আবু বক্কার লিটন

১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ১৬:১৯

স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ ও নতুন জীবনে আলামিন

প্রতীকী ছবি

সিলেটের বালাগঞ্জের আলামিন দুই ভাই, এক বোন ও বাবা-মাসহ বাস করতেন গ্রামে। অধিক আয় উপার্জন, সংসারে সচ্ছলতা ও উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্ন কাকে না ভাবায়! বেকার আলামিন হঠাৎ স্বপ্ন দেখেন ইউরোপে পাড়ি দেবেন। ২০১৮ সালে দালালের প্ররোচনায় পড়ে টুরিস্ট ভিসায় দুবাই এবং মিশরে ট্রানজিট ব্যবহার করে প্রথমে লিবিয়াতে যান। কাজের দক্ষতা, অনুমতিপত্র কিংবা ভাষা দক্ষতা কিছুই ছিল না। বিদেশ যাওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন দালালের কথামতো। লিবিয়া ছিলেন বছর খানেক অনিয়মিত অভিবাসী হিসেবে। সেখানে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে রাস্তা নির্মাণের কাজ করতেন।

লিবিয়াতে ১ বছরে মাত্র তিন মাস কাজ করতে পেরেছেন ৬০ হাজার টাকা বেতনে, বাকি সময় কোন কাজই করা সম্ভব হয়নি তার। হঠাৎ একদিন লিবিয়াতে মাফিয়াচক্রের কবলে পড়েন এবং বন্দি হন। মাসখানেক বন্দি করে রেখে বিভিন্নধরনের অমানুষিক নির্যাতন চালাত তারা। এই চক্র আলামিনের কাছে মুক্তিপণের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করে। বাংলাদেশ থেকে তার পরিবার ভিটেমাটি বিক্রি করে পাঁচ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ পরিশোধ করলে মাফিয়ারা তাকে ছেড়ে দেয়।

এদিকে, আলামিনের ইউরোপ যাবার স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে না। ইতালিতে যাওয়ার জন্য লিবিয়া থেকে মাছ ধরার ট্রলারে করে বাংলাদেশের দালালের মাধ্যমে আবারও ২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নতুন চুক্তি করেন। দুই লক্ষ টাকা তার বাড়ি থেকে জোগাড় করে দেওয়া হয় জমি বিক্রি করে। মাছ ধরার ট্রলারে রাতের অন্ধকারে রওনা দেন অভিবাসীদের মৃত্যুকূপ হিসেবে পরিচিত ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে। সাবেক শাসক গাদ্দাফির পতনের পর থেকে লিবিয়া অভিবাসী পাচারকারীদের অন্যতম প্রধান রুট। এ রুটে অনেক অভিবাসী ইউরোপে যাওয়া শুরু করেন। পাচারকারীরা প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ ট্রলারে করে অভিবাসীদের সাগরে ভাসিয়ে দেয়।

জাতিসংঘের তথ্য মতে, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা গেছে এই ভূমধ্যসাগরে ট্রলার/নৌকাডুবিতে। ভাগ্য ভালো আলামিনের। সেদিন ট্রলারডুবির মতো ঘটনার শিকার হননি। কিন্তু আলামিনসহ আরও ১০০ জন অভিবাসী নিয়ে প্রায় তিরিশ ঘণ্টা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে মাল্টা সীমানায় পৌঁছে যাওয়া ট্রলারটি মাল্টার কোস্টগার্ডের হাতে পড়ে। মাল্টার জেলের ক্যাম্পে ১৬ মাস বন্দি রাখা হয় তাদের। ক্যাম্পে প্রায় ৩০টি দেশের মানুষ আটক রয়েছেন যাদের উদ্দেশ্য অভিন্ন। স্বপ্নের দেশ ইতালিতে যাওয়া। মাধ্যম সমুদ্র পথে পাচারকারী বা দালাল।

মাল্টা ক্যাম্পে বাংলাদেশি প্রায় তিনশত অভিবাসী এখনও বন্দি আছেন। বন্দিদের ধীরে ধীরে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। মাল্টাতে তিন মাস আটকে রাখার পরে অনেককে রাস্তায় চলাচল ও কাজের জন্য অনুমতিপত্র দেওয়া হয়, কিন্তু আলামিন সে সুযোগও পাননি। আলামিনসহ আরও ৪৩ জনকে মাল্টার ক্যাম্প থেকে অন্য দেশে হস্তান্তর করা হবে বলে স্পেশাল ফ্লাইটে তোলা হয়। ১২ জানুয়ারি ২০২১ ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাত ১১.৩০ মিনিটে নেমে ভাগ্যহত লোকজন জানতে পারেন তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে জানলে তাদের কেউ বিমানে ওঠতেন না বলে জানান সবাই। তাদের আহাজারির সাক্ষী না হলে তাদের এই নির্মম বেদনা বুঝা যাবে না।

আলামিন বিদেশ পাড়ি দেওয়ার জন্য সর্বমোট ১৪ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। দেশে ফিরেছেন শূন্য হাতে, এক কাপড়ে। একজন আলামিন নয় এরকম হাজারো জীবন থেকে নেওয়া গল্প আছে। আলামিনরা ভালো করে না বুঝে, না জেনে পাচারকারী দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন দিনের পর দিন। নিজের জীবন বিপন্ন করছেন। একইসঙ্গে নিঃস্ব ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের পরিবারটিও। আলামিন ভাগ্যগুণে জীবিত দেশে ফিরছেন। এটাই আপাতত তার পরিবারের জন্য স্বস্তির খবর।

যারা এরকম দালালের ফাঁদে পড়ে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন সবাই ঘুরে দাঁড়াবেন কোন না কোন কাজের মাধ্যমে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করছে ২০০৬ সাল থেকে। মাল্টা ফেরত ৪৪ জন অভিবাসীদের তাৎক্ষণিক সহযোগিতার জন্য ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের একটা বড় টিম সারা রাত অপেক্ষা করেছে বিমানবন্দরে। অভিবাসীরা বাইরে আসলেই তাদের খাবার, পানি, পরিবারের সাথে কথা বলানো, রাতে থাকার ব্যবস্থা, কাউন্সেলিং করা এবং তাদের পরিবারের কাছে নিরাপদে হস্তান্তর করেছেন। পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম সার্বিক সহযোগিতা করবে। সমস্ত কাজটি সাথে আমরা থাকতে পেরে অনেক গর্বিত মনে করছি।

আবু বক্কার লিটন: ডিসট্রিক্ট কো-অর্ডিনেটর, ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম

আপনার মন্তব্য

আলোচিত