ফরিদ আহমেদ

০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১২:২৪

হাওয়া: বুদ্ধিদীপ্ত এক শৈল্পিক চলচ্চিত্র

জেলেরা ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে মাছ ধরতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে। উত্তাল সাগরে গিয়ে উন্মত্ত জলরাশির সাথে লড়ছে, তারপর মাছ ধরে ফিরে আসছে তীরে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে, বিশেষ করে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামে বহুল প্রচলিত। গভীর সমুদ্রে জেলেদের এই জীবন সংগ্রাম নিয়ে কেউ ছবি বানানোর সাহস করে নাই এখনো বাংলাদেশে। ব্যতিক্রম হচ্ছে 'হাওয়া'। এই ছবিতে আটজন জেলে নয়নতারা নামের একটা ট্রলারে করে মাছ ধরতে যায় গহীন সমুদ্রে। তবে, সেই জেলেদের জীবন নয়, বরং সমুদ্রের বুকে তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা এক রহস্য এবং রোমাঞ্চ গল্প উপহার দিয়েছেন হাওয়ার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন।

প্রধান মাঝি চানের নেতৃত্বে জেলেরা রওনা দেয় মাছ ধরতে। এই ধরনের মাছ ধরার মিশন সাধারণত কয়েক দিনের জন্য হয়। গভীর সমুদ্রে সেই কয়দিন টিকে থাকার জন্য যে খাদ্য সামগ্রী আর পানি লাগে, সেটা জেলেরা নিয়ে যায় সাথে করে। এদের বেশিরভাগই হত-দরিদ্র। মাছ ধরার আয়ের একটা বড় অংশই তাদের দিয়ে দিতে হয় মহাজনকে। এদের জীবনের গল্প বলতে তাই সবচেয়ে আগে ভেসে আসে সেই সংগ্রামের গল্পই, জীবন-যুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রাম।

আগেই বলেছি, হাওয়ার পরিচালক সেই দিকে হাঁটেন নাই। জেলেদের জীবন সংগ্রাম তিনি আমাদের দেখাতে চাননি। জেলেদের তিনি বিশ্বস্ততার সাথে উপস্থাপন করিয়েছেন। কিন্তু, তাদের দিয়ে বলিয়েছেন ভিন্ন এক গল্প, সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এক গল্প। সেই গল্পে বাস্তব, অবাস্তব এবং পরা-বাস্তব সবকিছু এসে এক সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। ফলে, এটা কি বাস্তব কাহিনি, রূপকথার গল্প, নাকি পৌরাণিক অবাস্তবতা, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। সেটা বোঝার অবশ্য খুব একটা প্রয়োজনও নেই আসলে। পরিচালক আমাদের একটা উপভোগ্য চলচ্চিত্র উপহার দিতে চেয়েছিলেন। সেই জায়গাতে তিনি সফল। এই ছবির কাহিনি নিয়ে টানাটানি করার চেয়ে এটা চলচ্চিত্র হিসাবে কতোখানি দুর্দান্ত, সেই আলোচনাটাই বেশি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

'নয়নতারা' যখন মাছ ধরতে সমুদ্রে যায়, তখনও ঠিক বোঝা যায়নি পরিচালকের উদ্দেশ্য কী। কোন গল্প তিনি আমাদের দেখাতে যাচ্ছেন। শুরুটা তাই হয় মাছ ধরা দিয়েই। জেলেদের জীবন কঠিন এক জীবন। উত্তাল সাগরই শুধু তাদের শত্রু নয়, ডাঙায় থাকা দ্বিপদ কিছু মানুষও তাদের শত্রু। জল এবং স্থল, এই দুই জায়গার শত্রুদের পরাস্ত করেই তাদের টিকে থাকতে হয় জীবনে। এর মানে অবশ্য এই না যে তাদের জীবনে কোনো হাসি-ঠাট্টা নেই, নেই কোনো আনন্দ এবং উল্লাস। কঠিন জীবনেও মানুষ শ্বাস নেবার চেষ্টা করে। গহন সমুদ্রে ট্রলারেও এই মাঝিরা তাই করে। কঠোর পরিশ্রম করে, আবার সেই পরিশ্রমের মাঝে হাস্য কৌতুক করে নিজেদের চাঙ্গা রাখে তারা। একটা মাছ ধরার ট্রলারে যে রকমটা থাকে ঠিক সেই রকমই ছিলো তাদের সময়টা।

কিন্তু, এর সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় তখনই যখন তাদের জালে উঠে আসে এক অপূর্ব রূপসী তরুণী। শুরুতে তাকে মৃতই ভেবে নিয়েছিলো সবাই। পরে দেখা যায় প্রাণ আছে শরীরে। গভীর সমুদ্রে এই তরুণী কোথা থেকে এলো, তাই নিয়ে সংশয়ে পড়ে যায় সবাই। মেয়েটাকে ঘিরে তৈরি হয় রহস্য। মেয়েটা বোবা বলে, সেই রহস্য অবশ্য কারো কাছেই পরিষ্কার হয় না। এই রহস্য পরিষ্কার না হলেও, মেয়েটা ট্রলারে আসার পর থেকেই যে রহস্যময় সব ঘটনা ঘটা শুরু হয়, সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারে তারা। জেলেদের মধ্যে মেয়েটাকে নিয়ে শুধু রহস্য এবং কৌতূহলই জাগে, তা নয়। চান মাঝিসহ কারো কারো মধ্যে আদিম প্রবৃত্তিও জেগে উঠে তীব্রভাবে। সেই প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে প্রধান মাঝিসহ কেউ কেউ এগিয়েও যায়। পুরুষ দিয়ে বোঝাই একটা ট্রলারে মাঝ সমুদ্র থেকে জালে উঠে আসা বাক-শক্তিহীন মেয়ে সহজ শিকার হবার কথা। সেটা ভেবেই তারা একে একে হাত বাড়াতে থাকে তার দিকে। শুধু কামনা-বাসনাই না, রাগ-ক্ষোভ, হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ, মায়া-মহব্বত, বন্ধুত্ব, নীরব ভালবাসা, সবকিছুই জেগে ওঠে মেয়েটাকে ঘিরে। তখনও কেউ জানে না কী ভয়ংকর এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তাদের সবার জন্য। অপেক্ষা করছে এক ভয়ানক রহস্যময় পরিণতি। ভয়ানক সেই রহস্যময় পরিণতির কাছে এইসব মানবিক এবং পাশবিক আবেগ তুচ্ছ।

এই রহস্যময় পরিণতিকে অপূর্ব দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। এর সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। বাংলাদেশের কোনো পরিচালক সাগরকে এমন অসাধারণভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন, সেটা ভাবা যায় না। এর আগে 'ন ডরাই' এবং 'নেটওয়ার্কের বাইরে' ছবিতেও বঙ্গোপসাগরকে তুলে ধরা হয়েছে দারুণভাবে। তবে, মেজবাউর রহমান সুমন সবাই অতিক্রম করে গিয়েছেন। তাঁর ছবির পুরোটাই শুটিং হয়েছে সাগরে। এই কাজটা সহজ কাজ নয় বাংলাদেশের বিবেচনায়। হলিউডে এই ধরনের কাজে নানা ধরনের টেকনিক্যাল সুবিধা আছে। বাংলাদেশে সেগুলো সহজলভ্য নয়। সাগরের ছবি ক্যামেরায় তুলতে গেলে এখনও সাগরেই যেতে হয়। সাগরে গিয়েই তিনি তুলে এনেছেন সেখানকার হৃদয় নাচানো ঢেউ, এর অতল গভীরতা, অতুলনীয় সৌন্দর্য, আর অপূর্ব রঙ-বিন্যাসকে। ড্রোনের ব্যবহার করে এর বিশালত্ব, বিপুল বৈচিত্র্য এবং সুবিস্তৃত শোভাকে তুলে এনেছেন।

সিনেমার প্রতিটা দৃশ্যের ফ্রেমিং নান্দনিকতায় ভরা। সিনেমার দৃশ্য নয়, মনে হয় যেনো সেলুলয়েডের ফ্রেমে কবিতা লেখায় নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন এই ছবির ক্যামেরাম্যান। প্রতিটা দৃশ্য তাই কবিতার লাইনের মতো মাধুর্য রসে সিক্ত হয়ে বের হয়ে এসেছে। চোখের জন্য সেটা আরামের তো বটেই, চিত্তের জন্যেও তা দারুণ মনোহর। বাংলাদেশের কোনো ছবিতে এই রকম দুর্দান্ত কাজ আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

চিত্রধারণের বাইরে এই ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে এর অভিনয়। শরীফুল রাজ, নাসিরুদ্দিন খান, সুমন আনোয়ার, সোহেল মণ্ডলদের দেখলে জেলে ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। এদের চলাফেরা, গেট-আপ, কথাবার্তা সবকিছুই অবিকল জেলেদের মতো ছিলো। ছবির একমাত্র নারী চরিত্র গুলতিতে অভিনয় করেছেন নাজিফা তুষি। অল্প বয়সের এই মেয়েটাও অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছে। ছবির একটা বড় অংশেই তিনি নির্বাক ছিলেন। চোখের ভাষায় কথা বলেছেন তিনি। সেটাতে দারুণভাবে উতরে গেছেন তিনি। দুর্দান্ত-ভাবে সাবলীল ছিলেন তিনি। বরং কথা বলার সময়েই তাকে কিছুটা অ-সাবলীল লেগেছে। পুরো ছবিতে নির্বাক থাকলেই বেশি ভালো করতেন তিনি। তাঁর পর্দা উপস্থিতি উপস্থিত সৌন্দর্যময়। যখনই পর্দায় এসেছেন, শুধু ফুলের সৌন্দর্য নয়, সুবাসও ছড়িয়েছেন তিনি।

অভিনয়ে সবাইকে যিনি ছাড়িয়ে গিয়েছেন, তাঁর কথা সবার শেষে বলছি। তিনি হচ্ছেন চঞ্চল চৌধুরী। এই ছবির প্রধান মাঝি চানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। চান মাঝি নেতিবাচক একটা চরিত্র। লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, আর নির্মমতা দিয়ে গড়া এই চরিত্র। সেটাকে তিনি অবিশ্বাস্য বিশ্বস্ততার সাথে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর সেরা কাজ এটা। চঞ্চল চৌধুরী ইদানিং যেভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন, তাতে করে তিনি যে কোথায় গিয়ে থামবেন বলা মুশকিল।

হাওয়া ছবিটা গতকাল মুক্তি পেয়েছে টরন্টোতে। গতকাল ওয়ার্কিং ডে ছিলো বলে রাতের টিকেট কেটেছিলাম। সাড়ে দশটায় শো ছিলো। অতো রাতে খুব বেশি মানুষ ছবি দেখতে যাবে না, সেটাই ছিলো আমার ধারণা। এগলিন্টন টাউন সেন্টারের সিনেপ্লেক্সে গিয়ে সেই ভুল ভাঙলো আমার। পার্কিং লট থেকেই বাঙালিদের ভিড়। সিনেপ্লেক্সের লাউঞ্জে গিয়ে বাঙালি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে নাই আমার। অথচ ওদের প্রায় পনেরো ষোলটা অডিটোরিয়াম রয়েছে ওখানে। আমাদের সেই সাড়ে দশটার শো-ও হাউজফুল ছিলো।

আমি সাধারণত ছবি দেখার পরে আন্নার মতামত নেই। ওর সিনেমা জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক ভালো। আমার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে ভালো ছবি দেখে বলেই সেই জ্ঞানটা জন্মেছে তার। হাওয়া শেষ হবার পরেও তার মতামত জানতে চেয়েছিলাম। সে ছবিটা দেখে মুগ্ধ। তার দেখা বাংলাদেশের সেরা ছবি এটা। তার মুগ্ধতা এবং আমার সমপরিমাণ মুগ্ধতার কারণে ছবিটা আরেকবার দেখার প্রস্তাব দিয়েছি তাকে। নিমরাজি হয়েছে সে। এই ছবিটা আসলে একবার দেখে স্বাদ মিটে না, একাধিকবার দেখার যোগ্য এটা।

সবশেষে বলবো, এই ছবির কাহিনি বাস্তব নাকি অবাস্তব, এটা রূপকথার ছবি, নাকি পৌরাণিক গল্প, নাকি জাদু-বাস্তবতা রয়েছে এখানে, সেগুলো ভুলে গিয়ে চলচ্চিত্রটাকে দেখুন। একটা চলচ্চিত্র তখনই সার্থক যখন সেটা দর্শককে আকর্ষণ করে, তাকে ধরে রাখে, তার চোখকে নিবিষ্ট করে রাখে রূপালি পর্দার উপরে। দর্শক যদি সিনেমা দেখতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে হাই তোলে, তবে সেটা যতো বড় শৈল্পিক ছবিই হোক না কেন, সার্থক ছবি হবার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে তা। 'হাওয়া' দেখতে গিয়ে সেই সম্ভাবনা কম।
বাংলাদেশে কোনো পরিচালকের করা সবচেয়ে স্মার্ট ছবি এটা। এতো সুন্দর নির্মাণের ছবিও এর আগে হয়নি কখনো। এই সিনেমার প্রতিটা দৃশ্যই দেখার মতো। প্রত্যেকটা দৃশ্য আপনাকে পরের দৃশ্যের দিকে প্রবলভাবে টেনে নিয়ে যাবে জলের স্রোতের মতো।

ফরিদ আহমেদ: কানাডাপ্রবাসী লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত