ফরিদ আহমেদ

১২ নভেম্বর, ২০১৫ ১৫:০৯

পাগলা সাহেব হিকি

কোলকাতায় ছিলেন এক পাগলা সাহেব। নাম তাঁর জেমস অগাস্টাস হিকি। একজন আইরিশম্যান তিনি। ভারতবর্ষে ইংরেজ আমলের একেবারে শুরুর দিকের ঘটনা এটি। 

এই পাগলা সাহেব, পাগলামি করতে করতে ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় কাজ করে গিয়েছিলেন। ভারত উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ইংরেজি পত্রিকাটা বের হয়ে এসেছিলো তাঁর হাত দিয়ে। শুধু ইংরেজি বলে নয়, এটিই ছিলো ভারতে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। এর আগে অন্য কোনো ভাষায় পত্রিকা বের হয় নি গোটা ভারতবর্ষের কোথাও।

সালটা সতেরো শ' আশি। শীতকাল। জানুয়ারি মাসের ঊনত্রিশ তারিখ। বের হয়ে এলো এক পত্রিকা। নাম বেঙ্গল গেজেট। কোলকাতার ইতিহাসের প্রথম পত্রিকা। ভারতের ইতিহাসেরও। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে যে, ইংল্যান্ডে লন্ডন টাইমস তখনও বের হয় নি। বের হয়েছিলো এর আরো আট বছর পরে। 

সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিলো এটি। প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত বের হতো কাগজটি। দুটি করে পাতা থাকতো। বারো বাই আট ইঞ্চি - এই ছিলো কাগজের আকার। দুই পৃষ্ঠাতেই ছাপা থাকতো তিন কলাম। হিকি সাহেবে পাগলা লোক হলেও ব্যবসা বুঝতেন খুব। খবর যতটা না থাকতো তার পত্রিকায়, তার চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকতো বিজ্ঞাপন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতে থাকা বৃটিশ সৈন্যদের মধ্যে পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু ব্রিটিশদের মধ্যেই যে এটি জনপ্রিয় হয় তা নয়, ভারতীয়দেরকে বিশেষ করে কোলকাতার শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যেও এটি জনপ্রিয় হয়ে  অঠে। শুধু যে জনপ্রিয় হয় তাই নয়। এটি বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশের জন্য দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে তাঁদেরকে। বেঙ্গল গেজেট পত্রিকাটি দুই বছর চালু ছিলো মাত্র। কী কারণে বন্ধ হলো, বলছি সেটা।

হিকি সাহেব ছাড়া এই পত্রিকায় আর কোনো সাংবাদিক ছিলো না। তিনিই এর সম্পাদক, তিনিই সাংবাদিক, তিনিই প্রকাশক। তিনি নিজে যে রকম খবর জোগাড় করতে পারতেন, সে রকম খবরই ছাপতেন। তবে, রসালো কেচ্ছার প্রতি তাঁর নজর ছিলো একটু বেশি পরিমাণে। আমাদের দেশের মানবজমিন পত্রিকা বা হালের অনলাইন পত্রিকা প্রিয় ডট কমের মতো। পাগলা হিকি লোকজনের নানা রকমের রসাল নামকরণ করে রসের হাট বসাতেন বেঙ্গল গেজেটে। কাউকে পরোয়া করতেন না তিনি। লাট সাহেবের প্রসঙ্গ থাকলেও, তা  বাদ যেতো না। ছাপা হতে বেঙ্গল গেজেটে। শুধু যে লাট সাহেবকে নিয়ে লিখতেন তা নয়, বাদ যেতো না লাট সাহেবের বউ-ও। বরং বলা যায় যে, লাট সাহেবের বউ লেডি হেস্টিংসের প্রতি তাঁর আক্রোশটা যেনো একটু বেশিই ছিলো। তাঁকে প্রেম নিবেদন করে কখনো ছ্যাকা খেয়েছিলেন কি না কে জানে? লেডি হেস্টিংসকে নিয়ে নানা ধরনের রসালো কাহিনি ফাঁদতেন তিনি। এটাই ছিলো তাঁর সর্বোচ্চ সুখ।

পাগলা হিকির এই রকম পাগলামিতে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলো সাহেবরা। তাদের সব কেচ্ছা-কেলেংকারি ফাঁস করে দিচ্ছিলো হিকি। তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছিলো প্রতিনিয়ত। ভয়ংকরভাবে আক্রমণ করছিলো একেকজনকে। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নিচ, কোনো কিছুর ভেদাভেদ ছিলো না হিকি সাহেবের কাছে। একেবারে সমানাধিকার এবং সমাজতন্ত্র কায়েম করেছিলেন তিনি আক্রমণের ক্ষেত্রে। কেউ বেশি, কেউ কম পাবে, তা হবে না। সুযোগ পেলেই তাদের দেহে বিষ ঢেলে দিতেন তিনি। ভিকির এই কাজে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং মহা খাপ্পা ছিলেন হিকির উপরে। হিকি শুধু তাঁকে আক্রমণ করলে হয়তো এতোটা ক্ষেপতেন না তিনি, কিন্তু এই পাঁজি লোকটা তাঁর ঘরের বউকেও ছেড়ে কথা বলছে না। বাইরের লোকের সামনে এই রকম বেইজ্জতি হতে কেই বা চায়?

তো ওয়ারেন হেস্টিংস একদিন চটেমটে পাগলা হিকি সাহেবকে জেলের মধ্যে পুরে দিলেন। হিকি সাহেবও দিব্যি সুড়সুড় করে ঢুকে গেলেন কয়েদখানার ভিতরে। বগলে করে নিয়ে গেলেন তাঁর পোর্টেবল ছাপাখানাও। জেলখানা তাঁর জন্য নতুন কোনো জায়গা নয় যে ভয় পাবেন তিনি। দেশে থাকার সময়ে হিকি কাজ করতেন মুদ্রাকরের। ভারতে এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। ব্যবসা করে ভাগ্য ফেরাবেন, এটাই ছিলো তাঁর ইচ্ছা। ব্যবসা আরম্ভ করছিলেনও, কিন্তু ব্যবসা জমাতে পারেন নি তিনি। টাকা আয় করতে গিয়ে উলটো অনেক ধার দেনায় পড়ে গিয়েছিলেন। সে ধার আর শোধ দিতে পারেন নি। পাওনাদারেরা ছাড়বে  কেনো? মোকদ্দমা হয়েছিলো তাঁর বিরুদ্ধে। আদালতের রায়ে দুই বছরের মতো জেল খেটেছিলেন তিনি।

সেই পরিচিত এবং পুরোনো জায়গা্তেই আবার ফিরে এসেছেন তিনি। কাজেই, খুব একটা ভয়ডর বা বিকার নেই তাঁর। বরং এইবার পোর্টেবল ছাপাখানা আছে তাঁর সাথে। তাঁকে আর পায় কে? অস্ত্রসহ ঢুকেছেন তিনি কয়েদখানায়। এটা দিয়েই ঘায়েল করতে হবে সবাইকে। জেলে বসেই পত্রিকা চালু রাখলেন তিনি। বের হতে লাগলো বিষধর সব রিপোর্ট। এটাও মনে হয় বিশ্বরেকর্ড। জেলখানায় বসে পোর্টেবল ছাপাখান দিয়ে পত্রিকা চালু রেখেছেন কোনো সম্পাদক, এমন ইতিহাস পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

বিষ মাখানো তীরের মতো প্রতি সপ্তাহে জেলখানা থেকে বের  হয়ে আসছে পত্রিকা। হেস্টিংস দেখলেন যে, এতো মহা বিপদ। পাগলা তো জেলে বসেও সেই একই কাজ করে যাচ্ছে। থামানো দরকার তাঁকে। কাজেই, শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলেন হিকির কাছ থেকে তাঁর পোর্টেবল ছাপাখানাটাকেও কেড়ে নিতে।

পোর্টেবল ছাপাখানা হারিয়ে, হিকি সাহেবেরও সাংবাদিকতার ইতি ঘটলো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত