ইয়াকুব শাহরিয়ার, শান্তিগঞ্জ

১৮ ফেব্রুয়ারি , ২০২২ ২০:৩২

জৌলুস হারাচ্ছে গ্রামীণ কুটির শিল্প

আষাঢ়ের ষোড়শী ভরা যৌবনা নদী যেমন শীত-হেমন্তে এসে শুকিয়ে যায় কিংবা পৌঁছায় বার্ধক্যে, তেমনি এক সময়ের খেটে খাওয়া কর্মজীবী মানুষদের কাজের অন্যতম হাতিয়ার গ্রামীণ কুটির শিল্পও হারাচ্ছে তার জৌলুস। কালের বিবর্তনে কত কিছুই না হারিয়ে গেছে সময়ের গভীর গহ্বরে। হারাচ্ছে আরও অনেক কিছু। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে হারানোর দীঘল সারিতে নিজেদের নাম লিখিয়ে নিয়েছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ কুটির শিল্প।

প্লাস্টিকের বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বেলাজের মতো টিকে থাকার চেয়ে হারিয়ে যাওয়ার নাম করে ঐতিহ্য আর সম্মান নিয়ে নিজেই নিজেকে যেন আড়াল করে নিচ্ছে শত সহস্র বছরের গ্রাম বাংলার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বাঁশ-বেতের এ শিল্পকর্ম। জীবন যেখানে বিষয়, বাঁচতে চাওয়া যেখানে একমাত্র চাওয়া সেখানে পূর্ব পুরুষের পেশা আঁকড়ে ধরে টিকে থাকা কোনো বিলাসিতার নাম নয়। আর তাই গ্রামীণ কুটির শিল্পের আগের সব জৌলুস হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা ক্রমশ হারিয়ে যাবে এমন নিশ্চিত সংবাদেও অনেক কষ্টে-সৃষ্টে এ পেশাকে ধরে এখনো টিকে আছেন কিছু কিছু পরিবারের মানুষজন। জীবিকার চেয়ে জীবনের প্রাধান্যই যাদের কাছে বেশি তাদের কাছে সামান্য আয়ে টিকে থাকার আসল নামই হচ্ছে বাস্তবতা। তবু টিকে থাকেন তারা। নিরন্তর চেষ্টা টিকে থাকার।

শুক্রবার বিকালে বাঁশ-বেতের এ শিল্পকর্ম নিয়ে কথা হয় শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা বাজার এলাকার দু’জন কুটির শিল্পীর সাথে। যারা দিনমান ধরে বাঁশ-বেত আর সটপ্যারস্যূট দিয়ে ক্রমশ একের পর এক বুনে যাচ্ছেন টুকরি, কুলা, মাছ রাখার চাঙ্গা ইত্যাদি। টুকরিকে স্থানীয় ভাষায় অনেকে ‘উরা’ বলেও চিনে থাকেন।

শিল্পীদ্বয় জানান, এখনকার সময়ে তাদের ব্যস্ততা যাচ্ছে টুকরিকে নিয়ে। কারণ মাঘ মাস শেষ। ফাল্গুনের আগমন। পৌষ থেকে ফাল্গুন এ সময়ে বৃষ্টি বাদল না থাকায়, শুষ্ক আবহাওয়ায় নানান কারণে দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) মাটি কাটার ধুম পড়ে। হাওরাঞ্চলেতো আর কথাই নেই। প্রচুর মাটি কাটা হয় এসব অঞ্চলগুলোতে। মাটি কাটার কাজে টুকরির ব্যবহারের বিকল্প খুঁজে বের করা কঠিন। তাই অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বছরের এ তিনমাস বাঁশ-বেতের টুকরির চাহিদা থাকে খুব বেশি। এজন্যই বর্তমানে টুকরিকে কেন্দ্র করে তাদের ব্যস্ততা বেশি।

তারা জানান, নিয়ম করে কাজ করলে প্রতিদিন ২০/২৫টা টুকরি একেকজনে বাঁশ-বেত লাগিয়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করতে পারেন। গড়ে প্রতিদিন খুচরা বিক্রি করতে পারেন ১২/১৫টি টুকরি। সাধারণ ছোট টুকরি তারা ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। এ টুকরিতেই যখন বেতের হাতল লাগিয়ে বিশেষ ধরনের ‘বাইন’ দেওয়া হয় তখন প্রতিটি টুকরি বিক্রি করতে পারেন দ্বিগুণ দামে। তবে সর্বোচ্চ ১১০ কিংবা ১২০ টাকায় বিক্রি করা যায় এসব টুকরি। টুকরি প্রতি একজন শিল্পী ১৫-২০ টাকা লাভ করছেন।

শুধু টুকরি না, বর্তমান সময়ে তাদের কাছে যেসব পণ্য কিনতে পাওয়া যায় প্রায় প্রতিটি পণ্যে কমে গেছে লাভের হার। পাশাপাশি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্যের ব্যবহারও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হারিয়েই গেছে এসব কুটির শিল্প। ব্যবসা বদল করে হারিয়ে যাচ্ছেন এ শিল্পের শিল্পীরাও। এজন্য অবশ্য শিল্পীরা প্লাস্টিক পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়াকেই দোষারোপ করছেন। বলছেন, একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগে ঐতিহ্যবাহী, গ্রামীণ ও পরিবেশবান্ধব এ শিল্পকে রক্ষায় সরকারের জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। কুটির শিল্পীদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় তত্ত্বাবধান করা, এ পেশায় থাকতে উদ্বুদ্ধ করা ও সহজ শর্তে তাদেরকে ঋণ দিয়ে শিল্পী ও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।

দরগাপাশা ইউনিয়নের ভমবমি বাজার এলাকার আবদুল কাদির ও পাগলা বাজারের হামিদ মিয়া বলেন, বাঁশ বেতের দাম বাড়ায় টুকরি, খলই, কুলা, ডালা ইত্যাদি পণ্যের দাম বেড়েছে। প্লাস্টিকের জিনিস কম দামে পাওয়া যায় বলে অনেকে কিনে নেন। আমরা এখনো বাঁশ বেতের টুকরি-কুলা ব্যবহার করি। সরকার নজর দিলে এগুলো বাঁচানো সম্ভব।।

একা ট্রেডার্সের পরিচালক, কুটির শিল্পী কাজল রুদ্র পাল ব্যবসা করেন উপজেলার পাগলা বাজারে। তিনি বলেন, আমাদের বাবা-ঠাকুর দা এ পেশা শিখিয়ে গিয়েছে। অনেক কষ্টে দিন কাটছে ব্যবসা একেবারে মন্দা। একধরনের ভালোবাসা থেকে এ পেশায় পড়ে আছি। কোনো লাভ নেই। গড়ে প্রতিদিন ৩শর মতো আয় হয়। এর চেয়ে বেশি হয় না। প্লাস্টিক পণ্যের প্রতি মানুষ ঝুঁকছে বেশি। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা না করেন তাহলে এ পেশায় টিকে থাকা একেবারেই অসম্ভব।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামান বলেন, কুটির শিল্প উন্নয়ন ও দেখভালে ৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি। দ্রুতই বাস্তবায়ন করবো। এডিপি এবং জাইকা থেকে ২ লাখ করে মোট ৪ লাখ টাকা পেয়েছি আমরা। কুটির শিল্প ও শিল্পীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করবো আমরা। নকশিকাঁথাসহ কুটির শিল্পে যারা কাজ করবেন তাদেরকে কাঁচামালের সরবরাহ করতে এ টাকা ব্যয় হবে। এ ছাড়াও সাধারণ মানুষকে গ্রামীণ কর্মসংস্থান তৈরি করতে আরেকটি প্রকল্প নিচ্ছি আমরা। এখানে ৫ লক্ষ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত