আজিজুস সামাদ আজাদ

০৫ এপ্রিল, ২০২০ ১৮:৩১

করোনায় আক্রান্ত বিশ্ব এবং আমরা

পশ্চিমাবিশ্ব নিজেরাই তাদের নাম দিয়েছে প্রথমবিশ্ব এবং তৃতীয়বিশ্ব নামক তকমাটি আমাদের কপালে সেঁটে দিয়েছে। তাদের প্রচারণার স্বীকার হয়ে আমরাও এটা মেনেই নিয়েছি যে, ধনে-মানে-জ্ঞানে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, নীতি-নৈতিকতায় আমরা তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট। কিন্তু আমার বিশ্বাস, একমাত্র টাকা ছাড়া আর সব কিছুতেই আমরা তাদের সমকক্ষ হবার যোগ্যতা রাখি এবং আমাদের ইতিহাসও তাদের চেয়ে প্রাচীন। এবারের “করোনা” ভাইরাস এই বিষয়টি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এখন এই তথাকথিত প্রথমবিশ্বের এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে তাদের মাস্ক এবং অন্যান্য করোনা প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট হাইজ্যাক করার।

আমাদের প্রবাসী আত্মীয়-স্বজনেরা জানেন ঐসব তথাকথিত প্রথমবিশ্ব কি প্রক্রিয়ায় “করোনা” মোকাবিলা করছে। তারা ধরেই নিয়েছিল যে, এটাও সার্স-মার্স বা অন্যান্য ভাইরাসের মতই একটা স্থানীয় বিষয়। এটাকে তাদের সেই প্রথম বিশ্বের মনোভাবের সাথে মেলালেই বোঝা যায় কেন তারা আগে সচেতন হয়নি। যে কারণে, এই ভাইরাস মোকাবেলায় চীনের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহকে না মেনে, তাদের দৈনন্দিন বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে গিয়েছে। তাদের একেকটা ফুটবল ম্যাচেই ছড়িয়ে পরেছে হাজার হাজার করোনা আক্রান্ত মানুষ। এতদিনে তারা প্রশ্ন তুলেছে চায়নার কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে। চীনে তিন হাজার মারা গিয়েছে নাকি পঞ্চাশ হাজার সেই পরিসংখ্যান নিয়ে তাদের এতো মাথা ব্যথার হয়তো একটা কারণ হতে পারে যে, যারা এই ভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী খেলার চেষ্টা করেছে তাদের ধারনা ছিল এই ভাইরাস চীনকে ধসিয়ে দেবে।

এদিকে আমাদের দেশের এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনো উল্টোপাল্টা বকেই যাচ্ছেন। এটা হচ্ছে না ওটা হচ্ছেনা, “টেস্টেই মুক্তি” ইত্যাদি। আমাদের দেশে মহামারি এখনো আঘাত হানেনি, তবে সময়ও চলে যায়নি। যেখানে রোগটির কোন চিকিৎসাই নেই সেখানে শুধুই পরিসংখ্যানের স্বার্থে টেস্ট করাবার সময় এটা নয়। করোনা ভাইরাসের চূড়ান্ত অবস্থার সময়েও প্রথমবিশ্বের দেশ সমূহেরও সকল সন্দেহভাজন রোগীকে টেস্ট করবার ক্ষমতা নেই। ডাক্তার যখন সকল লক্ষণ এবং রোগীর ইতিহাস দেখে প্রায় নিশ্চিত হয় যে, লোকটির করোনা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে, তখনই শুধু টেস্ট করা হচ্ছে। এটাও ঠিক যে, এই ভাইরাস টেস্ট কিট শুধু দামীই নয়, এই মুহূর্তে দুষ্প্রাপ্যও। সেই তুলনায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতি উপজেলা থেকে সন্দেহভাজন দুজন রোগীকে টেস্ট করাতে বলেছেন শুধুমাত্র জনমনকে আতংকমুক্ত রাখার জন্য এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মিলিয়ন প্রতি টেস্টের সাথে একটা সাযুজ্য রক্ষার জন্য। আমাদের দেশে এখনো করোনার মহামারী আকার ধারণ করেনি। এখনো আরও ১৫/২০ দিন অপেক্ষা করতে হবে আসল পরিস্থিতি বুঝবার জন্য। গণস্বাস্থ্য যদি তাদের প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী ২৫০-টাকায় দেশীয় পরীক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করে এপ্রিলের দশ তারিখের মাঝে দিতে পারে তবে হয়তো আমরা চূড়ান্ত কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবো। নতুবা এই টেস্ট কিটগুলো অনাগত ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ভয়াবহতা মাথায় রেখে আরও সচেতনতার সাথে খরচ করা উচিৎ।

সবচেয়ে বড় কথা, এতো কিছুর পরেও, দেশের বহু মানুষ এখনো লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন ইত্যাদি শব্দের অর্থ, প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে না। একটি আইন তখনই সাকসেসফুল হয় যখন দেশের সকল মানুষের কাছে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতি পায়। আর তখনই আইন অনুযায়ী দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে পানিশমেন্টের ব্যবস্থা নিতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আইনকে সহযোগিতা করে। সকলে এই শব্দগুলো হৃদয়ঙ্গম করে যদি এখন থেকেই মেনে না চলে, তবে এমন সময়ও আসতে পারে যখন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট মাদুরো যে ভাবে ম্যানিলার একটি অঞ্চলে লকডাউন না মেনে কেউ রাস্তায় বের হলে দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদেরও হয়তো সেই একই পথ অবলম্বন করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবে না।

আমাদের অর্থনীতি যে খুব শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়ানো সেটা নয়। সুতরাং, লম্বা সময়ের জন্য অর্থনীতির চাকা বন্ধ থাকলে দেশের অর্থনীতি এমন তলানিতে যেয়ে ঠেকবে যে, আবার নতুন করে আমাদের সব শুরু করতে হবে। কিন্তু হঠাৎ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো খোলার তাগিদ কেন সেটার বোধগম্য উত্তর আমার জানা নেই। ক্ষতি যা হবার হয়ে গিয়েছে ধরে নিয়েও মন্দের ভাল হিসেবে ফ্যাক্টরি মালিকেরা যে সরকারি সিদ্ধান্তের সাথে ঐক্যমত্য পোষণ করে আবার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ।

সেদিন এক পত্রিকায় দেখলাম, একটি স্থানীয় কর্পোরেট হাউজ সেনাবাহিনীকে কিছু চিকিৎসা সংক্রান্ত সরঞ্জাম দিয়েছেন। এই ধরনের খবর সমন্বিত উদ্যোগের বিষয়ে আশান্বিত করে তুলবে সমগ্র দেশবাসীকে। বিশাল বিশাল হাসপাতাল তৈরির বাস্তবতা বিবর্জিত ঘোষণার চেয়ে এধরনের প্রায়োগিক উদ্যোগ অনেক বেশী সফলতা বয়ে আনবে। জরুরী প্রয়োজনে স্টেডিয়ামেও হাসপাতাল বানানো সম্ভব কিন্তু করোনায় আক্রান্তদের সেবা দেবার সরঞ্জামের অপ্রতুলতা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অস্বীকার করার মত কিছু নয়। রপ্তানিমুখী শিল্প সমূহ সরকারের কাছ থেকে ৫০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা পাচ্ছেই, সেটার একটা অংশ যদি ভেন্টিলেশন সরঞ্জাম কেনায় এবং সরকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের বাইরের অংশটির তালিকা তৈরি করে, তাদের হাউজের মাধ্যমে সাময়িক রিক্রুট ও ট্রেনিং ব্যবস্থায় ব্যয় করা হয় তবে সেটা অনেক যুক্তি সঙ্গত হবে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় কে এখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিলে হয়তো আমরা আমাদের দেশকে এই মরণ ব্যাধির প্রকোপ থেকে এবং সম্ভাব্য ভয়াবহ মহামারী পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখতে পারবো।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন সেটাতে আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, দেশ সঠিক নেতৃত্বের হাতে আছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যক্তিস্বার্থ নয় সমষ্টিগত স্বার্থ বিবেচনায় আমাদের সকল কর্ম পরিচালিত হবে এই স্লোগান নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে দুর্যোগ শেষে আমরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে পারবো ইনশাআল্লাহ। পরিকল্পনার সারমর্মটুকু শুধু তিনি উল্লেখ করেছেন, বাকিটুকু আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাহেব জানাবেন। আশা করি তারা কৃষিঋণ সহ সকল ঋণ অন্তত আগামী ছয় মাসের জন্য ফ্রিজ করবেন। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনায় সকল সেক্টরে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি-ফোন বিল আদায় আগামী তিন থেকে ছয় মাসের জন্য বন্ধ রাখাটাও জরুরী এবং ঐ তিন/ছয় মাস পরে এই বিল গুলো আগামী একবছরে সমন্বয় করার ব্যবস্থা নিলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।

আমাদের যাদের মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস যুদ্ধাবস্থার ইতিহাস, ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, তিনলক্ষ মা-বোনের কান্নার ইতিহাস, কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুত হবার ইতিহাসের অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে, তারা জানি একটি বিধ্বস্ত জাতিকে গড়ে তোলাটা কতটা কষ্টের। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শুধু সেই ইতিহাসটুকুই শোনাতে চাই, কিছুতেই চাই না তারাও একটি বিধ্বস্ত দেশ গড়ার দায়িত্ব নিক। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার প্রয়োজন নেই, শুধু বিচক্ষণতা ও সচেতনতার প্রয়োজন। আগে নিজের সচেতনতা বাড়াতে হবে, তারপর দেশবাসীকে সচেতন করতে হবে, তারপর অন্য সব কথা। আমাদের দেশ সঠিক পথে আছে বলেই আমার বিশ্বাস, আর বাকিটুকু, ইনশাআল্লাহ।

  • আজিজুস সামাদ আজাদ: রাজনীতিবিদ ও লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত