সিলেটটুডে ডেস্ক

০৫ জুলাই, ২০২৫ ১২:০১

অনুদানের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলেন সরকারি কমিটির সদস্যরা

২০২৪-২৫ অর্থবছরের সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে।

এ বছর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ১২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে ৯ কোটি টাকা এবং ২০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে ৪ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। যেখানে স্বজনপ্রীতি ও অনুদান কমিটির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

গুরুতর হচ্ছে, যারা অনুদান দেবেন তারাই এবার নিয়েছেন অনুদান! আরও রয়েছে বিস্তর অনিয়ম। এদিকে তালিকা প্রকাশের পর থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিবেশক ও শিল্পীদের মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যেসব পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে তার বেশির ভাগই নিয়ম ভেঙে অনুদান দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বেশির ভাগ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজকরা।

সিনেমা নির্মাণের জন্য অনুদান পাওয়া মো. আবিদ মল্লিক চলচ্চিত্র অনুদান উপ-কমিটির সদস্য। অন্যদিকে সাদিয়া খালিদ রীতি রয়েছেন চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং চলচ্চিত্র অনুদান স্ক্রিপ্ট বাছাই কমিটির সদস্য। অনুদান পাওয়া তালিকায় আরও রয়েছেন মো. আরিফুর রহমান (চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি), মুশফিকুর রহমান (চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি), লাবিব নাজমুস ছাকিব (ফিল্ম আর্কাইভ বিশেষজ্ঞ কমিটি সদস্য), মোহাম্মদ সাইদুল আলম খান (তথ্য মন্ত্রণালয় সংস্কারে সার্চ কমিটি সদস্য)।

এদিকে অনুদান পাওয়া প্রযোজক মাহমুদুল ইসলাম হলেন আগের অনুদান পাওয়া নির্মাতা হুমায়রা বিলকিসের স্বামী। হুমায়রা বিলকিস ১৮-১৯ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ‘বিলকিস এবং বিলকিস’ এখনো মুক্তি দেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্মাতা বলেন, ‘তদবির এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেশাদাররাও প্রতি বছর অনুদান পান। এতে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে।’

উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে শুধু স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে রাতারাতি চলচ্চিত্র প্রযোজক বনে গেছেন তালিকার বেশির ভাগই। যারা নিকেতনপাড়াকেন্দ্রিক বলেও জোর কথা উঠেছে। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মূলধারার বা এফডিসিকেন্দ্রিক মানুষ অনুদান থেকে হয়েছেন বঞ্চিত।

চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে অভিনেতা-নির্দেশক তারিক আনাম খান বলেন, ‘আমি আসলে এ বিষয়ে আদৌ অবহিত নই। যদি অভিযোগগুলো সত্য হয়, তাহলে তা কাম্য নয়। আর স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব থাকলে তা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। আগেও জেনেছি কিছু আন্ডারহ্যান্ড কাজ হয়েছে। এখনো যদি চলমান থাকে, তা কখনোই প্রত্যাশা করি না। আর অনুদানে কয়েকটি সিনেমা ছাড়া বেশির ভাগ কিন্তু আশাব্যঞ্জক হয়নি। তাই ক্রাইটেরিয়া কী, ম্যারিট কী, যোগ্য স্ক্রিপ্ট বুঝে অনুদান দেওয়া উচিত বলে মনে করি।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘আমি মনে করি, যে সব স্ক্রিপ্ট জমা পড়েছে, সেগুলো দিয়েই তো পিচিং করবে। তো, একই দিনে ৯০টি সিনেমার পিচিং! এটা তো একটা বিশ্বরেকর্ড। ৯০ জনের পিচিং একসঙ্গে নিলে কেমনে হবে? অবশ্য এটি বাংলাদেশেই সম্ভব। এমনিতেই স্বজনপ্রীতি তো আমাদের জাতিগত সমস্যা। আগে যারা ছিল তারা তো বাংলাদেশের লোক, এখন যারা আছে তারাও কিন্তু বাংলাদেশের লোক! আসলে এই দুর্গতি থেকে আমাদের কোনো মুক্তি নেই।’

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম ডি শামসুল আলম বলেন, ‘সরকারের টাকা মানে জনগণের টাকা। কোটি কোটি টাকার এই সরকারি অনুদান চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কোনো কাজেই আসবে না। তাই অনুদানের নামে সরকারি টাকা ধ্বংস করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

এদিকে নির্মাতা নুরুল আলম আতিক বলেন, ‘জানি না কারা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা পাননি তাঁদের ঠকানো হয়েছে কি না! তবে একটা দিক ভালো লেগেছে, এবার অনেক তরুণ নির্মাতা অনুদান পেয়েছেন। তাঁরা ভালো করলে চলচ্চিত্রের জন্য সম্ভাবনা তৈরি হবে। অন্যদিকে শুনেছি, একই ধরনের কমিটিতে [চলচ্চিত্রবিষয়ক পরামর্শক কমিটি] থেকেও কেউ কেউ অনুদান পেয়েছেন। এটা ঠিক হয়নি। তাঁদের আবেদন করাটাই তো উচিত নয়। আপনি যখন সরকারি কোনো কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তখন তো সুযোগ নেওয়াটা অন্যায়।’

অন্যদিকে জুরি বোর্ডের সদস্য ও নির্মাতা আকরাম খান বলেন, ‘আমরা যে ছবিগুলোকে সর্বোচ্চ মার্ক দিয়েছি সেই ছবিগুলোই অনুদান পেয়েছে। হলফ করে বলতে পারি, কোনো চাপ ছাড়াই আমরা আমাদের কাজ করতে পেরেছি। কেউ যদি অনুদান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাহলে সেটা ঠিক হবে না।’

তবে এফডিসিপাড়ার মূলধারার বেশ কিছু নির্মাতা অভিযোগ করে বলেন, ‘বিগত সময়ের মতো এবারও মূলধারার সিনেমাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে, চলচ্চিত্র শিল্পে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পরিবর্তে এই শিল্প দিনে দিনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হচ্ছে। অথচ সুস্থধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ দিতে ১৯৭৬ সালে চালু হয় সরকারি অনুদান প্রথা। অনুদান প্রদানের অদূরদর্শিতার কারণে অনেক অনুদানের সিনেমা এখনো আলোর আলোর মুখ দেখেনি। আগামীতেও অনুদান পাওয়া ছবিগুলো আদৌ মুক্তি পাবে কি?’

যেসব পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান পাচ্ছে
শিশুতোষ শাখায় জগন্ময় পালের প্রযোজনায় 'রবিনহুডের আশ্চর্য অভিযান'।

প্রামাণ্যচিত্র শাখায় লাবিব নামজুছ ছাকিবের প্রযোজনায় 'মায়ের ডাক'।

রাজনৈতিক ইতিহাস (আবহমান বাংলার সকল রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, আন্দোলন ও বিপ্লব- যা এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নিয়ামক) শাখায় মাহমুদুল ইসলামের 'জুলাই'।

সাংস্কৃতিক ইতিহাস (বাংলার ঐতিহ্য, মিথ ও ফোকলোর সংক্রান্ত) শাখায় হাসান আহম্মেদ সানির প্রযোজনায় 'রুহের কাফেলা'।

সাধারণ শাখায় সিংখানু মারমার প্রযোজনায় 'পরোটার স্বাদ', সৈয়দ সালেহ আহমেদ সোবহানের প্রযোজনায় 'খোঁয়ারি', এম আলভী আহমেদের প্রযোজনায় 'জীবন অপেরা', গোলাম সোহরাব দোদুলের প্রযোজনায় 'জলযুদ্ধ', মুশফিকুর রহমানের প্রযোজনায় 'কবির মুখ The Time Keeper', আনুশেহ আনাদিলের প্রযোজনায় 'কফিনের ডানা', মোছা. সাহিবা মাহবুবের প্রযোজনায় 'নওয়াব ফুজুন্নেসা', সুজন মাহমুদের প্রযোজনায় 'জুঁই'।

যেসব স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান পাচ্ছে
শিশুতোষ শাখায় মাহবুব আলমের প্রযোজনায় 'মন্দ-ভালো'।

প্রামাণ্যচিত্র শাখায় সাব্বিরের প্রযোজনায় 'ফেলানী', তাফজিরা রহমান সামিয়ার প্রযোজনায় 'ঝুঁকির মাত্রা' এবং জাহিদ হাসানের প্রযোজনায় 'জীবনের গান'।

রাজনৈতিক ইতিহাস শ্রী অভীক চন্দ্র তালুকদারের প্রযোজনায় 'হু হ্যাজ মেইড আস ফ্লাই', মোহাম্মদ সাইদুল আলম খানের 'ভরা বাদর' এবং সালমান নূরের '১২৩০'।

সাংস্কৃতিক ইতিহাস শাখায় শুভাশিস সিনহার প্রযোজনায় 'বৃন্দারাণীর আঙুল'।

সাধারণ শাখায় সাদমান শাহরিয়ারের প্রযোজনায় 'একটি সিনেমার জন্য', মো. সাইদুল ইসলামের প্রযোজনায় 'দাফন', মোহাম্মদ ইফতেখার জাহান নয়নের প্রযোজনায় 'সাতীর', নোশিন নাওয়ারের প্রযোজনায় 'মাংস কম', সুমন আনোয়ারের প্রযোজনায় 'গগন', মো. আবিদ মল্লিকের প্রযোজনায় 'অতিথি', সালজার রহমানের প্রযোজনায় 'বোবা', সাদিয়া খালিদের প্রযোজনায় 'অদ্বৈত', মো. আরিফুর রহমানের প্রযোজনায় 'আশার আলো', মো. মনিরুজ্জামানের প্রযোজনায় 'গর্জনপুরের বাঘা'।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত