ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম

১৭ এপ্রিল, ২০২০ ১৩:২৬

করোনা সংক্রমণের ভবিষ্যৎ: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বলতে গেলে বলবো ভয়াবহ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট যাচাই করে বললে বলতে হবে খুব ভয়াবহ! একটু ব্যাখ্যা দেয়া জরুরি মনে করি। কোভিড-১৯ সংক্রমণ সনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটি বড় দাগে চার ভাগে বিভক্ত।
১. সন্দেহজনক মৃতদের নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে
২. গুরুতর উপসর্গ সম্বলিত রোগীর নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে
৩. উপসর্গ আছে, এপিডেমিওলজিক্যাল লিংকেজ এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং এর মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করে
৪. উপসর্গহীন বা মৃদু সংক্রমণ এর নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে

এবার আমাদের দেশের বাস্তবতায় বলি। এপ্রিল এর প্রথমদিনে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩/৪ জন। এপ্রিলের ১৬ তম দিনে শনাক্ত হয়েছে ৩৪১ জন। ভড়কে যাবেন না, এর ব্যাখ্যা আছে। এপ্রিলের এক তারিখে নমুনা পরীক্ষা হতো এক জায়গায় এখন আঠারো জায়গায়। কাজেই বলাই যায় বেশি পরীক্ষার কারণে রোগী শনাক্তকরণ সংখ্যা বেড়েছে।

শুধু কি এ কারণেই বেড়েছে? না, সংক্রমণও বেড়েছে অনেক। বড় বিপদের কথা হলো সীমিত সম্পদ, সীমিত জ্ঞান, সীমিত প্রশিক্ষিত ল্যাব টেকনিশিয়ান দিয়ে যেভাবে বা যে উদ্দেশ্যে নমুনা সংগ্রহ বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সেটা কাজ করছে না। মৃদু সংক্রমণ, উপসর্গযুক্ত, কন্টাক্ট এক্সপোজারের মানুষকে যত দ্রুত পরীক্ষার আওতায় আনা যেত তত দ্রুত তাদের রোগ নির্ণয় সম্ভব হতো। ফলে দ্রুততার সাথে তাকে কোয়ারেন্টিনের আওতায় এনে রোগ ছড়ানোর গতি অনেকাংশে কমানো যেত।

দুর্ভাগ্যজনক হলো আমাদের এখানে যারা শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার আওতায় আসছেন তাদের বড় অংশ গুরুতর সংক্রমণ। তাদের বেড়ানো ছড়ানো শেষ করে যখন গুরুতর অসুস্থ হচ্ছেন তারাই নমুনা পরীক্ষা করতে আসছেন। এতে আক্রান্তের মৃত্যু হার আপাত অনেক বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে।

আপনার ডিনোমিনেটর বা হর যদি কম বা বেশি সংখ্যার হয় তাহলে একই নিউমারেটর বা লব এর জন্য হর ভিন্ন ভিন্ন হবে। যেমন দুইকে পাঁচ দিয়ে ভাগ করলে যা পাবেন, দুইকে বিশ দিয়ে ভাগ করলে অনেক কম পাবেন। তদুপরি যে হর আপনি ইউজ করছেন সেটায় যখন গুরুতর রোগীর সংখ্যা বেশি হবে তখন লব বা মৃত্যুও বেড়ে যাবে। মানে দাঁড়ালো আমাদের একদিকে নিউমারেটর বাড়ছে, ডিনোমিনেটর কম আসছে তার উপর ডিনোমিনেটর এর বড় অংশ মারাত্মক সংক্রমণ এর রোগী। এই হলো মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা।

খুব ভয়াবহ কেন বললাম-
১. এই রোগ সংক্রান্ত স্টিগমা এমন হয়েছে লোকজন প্রাথমিক উপসর্গ নিয়ে, বা কন্টাক্ট হিস্ট্রি নিয়ে পালিয়ে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে
২. সাধারণ মানুষ তো বটেই নীতি নির্ধারকরাও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারছেন না
৩. এই রোগের মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভাব মারাত্মক রূপ নিয়েছে
৪. ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি
৫. বিশ্বজুড়ে মান সম্মত সুরক্ষা সামগ্রীর ভয়াবহ সংকট বাংলাদেশেও এর মারাত্মক ঘাটতি
৬. সমন্বয়হীনতা ও তথ্য গোপন করা
৭. রিস্ক কম্যুনিকেশনে গাফিলতি বা ব্যর্থতা
৮. বাস্তবায়নকারী ও ব্যবস্থাপকদের বিপদ আঁচ না করার মানসিকতা
৯. সাধারণ মানুষের অসহিষ্ণুতা ও নিয়ম না মানার প্রবণতা
১০. পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা
১১. বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যাচ্ছে তাই অবস্থা
১২. কতিপয় মানুষের চুরি [খাবার, চাল, তেল, টাকা, মানহীন পিপিই, যন্ত্রপাতি]
১৩. গুজব
১৪. মনিটরিং সুপারভিশন (সরেজমিন) এ ব্যাপক ঘাটতি

একে তো রোগ ধরছি শেষ সময়ে (ততদিনে বেড়িয়ে-ছড়িয়ে মাখামাখি) তার উপর এতসব সমস্যা এই করোনা পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার বিষয়টি ক্রমশ দুরূহ করে তুলবে।

কী করা যায় তাহলে? যা করতে বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেগুলো করা। তেলবাজি, ফটোবাজি, চাপাবাজি বন্ধ করে মন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো কাজে পরিণত করা।

ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম: সহযোগী অধ্যাপক, ইপিডেমিওলজি; প্রোগ্রাম ম্যানেজার মেন্টাল হেলথ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত