ইয়াকুব শাহরিয়ার, শান্তিগঞ্জ

১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ২৩:২৫

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী ‘রুটশিন্নী’

অগ্রহায়ণ মাস শেষে আমন ধান ঘরে তোলার পর ব্যস্ততা কিছুটা কমে শান্তিগঞ্জ উপজেলার কৃষক-কৃষাণীদের। তবে তারা কেউই কর্মহীন হয়ে পড়েন না। যারা বোরোধান রোপণ করতে ইচ্ছুক তারা আমন ধান কাটার আগে থেকেই বোরো ধানের বীজতলা ও ধানী জমি প্রস্তুত করে রাখেন। রোপণের জন্য তখন কেউই জমিতে নামেন না। জমিতে না নামার উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে ‘রুটশিন্নী’।

আমন ধান কেটে ঘরে তোলার পর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রোপণকৃত বোরো ধান রক্ষায় এক অলৌকিক বিশ্বাসে যে শিরণী করা হয় স্থানীয়ভাবে তাকে ‘রুটশিন্নী’ বলা হয়। এই শিরণী করে সমস্ত গ্রামে বিতরণ করা হয়। পরে ফসল সুরক্ষায় স্রষ্টার কাছে করা হয় বিশেষ মোনাজাত।

ধারণা করা হয়, শতাধিক বছর ধরে এ উপজেলার ইউনিয়নগুলোর বিভিন্ন গ্রামে এ শিরণীর প্রচলন ছিলো। কিন্তু, কালের বিবর্তনে অধিকাংশ গ্রামগুলোতেই এখন বন্ধ হয়েছে এ শিরণীর প্রচলন। যে গ্রামগুলো এখনো এ শিরণীর প্রচলন আছে তাও সীমিত আকারে। শিরণী বন্ধ হওয়ার বেশ ক’টি কারণও আছে।

ঐতিহ্যবাহী এ শিরণীর ব্যাপারে জানতে উপজেলার বেশ কয়েকজন প্রবীণ নারী-পুরুষের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, সম্ভবত এক দেড়শ বছর ধরে এ শিরণীর প্রচলন আমাদের এ অঞ্চলে। সব গ্রামেই আমন ধান তুলে খড় দিয়ে পুড়িয়ে বিশেষ কায়দা কানুন মেনে এ শিরণী করা হতো বা হয়। ধানের চারা ছিটিয়ে রাখার ফলে যে ধান উৎপাদন হয় সেই ধানের খড় (বাইনের ডেঙ্গা) দিয়ে জ্বালিয়ে এ শিরণী করা হতো। এখন সমস্ত উপজেলাব্যাপী ‘বাইনধান’ কেউ করেন না। তাই খড়ও পাওয়া যায় না। আগের দিনে প্রায় প্রতিটি গ্রামে এক তারিখে এ শিরণী করা হতো। যেন একটি উৎসব নয়, মহোৎসব হতো। এ দিনটিই এখন হারিয়ে যাচ্ছে।

উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের গাজীনগর গ্রামের সত্তরোর্ধ আলিজা বিবি নামের এক প্রবীণ কৃষাণীর সাথে আলাপকালে তিনি জানালেন এ শিরণী করার পদ্ধতি। তিনি জানান, এ শিরণী করতে যেসব উপকরণ লাগে সেগুলো হচ্ছে চালের গুড়া, পানি, পেঁয়াজ, আদা, হলুদ, ডালডা, ঘি আর কলাপাতা। আমন জমি থেকে তোলা নতুন ধানের চাল (অন্য চালও হতে পারে) পানিতে ভিজিয়ে রেখে চালকুটে চালের গুড়া তৈরি করা হয়। নির্দিষ্ট চালের গুড়ার সাথে পরিমাণ মতো পেঁয়াজ, ডালডা, আদা আর রং করার জন্য সামান্য পরিমাণের প্রাকৃতিক বাটা। পানি দিয়ে একসাথে মাখিয়ে হাল্কা শক্ত করে পুরু করে গোলাকার রুটি তৈরি করা হয়। রুটিগুলোকে কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে সারি সারি করে নিচে বিছানো খড়ের উপর রাখা হয়। তারপর উপরে খড় দিয়ে আগুন দেওয়া হয়। দীর্ঘক্ষণ আগুনে পোড়ানোর পর বের করে আনা হয়। কলাপাতার খোলে বিশেষ গোসল দেওয়া হয় রুটিগুলোকে। তারপর কেউ কেউ মাখান ঘি আবার কেউ মাখান ডালডা। এভাবেই তৈরি করা হয় ‘রুটশিন্নী’। তারপর কেটে কুচিকুচি করে সবার শিরণী একসাথে করে বিতরণ করা হয় পুরো গ্রামে।

উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের জামলাবাজ গ্রামের ষাটোর্ধ গোলাম কিবরিয়া ও সত্তরোর্ধ আবদুল্লাহ মিয়া বলেন, আমাদের দাদারা এই শিরণী করতেন, বাবা-চাচারাও করেছেন। এখন আমরাও করছি। একশো বছরের বেশি সময় ধরে এ শিরণী করা হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস থেকে আমরা এ শিরণী করে থাকি। এতে আমাদের ফসল সুরক্ষিত থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতাও জানাই এ শিরণীর মাধ্যমে। আমরা চাই- আমাদের এ বিশ্বাসের ধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর জারি থাকুক।

পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের চিকারকান্দি গ্রামের এ প্রজন্মের তরুণ আমির হোসাইন বলেন, আমরা এ শিরণী খুব একটা দেখিনি। মা-বাবার মুখ থেকে শুনেছি। এটা তাদের বিশ্বাস। খারাপ কিছুনা। আমরাও চাই ঐতিহ্যবাহী এ শিরণী পদ্ধতি চালু থাকুক। বেঁচে থাকুক মুরব্বিদের বিশ্বাস। স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হোক আরও বেশি বেশি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত