নিউজ ডেস্ক

২৭ এপ্রিল, ২০১৫ ০৩:২৩

সালমান শাহ: আদালতের আদেশে স্থগিত হয়ে গেলো মামলার পুনতদন্ত কার্যক্রম

মহানগর দায়রা জজ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহের মৃত্যুর ঘটনার পুনতদন্ত কার্যক্রম। মামলাটির বাদীর আবেদন অনুসারে ‘হত্যা মামলা’টির র‍্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া সংক্রান্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আদেশ স্থগিত করেছেন মহানগর দায়রা জজ আদালত।

রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আব্দুল্লাহ আবুর একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. কামরুল হোসেন মোল্লা গত ১৯ এপ্রিল এ আদেশ দেন।

সালমান শাহের মা নীলুফার চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীর এক নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালত মামলাটি পুনর্তদন্ত করতে র্যাচবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সোমবার (২৭ জুলাই) মামলাটির পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য রাখা হয়েছে।

প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন, নাকি তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল সে বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়নি গত ১৮ বছরে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টে এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলা হলেও তাঁর পরিবার একে পরিকল্পিতভাবে হত্যা হিসেবে মামলা করে যেখানে সালমান শাহ’র স্ত্রী সামিরা হককে অভিযুক্ত করা হয়।

সালমানের স্ত্রী সামিরা জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরার মেয়ে। নারাজি আবেদনে আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন তার ছেলে সালমান শাহের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকাকালে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় নায়ক চৌধুরী মোহাম্মাদ ইমনের, রুপালি পর্দায় যিনি সালমান শাহ নামে পরিচিত। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর ইস্কাটনে নিজের বাসার ড্রেসিং রুমে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

লাশের সঙ্গে একটি চিরকুট পাওয়া যায়, যাতে লেখা ছিল- “আজ বা আজকের পরে যে কোনো দিন আমার মৃত্যু হলে তার জন্য অন্য কেউ দায়ী থাকবে না। আমি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে আত্মহত্যা করছি।”

সালমান শাহকে উদ্ধারের পর প্রথমে হলি ফ্যামিলি ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকা মেডিকেলে ময়নাতদন্তে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে আত্মহত্যার কথা বলা হয়।

তদন্ত শেষে গোয়েন্দা পুলিশ একে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রতিবেদন দিলে তাতে নারাজি দেন সালমানের বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী।

এরপর সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণের কবর থেকে সালমানের লাশ তুলে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানকার ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক দল মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।

পরে সালমানের বাবা কমরউদ্দিন তার ছেলের মৃত্যুকে একটি ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ দাবি করে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন।

এরপর ফের গোয়েন্দা পুলিশ এবং পরে সিআইডির তদন্তেও আত্মহত্যার কথা বলা হলে সেসব প্রতিবেদনে নারাজি দেন সালমানের বাবা। পরে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত চলে। এর মধ্যে সালমানের বাবাও মারা যান।

দীর্ঘ তদন্তের পর ঢাকার মহানগর হাকিম এমদাদুল হক সালমান শাহকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে গত ৮ ডিসেম্বর সালমান শাহর মা জাতীয় পার্টির নেত্রী নীলুফার চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীকে ২১ ডিসেম্বর আদালতে হাজির হতে নোটিস দেওয়া হয়। ওই নোটিস পেয়ে তিনি আদালতে হাজির হন।

মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন প্রথমে একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন। মামলা প্রথমে রমনা থানা পুলিশ পরে ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির তদন্ত করেন। তদন্তকালে সালমান শাহর মরদেহের প্রথম ময়নাতদন্ত করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

প্রতিবেদনে তারা সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে বর্ণনা করে। পরে সালমান শাহর পরিবার ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আপত্তি দিলে মরদেহ কবর থেকে তুলে ফের ময়নাতদন্ত করা হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

তাদের প্রতিবেদনে মরদেহ অত্যধিক পচে যাওয়ায় মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি বলে বলা হয়।

১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির ‘আত্মহত্যার’ কথা উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদী পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড দাবি করে নারাজি দেন।

নারাজিতে তিনি সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক, জনৈক আবুল হোসেন খান, গৃহপরিচারিকা ডলি, মনোয়ারা বেগম, সিকিউরিটি গার্ড আব্দুল খালেক, সামিরার আত্মীয় রুবি, এফডিসির সহকারী নৃত্য পরিচালক নজরুল শেখ ও ইয়াসমিন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে দাবি করেন।

নারাজির পর আদালতের আদেশে ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মজিবুর রহমানের ওপর তদন্তের ভার পড়ে। এ তদন্ত কর্মকর্তাও অভিযোগের সত্যতা পাননি বলে উল্লেখ করেন। এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই সালমানের বাবার ডিওএইচএসের (জোয়ার সাহারা) বাসায় রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ নামে এক যুবক আসে।

মিথ্যা পরিচয়ে ওই যুবকের বাসায় প্রবেশের অভিযোগে তাকে ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় রিজভীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি সালমান শাহকে হত্যার কথা স্বীকার করে তার সহযোগী হিসেবে ডন, ডেভিড, ফারুক, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মাদ ভাই, সাত্তার, সাজু, সালমান শাহের স্ত্রী সামিরা, সামিরার মা লতিফা হক লুসি ও রুবি নামে একজনের নাম বলেন। পরে ১৯৯৭ সালের ২২ জুলাই আদালতে তার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা হয়।

এরপর বাদী সালমানের বাবা কমরউদ্দিন অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করেন। আদালত ১৯৯৭ সালের ২৭ জুলাই অপমৃত্যুর মামলা এবং ক্যান্টনমেন্ট থানার মামলা একত্রে তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দেয়।

সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার খালেকুজ্জামান প্রায় সাড়ে তিন মাস তদন্তের পর ১৯৯৭ সালের ২ নভেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাদীপক্ষ মামলাটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলছে। রিজভী নামে একজন হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকারও করেছেন।

“কিন্তু রিজভীকে পরে জেলখানায় জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি বলেন, সালমান শাহ হত্যার বিষয়ে তার কিছুই জানা নেই। এতে প্রমাণিত হয় যে, তার স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রদত্ত ছিল না।”

সালমান শাহর মৃত্যুর কারণ নিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “মূলত সালমান শাহর সঙ্গে নায়িকা শাবনূরের ঘনিষ্ঠতার কারণে তার স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহের সূচনা হয়। দাম্পত্য কলহের কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেন, যা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সমর্থন করে। তাই সালমান শাহর মৃত্যু আত্মহত্যাই।”

আদালতে ওই প্রতিবেদন দাখিল হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ফের নারাজি দাখিল করা হয়, যার ভিত্তিতে আদালত ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন।বিচার বিভাগীয় তদন্তে সালমান শাহর বাবা কমরউদ্দিন ও মা নীলা চৌধুরীসহ ৫ জন সাক্ষ্য দেন।

২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। এরপর প্রায় ১২ বছরে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল। দীর্ঘদিন ধরে বাদীপক্ষ আদালতে সাক্ষী হাজির না করায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল বিলম্বিত হয়।

গত বছরের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। ওই প্রতিবেদনেও সালমান শাহের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত