০২ মে, ২০২০ ০২:১৫
অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ। স্কেচ: কুমার অনিক কুন্ডু
আজ থেকে এক বছর আগে আজকের দিনে অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। দিন তারিখ হিসেবে আজ ২ মে ২০২০ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। মনির উদ্দিন আহমদ শুধুমাত্র একজন আইনজীবীই ছিলেন না; তিনি ছিলেন শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং সর্বোপরি একজন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ। তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনের অধিকাংশ সময় চা শ্রমিক ও ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি শ্রমিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিক, কৃষক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সংগঠন সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসজনিত মহামারির উদ্ভূত পরিবেশের মধ্যে মহান এ ব্যক্তির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদন হিসেবে তাঁরই জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে এই লেখার অবতারণা।
সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ মুক্ত শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ কায়েমের জন্য আজীবন লালিত স্বপ্নদ্রষ্টা মনির উদ্দিন আহমদ ১৯২৩ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন আসাম প্রদেশের কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি মহকুমার তাঁর নানার মালিকানাধীন কুচিলা চা বাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আব্দুর রহমান ও মায়ের নাম মস্তুরা খাতুন। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাদেপাশা ইউনিয়নের সতুনমর্দন গ্রামের ‘ডেপুটি বাড়ি’ তাঁর পৈতৃক নিবাস। মনির উদ্দিন আহমদ ‘ডেপুটি বাড়ি’ সংলগ্ন ডেপুটি বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৪১ সালে হাইলাকান্দি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক, ১৯৪৩ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৪৫ সালে শিলচর গুরুচরণ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এমএ পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাজনিত পরিস্থিতির কারণে পড়ালেখা শেষ না করেই কলকাতা থেকে চলে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে এমএ এবং একই বছর এলএল বি ডিগ্রি লাভ করেন। সনদ প্রাপ্ত হয়ে তিনি ১৯৫০ সালের ১৭ জানুয়ারি সিলেট জেলা বারে যোগদান করে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
বিজ্ঞাপন
আইন পেশায় একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও সততার জন্য তরুণ আইনজীবী হিসেবে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তিনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল মিলিয়ে অর্ধ-শতাব্দীরও অধিক সময় একনিষ্ঠভাবে আইন পেশায় অতুলনীয় অবদান রাখেন। আইন পেশার সাথে সাথে তিনি আইনজীবীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করাসহ একাধিকবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭২-১৯৮৩ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে সিলেট জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এর দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি আইন পেশার পাশাপাশি সিলেট ল’ কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৮২-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সিলেট ল’ কলেজের উপাধ্যক্ষ এবং ১৯৮৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯ বছর সিলেট ল’ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সম্মানের সাথে দায়িত্ব পালন করে উক্ত কলেজটিকে দেশের একটি অন্যতম আইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পরীক্ষক ও মডারেশন কমিটির সদস্য এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি গোলাপগঞ্জ কুশিয়ারা কলেজ, পল্লিমঙ্গল হাসপাতাল, সিলেট শহরের চালিবন্দরে অবস্থিত বসন্ত মেমোরিয়াল শিশু একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এক অনন্য সৃষ্টিশীল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
ছাত্রজীবনেই মনির উদ্দিন আহমদ রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪০ সালে তিনি তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন’ এ যোগ দেন এবং ওই বছরই উক্ত ছাত্র সংগঠনের হাইলাকান্দি মহকুমা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কাছাড় জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে ১৯৪৬ সালে তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং অনুধাবন করেন সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যতীত জনগণের মুক্তি আসবে না। এসব ভাবনায় তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তন হয় এবং ১৯৫০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। তখনকার সময়ে কমিউনিস্ট পাটির নেতৃত্বে প্রদেশব্যাপী তেভাগা কৃষক আন্দোলন এবং সিলেট অঞ্চলে কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে নানকার প্রথা বিরোধী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন।
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর ‘সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’র প্রথম সভা এবং ১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ গোবিন্দ পার্কের (হাসান মার্কেট) জনসভায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়েও তরুণ আইনজীবী হিসেবে অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হতাহতের ঘটনার খবর সিলেটে পৌঁছলে তিনিসহ আইনজীবীরা আদালত ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদেরকে নিয়ে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করেন। উক্ত সমাবেশ থেকে ধর্মঘট আহবান করা হয় এবং সিলেটের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০-২৫ দিন ধর্মঘট পালিত হয়।
সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট ভারত ও পাকিস্তানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে মনির উদ্দিন আহমদ দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং মাহমুদ আলীর নেতৃত্বাধীন সিলেট জেলা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী শান্তি কমিটির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ কমিটির নেতৃত্বে ৬/৭ শত হিন্দু মুসলিম ছাত্র যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের প্রতিহত করে। এমনি এক পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ সরকারের নানাবিধ জনবিরোধী কাজ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবিলায় একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গঠন করার নিমিত্তে ছাত্রদেরকে সংগঠিত করে ১৯৫১ সালের ১৬ নভেম্বর প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারিসহ বিভিন্ন বাধা উপেক্ষা করে সিলেট শহর থেকে ১৮ মাইল দূরে ফেঞ্চুগঞ্জ থানাধীন বড় দুইটি টিলার আড়ালে সভা করে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ‘সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন’ গঠন করার ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন। এর ৫ মাস পর ঢাকায় প্রগতিশীল ছাত্রদের নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়ন’ গঠিত হলে সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের শাখা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়ায় অন্যান্যদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা যায় তাঁরা হলেন আসাদ্দর আলী, তারা মিয়া, অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন আহমদ, পীর হবিবুর রহমান, মওলানা শামসুল হক প্রমুখ।
১৯৫০ এর দশকে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রগতিশীল ছাত্র-যুব নেতারা ‘পূর্ব-পাকিস্তান যুব লীগ’ গঠন করেন। মনির উদ্দিন আহমদ ‘পূর্ব-পাকিস্তান যুব লীগ’ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সংগঠন সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন। হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংগঠন ‘গণতন্ত্রী দল’ গঠিত হলে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে মনির উদ্দিন আহমদ গণতন্ত্রী দলে যোগ দেন। তিনি গণতন্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠন প্রক্রিয়ায় অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) এর প্রাদেশিক কমিটির সদস্য এবং সিলেট জেলা শাখার প্রথম কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞাপন
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রেসিডেন্ট মহামতি কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় এসে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের বিপরীতে সামনে আনে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’, ‘শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা’ ও ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ’ এর সংশোধনবাদী তত্ত্ব। এই আকস্মিক বক্তব্যে বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি ও পার্টিতে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে মনি সিংহ, বারীন দত্তের নেতৃত্বে পার্টির একাংশ ক্রুশ্চেভের নীতি সমর্থন করেন। কমরেড আব্দুল হক, মোহাম্মদ তোহা, সুখেন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে পার্টির অপর অংশ মনি সিংহ এর বক্তব্যের বিরুদ্ধে থিসিস দাখিল করেন। এ নিয়ে মতাদর্শিক প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টি ও পার্টি প্রভাবাধীন ন্যাপসহ সকল গণ-সংগঠন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। মনির উদ্দিন আহমদ কমরেড আব্দুল হকদের বিপ্লবী লাইনকে সমর্থন করে সংগঠন সংগ্রামে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে গত শতকের আশির দশকে মাও সেতুং এর ‘তিনবিশ্ব তত্ত্ব’-কে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিতর্ক শুরু হলে কমরেড আব্দুর হকের নেতৃত্বে ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’-কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মাও সেতুং চিন্তাধারা তথা ‘তিনবিশ্ব তত্ত্ব’কে সংশোধনবাদী শ্রেণি সমন্বয়ের প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব হিসেবে যে মূল্যায়ন উপস্থাপন করেন মনির উদ্দিন আহমদ এর সাথে একাত্ম থাকেন।
অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ আইন পেশা ও রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনেও আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লেবার ইউনিয়ন, সিলেট ইলেকট্রিক সাপ্লাই শ্রমিক ইউনিয়ন, আজিজ গ্লাস ফ্যাক্টরি শ্রমিক ইউনিয়ন, সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি প্রভৃতি সংগঠনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত চা শ্রমিকদের প্রতি তিনি বিশেষ আন্তরিক ছিলেন। অবহেলিত চা শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জননেতা মফিজ আলী’র সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা রাখেন এবং পূর্ব-পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ এর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের সকল শ্রমিক সংগঠনকে একত্রিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি শ্রমিক, চা শ্রমিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের সংগঠিত করে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের মাধ্যমে সকল শ্রমিক সংগঠনকে একত্রিত করে ‘পূর্ব-পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন’ গঠিত হলে অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ এর সহসভাপতি নির্বাচিত হন। উক্ত সম্মেলনের আলোচনাসভা ও সাবজেক্ট কমিটির সভায় মনির উদ্দিন আহমদ সভাপতিত্ব করেন। এদেশের সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দিপুঁজি বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা কমরেড আব্দুল হকের সাথে তাঁর ছিল গভীর আদর্শিক সখ্যতা। আমৃত্যু তিনি সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অবিচল থেকে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রেখে গেছেন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এবং এর সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, চা শ্রমিক সংঘ, জাতীয় ছাত্রদল আয়োজিত বিভিন্ন সমাবেশ ও কর্মসূচিতে বক্তব্য প্রদান করেন।
সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আন্দোলন সংগ্রামের জন্য মনির উদ্দিন আহমদকে বিভিন্ন সময় কারাবরণ করতে হয়। গণতন্ত্রী দল করার সময় ১৯৫৩ সালে তিনি প্রথম কারাগারে যান এবং ২১ দিন কারাভোগ করেন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ৯২(ক) ধারা জারির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে গভর্নরের শাসন জারি করেন। তখনকার সময় যুক্তফ্রন্ট ও প্রগতিশীল কর্মীদেরকে গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি আবারো গ্রেপ্তার হন। এসময় জেলের মধ্যে রাজবন্দিদেরকে সফট ক্যাম্প ও হার্ড ক্যাম্প দুই ভাগে আলাদা করে রাখা হতো। আওয়ামী লীগার কর্মীদেরকে সফট ক্যাম্পে আর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত প্রগতিশীল কর্মীদেরকে হার্ড ক্যাম্পে রাখা হতো। সফট ক্যাম্পের বন্দিদেরকে কয়েক মাস পরেই ছেড়ে দিত আর হার্ড ক্যাম্পের বন্দিদেরকে দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকতে হতো। মনির উদ্দিন আহমদ হার্ড ক্যাম্পের কারাবন্দি হিসেবে প্রথমে সিলেট ও পরে স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকা কারাগারে এক বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৯ সালে ভাসানী ন্যাপের সিলেট জেলার সভাপতি হিসেবে গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি আবারো গ্রেপ্তার হন এবং এক মাস কারাভোগ করেন। ঘটনাচক্রে দেখা যায়, তাঁর বাবা যে জেলের জেলার রাজনৈতিক কারণে সেই জেলেই তিনি তিনবার জেল খাটেন।
অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, কর্ম জীবন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি থেকে স্বর্ণপদক সম্মাননা, সিলেট জেলা পুলিশ প্রশাসন থেকে ‘অমর একুশে বই মেলা-২০১১’ সম্মাননা, সিলেট ল’ কলেজ, গোলাপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন। ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ভাষাসৈনিক সম্মাননা ২০২০ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।
ব্যক্তি জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। মহান এই ব্যক্তি ২০১৯ সালের ২ মে দিবাগত রাত ১১.৪৫ টা সময় সিলেট মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন শেষে তাঁকে হযরত শাহজালাল (রহ:) মাজারের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
‘চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাবো- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ এর প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ছিল একটি নতুন বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার। এ লক্ষ্যে ছাত্র অবস্থা থেকে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে লড়ে গেছেন তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। সমাজতন্ত্রই মানব মুক্তির একমাত্র পথ- এ ছিল তাঁর দৃঢ় উপলব্ধি।
অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম: আইনজীবী এবং অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ-এর শোকসভা পালন কমিটির সদস্য।
আপনার মন্তব্য