ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম

০৮ এপ্রিল, ২০২০ ১১:২৭

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আবেগ আর অভিযোগের তফাৎটুকু বুঝবেন আশাকরি

আপনারা জানেন না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কে ভুল বুঝিয়েছে? বলবেন না এই তো! আমি জানি!

যিনি ❛পিপিই❜ আমেরিকায় রপ্তানি করছেন তিনি ভুল বুঝিয়েছেন। যিনি ❛পিপিই❜ এর মজুদ নিজেও জানেন না তিনি ভুল বুঝিয়েছেন। ভুল বুঝিয়েছে মানবিক সহায়তার আশ্বাস দেয়া মহামতি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, এপারেলস, ফোন কোম্পানি, ওষুধ কোম্পানি, যারা এক টাকা দিয়ে কখনও না দিয়েও পত্রিকা ভরে ভরে নিউজ করেছেন। ভুল বুঝিয়েছেন সিএমএসডির পরিচালক মহোদয় যিনি দুইটা ভালো পিপিই-এর সাথে আ টটা বাজারের ব্যাগ দিয়েছেন, এন ৯৫ এর বদলে সাধারণ মাস্ক দিয়েছেন।

মহাপরিচালক মহোদয় আদিষ্ট হয়ে যোগফল বলে যাচ্ছেন, কোন ধরনের পিপিই কয়টা আছে না বলে ওনিও ভুল বুঝিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। ভুল বুঝিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ব্যবস্থাপকদের অনেকেই, তারা প্রশাসকদের সাথে গলা মিলিয়ে বলেছেন সব ঠিক সব ঠিক। ভুল বুঝিয়েছে চাল চোর গম চোরেরা যাদের বাড়ীতে ত্রাণ এর টন টন চাল নিয়ে রেখেছে। ভুল বুঝিয়েছে তারা যারা একবার পোশাক কারখানা খুলে আবার বন্ধ করে জীবাণুতে সারাদেশ মাখিয়েছে।

একবার যে বলে ৫০০ ভেন্টিলেটর অথচ কোভিড ডেডিকেটেড ১১২ টি সে ভুল বুঝিয়েছে। ভুল বুঝিয়েছেন দাতারা যারা এখনও বসে বসে পরিকল্পনা করছেন, আর ঘনঘন সভা করে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ আল জাজিরায় রিপোর্ট করাচ্ছেন যে ফোন নেটওয়ার্ক নাই তাই রোহিঙ্গাদের মধ্যে করোনা ছড়াবে। ভুল বুঝিয়েছে চিকিৎসক নেতারা, তাদের নমিনেশন ছুটে যায় কিনা, আরে ভাই বাঁচলে তো এমপি হবি নাকি?

আমি ত শুধু সত্যিটুকু বলার অপরাধে অপরাধী হলাম। একটা চশমা আরএন ৯৫ পরে ফ্লু কর্নারে রোগী দেখবো, আর কাভারঅল পরে কোভিড-১৯ রোগী এটেন্ড করবো এটাই তো চেয়েছি, এর বেশি তো না! আপনি খোজ নেন তো, কাগুজে রিপোর্ট না সত্যি খোজ নেন তো। এই ডাক্তারগুলা নার্সগুলা আক্রান্ত হলে কে চিকিৎসা চালাবে?

ঠিক আছে, আর কোথাও বলবো না, কিছুই লিখবো না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উত্তেজনায় আবেগে কিছু বলে ফেলেছি, কষ্ট পেয়েছেন। আপনি তো মা, জাতির পিতার কন্যা আপনার একটু আধটু ঝারি বকা, এক চুল গায়ে মাখি না আমরা। এই মুহূর্তে কাউকে যদি দেশের মানুষ তথা ডাক্তার রা কাওকে অন্ধের মত ভরসা করে সেটা আপনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

আমার প্রতিবন্ধী বড় ছেলেটা রাতে আমার সাথে ঘুমাতো। এখন ঘুমায় না তিন সপ্তাহ, আমি বাইরে কাজ করি ভয়ে ওকে রাতে কাছে রাখিনা। ওর ছবিটা আমার কাভার ছবি, সেটা দেখি সারাদিন। মেয়েটা ঘরে ঢুকলে দৌড়ায়ে চুমু খেত, আসতে দেই না। মেজো ছেলেটার, ইন্টার পরীক্ষার্থী, ফোন নিয়ে নিয়েছিলাম ফিরিয়ে দিয়েছি, মরেই যদি যাই ওদের কষ্ট দিয়ে কী হবে। বউটা সারাদিন কথা বলতো, হাসতো, ঝগড়া করতে, গম্ভীর হয়ে গেছে ও ওতো ডাক্তার, ২৮ বছরের সংসার, দুঃখগুলো বুঝে নিয়েছে মনে হয়। আমার কাজের মানুষ রূপবান, দৌড়ায় চা নিয়ে আসতো এখন কাছে আসে না। ড্রাইভার হারুন, তেল মবিলের চাহিদা তার কখনো ফুরাতো না, এখন চুপ করে গাড়ি চালায়, কিছুই বলে না।

আমি শক্ত মানুষ তারপরও কালকে কাঁদলাম অনেকক্ষণ। নারায়ণগঞ্জের যে বৃদ্ধ ইমাম মারা গেলেন তার ছেলেটা চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছে আহারে আমার বাবা যখন অন্যের জানাজা পড়াতেন হাজার হাজার মানুষ তার পিছনে দাঁড়াতো আজ তার জানায় পাঁচজন। আজকে আমার জন্য জাতির যে অভিশাপ, যে ঘৃণা তাতে তো মনে হয় লাশ রাস্তাতেই পড়ে থাকবে। সহকর্মীরা হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে দূর থেকে।

আমি ত মানুষও, আমার পেশার দায়িত্ব যেমন আছে, সংসার, ভালোবাসা, ভয় সব কিছুই আছে। আমরা না হয় অনেক বেঁচেছি, তরুণ চিকিৎসকরা আছে বঙ্গবন্ধুর নামে এদের কারো কারো চোখে আগুন জ্বলতে দেখেছি, বুঝিয়ে বলবেন, শুনবো, আপনার কথাটাই শুধু শুনবো। শুধু অনুরোধ মিথ্যাবাদী, চোরগুলাকে লাথি মারবেন কষে। ঠিক যতটুকু দরকার, সামর্থ্যমতো যতটুকু পারেন, যেখানে দরকার দিয়ে দিবেন। করোনা চলে যাক, যদি ততদিন খোদা হায়াত দেন তো বলে যাবো যে মহামারীতে কী করে মিথ্যার ছড়াছড়ি, চুরির মালের কাড়াকাড়ি হয়।

যে মিথ্যাবাদী, ভণ্ডের দল আমার হাসি কান্নার, আশা ভালোবাসার জায়গাটাতেও ঘৃণা ছড়িয়েছে, আমার শেষ ভরসার জায়গাটাকে নড়বড়ে করেছে, আপনাকে ভুল বুঝিয়ে যাচ্ছে, আমি তাদের করুণা করি, অভিশাপ দেই। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মত আমার প্রজন্ম তোদের প্রকাশ্যে বিচার করবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার জন্য অশেষ দুআ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। আবেগ আর অভিযোগের তফাতটুকু বুঝবেন আশাকরি।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

  • ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম: সহযোগী অধ্যাপক, ইপিডেমিওলজি; প্রোগ্রাম ম্যানেজার মেন্টাল হেলথ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত