শিবতোষ ভট্টাচার্য

১০ জুন, ২০২০ ০৪:৩১

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ৫ শতক

একটা সময় ছিল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ৫০ রান করলেই দলে তাদের জায়গা পাকা করে ফেলতে পারতেন। কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশ দল এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এবং গত চার-পাঁচ বছরে যথেষ্ট পরিমাণ শতক উপহার দিয়েছে।

এ নিবন্ধে খেলার পরিস্থিতি ও ইনিংসের গুরুত্ব বিবেচনা করে সম্ভাব্য সেরাগুলোকে বাছাই করার জন্য।

সাকিব ১২৪ * বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ
বিশ্বকাপের মত আসরে ৩০০ রানের লক্ষ্য অতিক্রম করা সবসময়ই একটি কষ্টসাধ্য কাজ। কিন্তু ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব যেন এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নিজের জাত চেনাবেন সমগ্র বিশ্বের সামনে। এই ম্যাচের আগে তিনি বিশ্বকাপে একটি শতক ও দুটি অর্ধ শতকসহ তিন ম্যাচে ২৬০ রান করেছিলেন।

যা হোক সাকিব তার ইনিংস শুরুটা করেছিলেন ধীরস্থিরভাবে। প্রথমে তামিম ইকবালের সাথে ৬৯ রানের সময় উপযোগী একটি পার্টনারশিপ গড়েন যা রান তাড়ার জন্য খুব ভালো একটি ভিত্তি গড়ে দেয়।  তামিম রানআউট হওয়ার পর মুশফিক খুব বেশি সময় উইকেটে স্থায়ী হতে পারেননি।

 

মুশফিক আউট হওয়ার পর লিটন দাস শুরু থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের উপর চড়াও হয়ে খেলা শুরু করেন, যার ফলে অন্যপ্রান্তে সাকিব নির্ভার হয়ে খেলতে থাকেন। সাকিব যেসময়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ততক্ষণে বাংলাদেশ জয়ের সুবাতাস পেতে শুরু করেছিল। ম্যাচের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব বিবেচনায় এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংসগুলোর একটি। ইনিংসের শুরু থেকে শেষ অবধি সাকিবের এই ইনিংস নান্দনিক সব ক্রিকেট শর্ট দিয়ে সাজানো ছিল।

১২৪ রানের এই ইনিংসটি সাজিয়ে ছিলেন ১৬টি বাউন্ডারি দিয়ে এবং এই ইনিংসে তার স্ট্রাইক রেট ১২৫.২৫। সহজ ভাষায় বলতে গেলে তিনি পুরো ইনিংসটা খেলেছেন কোন ধরনের বাড়তি ঝুঁকি ছাড়াই। উপরন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের বাউন্সারের পরিকল্পনাকে অকার্যকর করেছিলেন নিয়মিত পুল শর্ট খেলে।

মাহমুদউল্লাহ ১০৩ বনাম ইংল্যান্ড
২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে  জয়টি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি জয়। আর এই জয়ের জন্য ভিত্তি তৈরি করতে মাহমুদউল্লাহর লড়াকু সেঞ্চুরির অবদান অনেকখানি। দ্রুত টপঅর্ডার ব্যাটসম্যানদের উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ত্রাতা হয়ে দলের হাল ধরেন মাহমুদউল্লাহ। মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ার নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায় দলের খারাপ সময়েই তার সেরা খেলাটা বের হয়।

বরাবরের মত এদিনও মাহমুদউল্লাহ ইনিংসের শুরুর দিকে উইকেটে থিতু হওয়ার জন্য একটু সময় নিয়েছেন। তৃতীয় উইকেট জুটিতে সৌম্য সরকারের সাথে ৮৬ রানের পার্টনারশিপে দলের প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দেন। সৌম্য ক্রিস জর্ডানদের লেগ স্ট্যাম্পের বাইরের একটি বল খোঁচা দিতে গিয়ে ব্যক্তিগত ৪০ রানে জস বাটলারের কাছে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন। এরপর সাকিবও খুব বেশি সময় উইকেটে স্থায়ী হতে পারেননি। সাকিব আউট হওয়ার পর মুশফিকুর রহিমের সাথে ১৪১ রানের জুটি গড়ে খেলার নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের পক্ষে আনতে সমর্থ হন।

এই ইনিংসের পুরোটা জুড়েই ছিল দৃষ্টিনন্দন পুল শর্টের সমাহার। যদিও মাহমুদউল্লাহর স্ট্রাইক রেইট তুলনামূলকভাবে কম ছিল কিন্তু ৪৬ ওভার পর্যন্ত তার উপস্থিতি পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল। তাছাড়া এটি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশ দলের প্রথম শতক ছিল।

সাকিব ১১৪ বনাম নিউ জিল্যান্ড
সাকিব আল হাসান বরাবরই ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে ব্যাটিং উপভোগ করেছেন। এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৫ ম্যাচে ৫৭.২১ গড়ে ৮০১ রান করেছেন, যার মধ্যে ৩টি শতক ও ৫টি অর্ধশত রয়েছে। তার স্নায়ুচাপবিহীন চরিত্রই (nerveless character) তাকে অন্য যেকোনো বাংলাদেশ ক্রিকেটার থেকে আলাদা করে। হয়ত এজন্যই দলের মধ্যে লক্ষ্য তাড়াতে তিনি বাংলাদেশ দলের মধ্যে সবচাইতে পটু।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেমিফাইনালে ওঠার জন্য নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে জয়ের বিকল্প ছিলনা বাংলাদেশের কাছে। ২৬৬ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে সাউদির আগুনে বোলিংয়ে ৩৩ রানে ৪ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ তখন ধুঁকছিল। সেখান থেকে সাকিব মাহমুদউল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণাত্মক কৌশলে নিউ জিল্যান্ডের শক্তিশালী বোলিং লাইনআপকে মাটিতে নামিয়ে আনেন।

বরাবরের মত এই ইনিংসেও সাকিব অফসাইড দিয়েই বেশি শর্ট খেলেন এবং সাকিব খেলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকই স্কয়ারের সর্বোত্তম ব্যবহার। ইনিংসের শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিলেন এবং তার খেলা দেখে একবারের জন্য মনে হয়নি তিনি চাপে আছেন বা এত বড় টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে দ্রুত উইকেট হারিয়ে দল বিপদে আছে। তিনি ১১৪ রানের ইনিংস খেলতে বল খরচ করেন ১১৫টি, যার ছিল ১১টি চার ও একটি ছক্কা দিয়ে সাজানো।

লিটন দাস ১২৩ বনাম ভারত এশিয়া কাপ
বাংলাদেশের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের ইতিহাসে আগ্রাসী মানসিকতা নিয়ে ইনিংসের শুরু থেকে শেষ অবধি খেলার নিদর্শন নেই বললেই চলে। লিটন দাস এই ইনিংস দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। যার ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে আমরা তাকে দেখেছি জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১৭১ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলতে।

আগের ম্যাচে উইকেটের পেছনে সহজ সুযোগ ছাড়ায় দর্শকদের দুয়ো শুনতে হয়েছিল। হয়তবা সেজন্যই তিনি ফাইনাল ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে তিনি শুরু থেকেই বদ্ধপরিকর ছিলেন ভালো কিছু করার জন্য। তামিম ইকবাল আগের ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে যাওয়ায় লিটন দাসের সাথে মেহেদি মিরাজ ওপেন করতে নামেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই যা লিটনের কাজকে আরও কঠিন তোলে, কিন্তু তিনি শুরু থেকেই ভারতের মানসম্পন্ন পেস ও স্পিন বোলিংয়ের বিরুদ্ধে চড়াও হয়ে ব্যাটিং করতে থাকেন।

উদ্বোধনী জুটিতে লিটন দাস ও মেহেদি মিরাজের আক্রমণাত্মক ব্যাটিং প্রথম ২০ ওভারে বাংলাদেশ ভারতকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছিল। মেহেদি মিরাজ ব্যক্তিগত ৩২ রানে আউট হলে তখন দলের বিপর্যয় শুরু হয়। লিটন দাস একপ্রান্তে অবিচল থাকলেও একমাত্র সৌম্য সরকার ছাড়া আর কেউ দুই অঙ্কের ঘরে পোঁছাতে পারেননি। লিটন দাস ভারতের স্পিনারদের নিখুঁত সুইপ শর্টের দ্বারা তাদের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেন। ১১৭ বলে ১২১ রানের ইনিংসে তিনি ১২টি চারের ও দুটি ছয়ের মার দ্বারা সাজান যা দলের মোট রানের প্রায় ৬০ শতাংশ। তার ইনিংসটা আরও বড় হতে পারত কিন্তু দলগত ব্যর্থতায় শেষ পর্যন্ত ১২১ রানে কাটা পড়ে। রোমাঞ্চকর এই ম্যাচে যদিও শেষ পর্যন্ত ভারত জিতেছিল কিন্তু লিটন দাস তার অসাধারণ সেঞ্চুরির জন্য ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।

মুশফিকুর রহিম ১৪৪ বনাম শ্রীলঙ্কা
তামিম ইকবাল আঙুলের ইনজুরি পড়ার পর লাসিথ মালিঙ্গার বোলিং তোপে লিটন দাস ও সাকিবকে হারিয়ে বাংলাদেশ যখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল তখন মুশফিকুর রহিম ত্রাতা হয়ে দলের হাল ধরেছিলেন। চতুর্থ উইকেটে মোহাম্মদ মিঠুনের সঙ্গে ১৩১ রানের জুটিতে শুরুর দিকের ধাক্কা সামাল দেন।

মিঠুন ৬৩ রানে আউট হওয়ার পর অন্যদিকে ব্যাটসম্যানরা যেখানে যাওয়ার আসার মিছিলে ব্যস্ত ছিলেন সেখানে মিস্টার ডিপেন্ডেবল সমহিমায় উইকেটে টিকে ছিলেন এবং অসাধারণ ক্রিকেট শর্টে দর্শকদের আনন্দ দিচ্ছিলেন। মুশফিকুর রহিম তার অন্য পাঁচ-দশটা ইনিংসের মত এই ইনিংসেও তার শক্তির জায়গা মিড-উইকেট অঞ্চল দিয়ে সিংহভাগ রান করেছিলেন। ১৪৪ রানের এই ইনিংসে ১১টি চার ও ৪টি ছয় মারেন এবং সবচেয়ে বড় কথা একদিকে টানা উইকেট পড়া সত্ত্বেও তিনি ৯০ এর উপর স্ট্রাইক রেট ধরে রেখেছিলেন।

একজন ক্রিকেটার হিসেবে মুশফিক যে কতখানি উন্নতি করেছেন এই ইনিংসটা এরই একটি জলজ্যান্ত প্রমাণ। একদিকে উইকেটে পড়লেও তিনি অন্যপ্রান্তে টিকে ছিলেন যার ফলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ২৬১ রানের একটি লক্ষ্য দিতে সক্ষম হয়। যদিও এই ম্যাচটা তামিম ইকবালের বীরত্বের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার হাতের আঙুল ভাঙার পরও তিনি সর্বশেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামেন যার ফলে মুশফিক শেষের দিকে ঝড়ো ব্যাটিং করে দলের স্কোরকে একটি সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত