দেবাশীষ দেবু

২১ ফেব্রুয়ারি , ২০২১ ১৫:৩০

ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া নাগরি লিপি

জন্মদিন উপলক্ষে মাহাদীকে একটি বই উপহার দিয়েছেন বাবা ময়নুল হাসান। বইটি বর্ণমালার। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মাহাদীকে বর্ণমালার বই উপহার দেয়ায় বাবার প্রতি প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিল সে। কিন্তু পরে দেখতে পায় এই বর্ণমালাগুলো অন্য রকম।

বাবা তাকে জানিয়েছেন, এসব বর্ণমালার উচ্চারণ বাংলা বর্ণমালার মতোই। তবে লেখার ধরন ভিন্ন। এই লিপির নাম নাগরি।

নতুন লিপির সন্ধান পেয়ে এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে মাহাদী। ইতিমধ্যে কয়েকটি নাগরি লিপি শিখেও ফেলেছে সে।

মাহাদীর বাবা কলেজশিক্ষক ময়নুল হাসান বলেন, ‘ছেলেকে নাগরি লিপির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই এই বইটি উপহার দিয়েছি। নতুন প্রজন্ম যদি না জানে, তা হলে তো এই লিপি হারিয়েই যাবে।’

কেবল ছোট্ট মাহাদীই নয়, নাগরি লিপি সম্পর্কে বড়রাও তেমন একটা জানেন না। এই লিপির চর্চা, ব্যবহারও নেই অনেক বছর ধরে। ফলে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলা ভাষার বিকল্প এই লিপি। অথচ নাগরি লিপিতে একসময় লেখা হয়েছে প্রচুর বই। এই সংখ্যা দুই শতাধিক। শিল্পীরা গান লিখেছেন। কোরআন শরিফও লেখা হয়েছে নাগরি হরফে।



নাগরি লিপির উদ্ভব

চতুর্দশ শতকে ৩৬০ সফরসঙ্গী নিয়ে সিলেটে আসেন হজরত শাহজালাল (রহ.)। তিনি সিলেটে আসায় সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি হয়। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে উদ্যোগী হন মুসলমানেরা। লেখাপড়া, সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসেন তাদের অনেকে। অনেক গবেষকের মতে, এই সময়ে স্বতন্ত্র একটি লিপি তৈরি করেন তারা, যা নাগরি লিপি নামে পরিচিত। এরপর থেকে বাংলা ভাষার প্রচলিত বর্ণমালার বাইরে পৃথক আরেকটি বর্ণমালার ব্যবহার শুরু হয়।

তবে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এ অঞ্চলে আফগান উপনিবেশ স্থাপিত হয়। এ সময় নাগরী লিপির উৎপত্তি হয়। আবার আরেক পক্ষের মতে, ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে এ লিপির উদ্ভব। তবে বেশির ভাগ গবেষকই মনে করেন, হজরত শাহজালাল ও তার সফরসঙ্গীদের মাধ্যমে সিলেটে নাগরি লিপির প্রচলন ঘটে।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. আশ্রাফুল করিম বলেন, হজরত শাহজালাল (রহ.) ও তার সফরসঙ্গীরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে আসেন। সবার ভাষা ছিল আলাদা। আবার এই অঞ্চলের ভাষা ছিল বাংলা। তাই সবার সঙ্গে যোগাযোগের স্বার্থে তারা বাংলা ভাষার আলাদা একটি লিপির প্রচলন করেন।

বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান কবি মোহাম্মদ সাদিক নাগরি লিপি নিয়ে পিএইচডি করেছেন। ‘সিলেটি নাগরি: ফকিরি ধারার ফসল’ নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি।

ড. সাদিক শনিবার বলেন, ‘আমার মনে হয় নাগরি লিপি ব্যবহার করতেন সিলেট অঞ্চলের ফকিরেরা। শাহজালাল এবং তার সফরসঙ্গীরাও ফকির ছিলেন। অনেক লিপি আছে নিজেদের ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়। ফকিরেরা তাদের তত্ত্বকথা লেখার জন্য এই লিপি তৈরি করেন। ফকিরেরা তাদের তত্ত্বকথা গোপন রাখতেন। এগুলো যাতে কেবল তারা নিজেরা ও তাদের শিষ্যেরা পড়তে পারেন এবং অন্যরা যাতে পড়তে না পারেন, তাই এই বিকল্প লিপি চালু করা হয়। ফলে নাগরি লিপির বইয়ের প্রায় সবগুলোই বাউল-ফকিরদের তত্ত্বকথা, গান ও আখ্যান নির্ভর।’

তিনি বলেন, এই লিপি সর্বসাধারণের জন্য ছিল না। সর্বসাধারণের জন্য হলে তো রাজকার্যেও এটি ব্যবহৃত হতো।

তার মতে, ফকিরদের লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশের পর মানুষজন এই লিপি সম্পর্কে জানতে পারে।

নাগরি লিপির বর্ণ সংখ্যা ৩২টি। বর্ণনাম এবং উচ্চারণ হুবহু বাংলার মতো। নাগরি বর্ণমালায় একই উচ্চারণে একাধিক বর্ণ পরিহার করা হয়েছে। বর্ণগুলো হচ্ছে : আ, ই, উ, এ,ও, ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, র, ল, ড়, শ, হ।

গবেষকদের মতে, ইসলামি নানা কাহিনি, সুফিবাদ ও ফকিরি গান রচনা থেকে শুরু করে হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে তখন নাগরি লিপি ব্যবহার হতো। সিলেট ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ভৈরব এবং ভারতের করিমগঞ্জ, শিলচর ও আসামে এ লিপির ব্যবহার ছিল। তবে গত শতাব্দির মাঝামাঝি সময় থেকে এ লিপির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে আসে। একপর্যায়ে তা একেবারে হারিয়েই যায়।

নাগরি লিপিতে সাহিত্য

নাগরি লিপি সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারে কাজ করছেন প্রকাশক মোস্তফা সেলিম। তিনি বলেন, নাগরি লিপিতে দুই শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই পুঁথি সাহিত্য। তবে এসব বইয়ের অনেকগুলো হারিয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

১৫৪৯ সালে গোলাম হোসেনের লেখা ‘তালিক হুসন’ বইটিই নাগরি লিপি লেখা প্রথম গ্রন্থ বলে ধারণা গবেষকদের। ১৮৬০ সালে সিলেটে নাগরি লিপির ছাপাখানা চালু হয়। নগরের বন্দরবাজার এলাকায় ‘ইসলামিয়া ছাপাখানা’ চালুর পর নাগরি লিপিতে সাহিত্যের জোয়ার সৃষ্টি হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ছাপাখানাটি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সিলেট ছাড়াও কলকাতা, শিলচর ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে নাগরি লিপিতে রচিত পুঁথি প্রকাশিত হতো। এ ধারা বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলমান ছিল। সিলেট অঞ্চলে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তখন নাগরি লিপিই বেশি জনপ্রিয় ছিল বলে মত গবেষকদের।

এই লিপির বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার সম্পর্কে মানুষজন অবগত নয় উল্লেখ করে মোস্তফা সেলিম বলেন, ‘নাগরি সাহিত্য নিয়ে মানুষজন তেমন অবগত ছিল না। তবে আমরা বই প্রকাশের পর এ নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এখন অনেকে নাগরি লিপিতে লেখা বই সংগ্রহ করে বাংলা মূল লিপিতে রূপান্তর করছেন।’

তিনি বলেন, ‘নাগরি লিপি নিয়ে মানুষজনের জানাশোনা ভাসা ভাসা। অনেকে মনে করেন, এটি সিলেটি ভাষারই একটি লিপি। আদতে নাগরি লিপি কোনো উপভাষার লিপি নয়। এটি বাংলা ভাষারই একটি বিকল্প লিপি। নাগরি লিপির বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার রয়েছে।’


নাগরি লিপির পুনর্জাগরণ

সিলেট নগরের প্রবেশদ্বার কিনব্রিজ। এই সেতুর উত্তর পাড়ের চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে নাগরি চত্বর। ২০১৪ সালে নাগরি বর্ণমালা দিয়ে এই চত্বরে একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

গত ডিসেম্বরে সিলেটে হাফ ম্যারাথনের আয়োজন করে সিলেট সাইক্লিং কমিউনিটি। সে ম্যারাথনের থিম ছিল নাগরি লিপি। সিলেটের বিভিন্ন লাইব্রেরি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানেও ইদানীং নাগরি লিপির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।

সিলেট নগরের কিনব্রিজ এলাকায় স্থাপিত নাগরি চত্বর।

ফলে গত শতকের মাঝামাঝি থেকে হারিয়ে যেতে বসা লিপি এই শতকে এসে বিস্মৃতির ছাইভস্ম থেকে আবার জেগে উঠছে। নাগরি লিপির ব্যবহারের পাশপাশি এ নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে ইদানীং।

নাগরি লিপির পুনর্জাগরণে কাজ করা গবেষক ও প্রকাশক মোস্তফা সেলিম বলেন, ‘এখন সংবদপত্রগুলো নাগরি লিপি নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। টেলিভিশন টক শো করে। গবেষকেরা গবেষণা করছেন। আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও এরকম ভাবাই যেত না। এই লিপি তো প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। এই কদিন আগেও সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নাগরি লিপির বিভিন্ন বই উপহার দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, আগের মতো এই লিপির চর্চা হয়তো বাড়বে না। কিন্তু এখন আর এটি হারিয়ে যাবে না। বরং বাংলা ভাষার একটি বিকল্প লিপি হিসেবে গৌরবের সাথে টিকে থাকবে। এই লিপি নিয়ে মানুষ এখন গৌরব করে।

নাগরি লিপি চর্চায় পুনর্জাগরণে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে কম্পিউটারে নাগরি ফন্ট উদ্ভাবন। ১৯৯৪ সালে কম্পিউটার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার নামের কম্পিউটার বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই খায়রুল আক্তার চৌধুরী ও ফয়জুল আক্তার চৌধুরী তাদের যুক্তরাজ্য প্রবাসী চাচা নাগরি লিপির গবেষক আবদুল জলিল চৌধুরীর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে নাগরি ফন্ট উদ্ভাবন করেন।

তবে ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, ‘এই লিপি ঐতিহ্য হিসেবে থেকে যাবে। কিন্তু এর পুনর্জাগরণ কতটুকু সম্ভব হবে তা আমি নিশ্চিত নই। এটির ব্যবহার এখন খুব একটা হবে না।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত