহে। এটা কি ঠিক হলো? নিশ্চয়ই না। সবকিছুতেই আমরা সরকারকে দোষারোপ করি। প্রশাসনকে দায়ী করি। কিন্তু নিজেদের দায়বদ্ধতা এবং নীতি নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলিনা। নিজেরা যা মানিনা অন্যকে দিয়ে সেটা মানানোর চেষ্টা করি। অন্য সেটা না মানলে দোষ চাপাই রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের ওপর। অবশ্যই সমালোচনা করবো, তবে তার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে নিতে হবে আমাদেরকে। একটা উদাহরণ দেই আমাদের ‘বাড়াবাড়ির।’ গতকাল সিলেটের পুলিশ কমিশনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের। একাধিক স্থানে সামগ্রী বিতরণের জন্য নিজে উপস্থিত হলেও সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হবে না দেখে, তা থেকে বিরত থাকেন তিনি। শহরে প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তির যদি এই অবস্থায় পড়তে হয়, তাহলে অন্যদের কি হবে- তা সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি সচেতন বলে, বিতরণ করেন নি। এজন্য অবশ্যই সাধুবাদ তাঁর পাওনা।

আমরা অবশ্যই খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করবো। তবে সেটা করতে হবে, সাবধানে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে। এ কথা ভুললে চলবে না, যার হাতে আপনি খাদ্যদ্রব্য তুলে দিচ্ছেন তার দ্বারা যেমন আপনি সংক্রমিত হতে পারেন, তেমনই আপনার দ্বারাও সে আক্রান্ত হতে পারে। এ কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, বিতরণকালে যেনও ভিড় না জমে মানুষের। এক্ষেত্রে, সরকার নির্দেশিত পন্থাই উত্তম। সরকার ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। মানবতার কল্যাণে যারা ঘরবন্দি মানুষের হাতে খাদ্য সামগ্রী তুলে দেবেন, তাদেরকেও একই পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তবে, এক্ষেত্রে সদলবলে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অল্প মানুষকে নিয়ে খাবার প্রদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। ব্যক্তি এবং সামাজিক সংস্থাগুলো নিজেদের তহবিল থেকে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে বিতরণ করছে।

অন্যদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান সাহায্য চেয়েছে বিত্তবানদের কাছে, অর্জিত সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারেও তারা আন্তরিকতার কথা বলছে। উদ্যোগ এবং আহ্বান দু’টোই মানবকল্যাণের জন্য এনিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। তবে, এই অভিযোগ যেনও না ওঠে যে, উত্তোলিত টাকা কিংবা সামগ্রী পৌঁছেনি যাদের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল তাদের কাছে। এমনটি যদি হয়, তা হবে খুবই দুঃখজনক। আরেকটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, ফটোসেশনের নামে যেনও সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট না হয় খাদ্য গ্রহীতার। ছবি যদি তুলতেই হয়, সেটা নিজের হাত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। অসহায় মানুষের মুখ দেখানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। তাতে করে দানের চেয়ে নিজের প্রচারটাকে মুখ্য মনে হবে। যাতে করে গ্রহীতার সামাজিক মর্যাদা যেমন ক্ষুণ্ণ হবে, তেমনই বেদনাবিদ্ধ হবে তাঁর মন। তাই এক্ষেত্রে অবশ্যই, অবশ্যই বাড়াবাড়ি পরিহার করে, সংবেদনশীলভাবে পৌঁছে দিতে হবে খাদ্য সামগ্রী। বিশ্বাসের হাতকে সম্প্রসারিত করেই করোনা সংকট মোকাবেলা করতে হবে আমাদের।

‘বাড়াবাড়ি’ নয়, সংযত থাকতে হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে মানবিকভাবে। গাইতে হবে মানবতার জয়গান।

  • অপূর্ব শর্মা: লেখক, সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত