দেবাশীষ দেবু

২০ মার্চ, ২০২১ ১৩:৪৩

যেভাবে গ্রেপ্তার শাল্লার হামলায় অভিযুক্ত স্বাধীন মেম্বার

সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামে হামলার ক্ষেত্র তৈরি এবং দিরাইয়ে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ নিয়ে খোঁজখবর নিতে শুক্রবার রাতে দিরাইয়ের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে হেফাজতের সমাবেশে স্থানীয় একাধিক নেতার সহযোগিতার অভিযোগ নিয়ে মূলত এই যোগাযোগ।

এরইমধ্যে শুক্রবার রাত ১১টার দিকে সুনামগঞ্জের দিরাই থেকে এক যুবলীগ নেতা কল দেন। তার সঙ্গেও আমার আগে কখনও কথা হয়নি। তিনি জানান, শাল্লায় হামলা ও ভাঙচুরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকা শাল্লার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ওরফে স্বাধীন মেম্বার পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চান। স্বাধীনের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে সহযোগিতা চান তিনি।

এর কিছু সময় পরেই কল দেন আলোচিত স্বাধীন মেম্বার। স্বাধীন বলেন, ‘আমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাই। এ ব্যাপারে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছি।’ স্বাধীন জানান, তিনি কুলাউড়ায় রয়েছেন এবং কোতোয়ালি থানা-পুলিশের সঙ্গে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে কথা বলেছেন। এনিয়ে রাতে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরে এক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।

এরপর আমি কথা বলি সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি মোসাইদ রাহাতের সঙ্গে। স্বাধীন পরিচয়ে যে নম্বর থেকে কল দেওয়া হয়েছে সেটি আসলেই স্বাধীনের কি না, এনিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে বলি। মোসাইদ রাহাত তথ্য সংগ্রহ করে জানান এটি স্বাধীনের নম্বর।

এরপর সিলেটের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ফোন দিয়ে স্বাধীন মেম্বারের আত্মসমর্পণের আগ্রহ কথা জানালে তিনি জানান, স্বাধীন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে তিনি (স্বাধীন) আত্মসমর্পণ করতে চাইলে পুলিশ সহায়তা করবে। আমাদের কুলাউড়া প্রতিনিধি এস আলম সুমন কথা বলেন কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে। কুলাউড়ায় স্বাধীনের অবস্থান সম্পর্কিত কোনো তথ্য তার কাছে নেই বলেও জানান ওসি।

বিষয়টি নিয়ে মোসাইদ রাহাত কথা বলেন সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমানের সঙ্গে। মিজানুরও জানান, স্বাধীন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে তিনি আত্মসমর্পণ করতে চাইলে পুলিশ তাকে সব ধরনের সহায়তা করবে। এমনকি তিনি যে জায়গায় আছেন, সে জায়গায় গাড়ি পাঠানো হবে। রাহাতকে এসপি অনুরোধ করেন, তিনি যেন স্বাধীনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। সম্ভব হলে রাহাত যেন গাড়ি করে গিয়ে স্বাধীনকে নিয়ে আসেন। সব ব্যবস্থা করবেন বলেও জানান এসপি।

মোসাইদ রাহাতের কাছ থেকে এইধরনের তথ্য জানার পর আবার কথা বলি স্বাধীন মেম্বারের সঙ্গে। সুনামগঞ্জের এসপির বক্তব্য তাকে জানানোর পর তিনি এসপির সাথে যোগাযোগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি তাকে এসপির নম্বর দিই। এরপর দিরাইয়ের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ মিয়াও ফোন করে অনুরোধ করেন, স্বাধীনের সঙ্গে আলাপ করে আত্মসমর্পণে রাজি করাতে। এরপর আবার স্বাধীনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এর কিছুক্ষণ পর স্বাধীন আবার কল দিয়ে জানান, তিনি এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা তাকে নিয়ে যেতে আসছেন। তবে কোন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন তার নাম জানাতে পারেননি তিনি।

এভাবে রাত সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কয়েকবার কল দিয়ে কথা বলেন স্বাধীন। তবে আমি কল দিতে গেলেই তার ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম। এরপর যখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন, রাত ২টা ১৭ মিনিটে কল দেন র‌্যাব-৯-এর মিডিয়া কর্মকর্তা এএসপি ওবাইন। তিনি কল দিয়ে বলেন, ‘আপনি কোথায় আছেন। আপনার সাথে জরুরি প্রয়োজন।’ বাসায় আছি জানালে বলেন, ‘আমি আপনার বাসায় আসি। বাসার ঠিকানা বলেন?’

এত রাতে র‌্যাব কর্মকর্তা বাসায় আসার কথা শুনে প্রথমে কিছুটা বিব্রত হই। আধঘণ্টার মধ্যেই র‌্যাব-৯-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার মো. আসাদুজ্জামানসহ আরও দুজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বাসার সামনে হাজির এএসপি ওবাইন। তারা স্বাধীন মেম্বারের ব্যাপারে তথ্য জানতে চান। আমি আমার সঙ্গে স্বাধীনের আলাপচারিতার সব তথ্য তাদের জানাই। তাদের অনুরোধে আমি স্বাধীনের মোবাইলে আবার কল দিই। তবে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

র‌্যাব-৯-এর অধিনায়ক আমাকে বলেন, ‘স্বাধীন কুলাউড়ায় আছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এখন তাকে গ্রেপ্তারে আপনার সহযোগিতা চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনের সাথে অন্য লোক দিয়ে আমরা যোগাযোগ করেছি। সে আপনার উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করতে চায়।’

আমি তাকে জানাই, ‘স্বাধীনের সাথে আমার কোনো পরিচয় নাই। আজকেই প্রথম কথা হয়েছে। শাল্লার ঘটনার আগে তার নামও আমি জানতাম না।’ জবাবে র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, ‘সে কোনো কারণে আপনাকে বিশ্বাস করেছে। এখন আপনার উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করতে চায়।’

আমার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই মোবাইল ফোনে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন র‌্যাব-৯-এর অধিনায়ক। এরপর তিনি আমাকে তাদের সঙ্গে কুলাউড়া যেতে অনুরোধ করেন। আমি সিলেটটুডের প্রধান সম্পাদক কবির য়াহমদ ও নিউজবাংলার সহসম্পাদক রাকিব খানকে অবহিত করে তাদের সঙ্গে কুলাউড়া যেতে সম্মত হই। তারা আমাকে বাসা থেকে প্রথমে নিয়ে যান র‌্যাব-৯-এর প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে তারা যখন অভিযানে যাওয়ার জন্য গাড়ি ও টিম প্রস্তুত করছিলেন, তখনই র‌্যাব-৯-এর অধিনায়কের মোবাইলে বার্তা আসে স্বাধীন গ্রেপ্তার হয়েছে। পরে জানতে পারি স্বাধীনকে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কুলাউড়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপর র‌্যাব কর্মকর্তারা গাড়ি করে আমাকে আবার বাসায় পৌঁছে দেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত