নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৩:০৮

বন্দে মায়া লাগাইছে

বাজারের চায়ের দোকানগুলো থেকে যদিও হিন্দি সিনেমার সংলাপ আর ওয়াজের সুর ভেসে আসছে, নৌকার মাঝির কণ্ঠে তবু করিমের গান- ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি...’। ধল বাজারে এসে নৌকা থামতেই কানে ভেসে আসল এমন সুর।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার এই বাজার ঘেঁষে উজান ধল গ্রাম। এই গ্রামেই ১৯১৬ সালে জন্ম নেন শাহ আবদুল করিম। যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠেন ভাটির মানুষের দুঃখ-বঞ্চনা, প্রেম-বিরহ, ভালোবাসা ও ক্ষোভের সুরেলা কথক। মাটি আর মানুষের কথা ও সুরে গান গেয়ে হয়ে উঠেন বাউল সম্রাট। ১২ সেপ্টেম্বর তাকে হারানোর দিন; ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।

বাউল সম্রাটের বাড়িতে যাওয়ার পথেই দেখা রশিদ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনিও বাউল। করিমেরই শিষ্য। আবদুল করিমকে ‘বাবা’ সম্বোধন করেন।

বাজারের রেস্টুরেন্টগুলো থেকে কানে আসা সুর ও স্বর নিয়ে কথা উঠতেই আক্ষেপ তার কণ্ঠে। রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাটির আগের দিন আর নাই। ঘরে ঘরে ডিশলাইন এসে গেছে। মোবাইলও আছে সবার। এসবে এখন খালি ভিনদেশি গান বাজে। ভাটির সুর, বাউল সুর আর তেমন কানে আসে না।’

বলতে থাকেন রশিদ উদ্দিন- ‘ধর্মের কথা বলে তো এখন আমাদেরও গানে বাধা দেয়া হয়। অথচ আগে এমন ছিল না। আগে বর্ষা মৌসুমে প্রতি ঘরেই বাউল গানের আসর বসত। আমরা দিনরাত গান করতাম। কিছু বাধা ছিল, তবে বেশিরভাগ মানুষ গানে উৎসাহ দিত।’

আব্দুল রশিদের কাছে বদলে যাওয়া দিনের আফসোস শুনতে শুনতেই পৌঁছে যাওয়া আবদুল করিমের বাড়িতে। করিম গত হয়েছেন ১৪ বছর। তবু এখনো পুরো বাড়িটিই যেনো করিমময়।

বাড়ির পাশেই নদীর ঘাটে বাধা রঙিন নৌকা, নাম- করিম তরী। করিমের ছবি আর গানের কথায় সাজানো নৌকাটি। আরেকটু এগোলেই একটি ভবন- ‘শাহ আবদুল করিম স্মৃতি জাদুঘর’। ভবনের সামনে করিমের আবক্ষ ভাস্কর্য আর ঘরের ভেতর ঠাসা বাধ্যযন্ত্র, সনদ, ছবি ও তার ব্যবহার্য জিনিসপত্রে। এর পাশেই দুটি সমাধি। পাশপাশি শুয়ে আছেন দুজন। আবদুল করিম আর তার স্ত্রী সরলা। মৃত্যুও যাদের আলাদা করতে পারেনি।

এসব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েও পুরনো আফসোস আবারও প্রকাশ করেন আব্দুল রশিদ। বলেন, ‘সবই আছে কিন্তু আগের পরিবেশটা নাই। ভাটি এলাকা কিছুটা উন্নত হচ্ছে, তবে মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে। আগের মতো গানের আসর নেই।’

করিম সঙ্গীতালয়ের ভগ্নদশা নিয়েও আক্ষেপ তার কণ্ঠে।

হাওরে তখন বন্যা। চারদিকে থৈ থৈ পানি। পানিতে ডুবছে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান। চারদিকে ফসল হানির হাহাকার। কৃষকের আর্তনাদ। শাহ আবদুল করিমের গানেও পাওয়া যায় হাওরের এই অকালবন্যার চিত্র। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ভাটির চিঠি গ্রন্থে করিম লিখেছেন- ‘জল নামে রাস্তায় কোনো বাধাবিঘ্ন নাই।/ প্রচুর মাটি নেমে আসে চোখে দেখতে পাই।/ পাহাড়ি জল নিচে নেমে নদীপথে চলে/ এলাকা প্লাবিত হয় অকালবন্যার জলে।’

এই গানটির প্রসঙ্গ টেনে করিমপুত্র শাহ নুর জালাল বলেন, ‘গানে তো বাবা মানুষ, হাওর আর ভাটির কথাই বলে গেছেন। কিন্তু ভাটির মানুষের দুর্দশা গোছাতে তো কেউ উদ্যোগ নেয় না। ঢলে পানির সঙ্গে মাটি আসায় নদী ভরাট হচ্ছে। এতে বন্যা বেশি হচ্ছে। এটা বাবা অনেক আগে গানে বলে গেছেন। কিন্তু নদী খনন তো আর হয়নি। ফলে প্রতি বছরই দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’

গানে গানে এভাবেই মানুষের কথা, ভাটির দুর্দশার কথা তুলে ধরেছিলেন আবদুল করিম। ফলে বাউল হয়েও তিনি হয়ে গেয়ে ছেন গণসঙ্গীত শিল্পী। হয়ে উঠেছেন গণমানুষের শিল্পী।

পাঁচ বছর পর পর দেশে ভোট আসে। গরীবের উন্নয়নের আশ্বাস আর ধর্মের বাণী নিয়ে ভোটারদের কাছে আসেন প্রার্থীরা। ভোটের লোকজনও দাঁড়ায় ভোটের লাইনে। কিন্তু তদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। গরিব আরও গরিব হয়ে ওঠে।

করিমের উপলব্দি তাই গরীবের কেউ নেই। তিনি লিখেছেন- ‘ভোট দিবায় আজ কারে?/ ভোট শিকারী দল এসেছে নানা রঙ্গ ধরে/... কেউ দিতাছে ধর্মের দোহাই, কেউ বলে গরিবের ভাই/ আসলে গরিবের কেউ নাই, গরিব ঠেকছে ফেরে।’

রাজনীতিবিদদের এই শঠতা আর সাধারণ মানুষের বঞ্চনা নিয়ে আরেক গানে করিম গেয়েছেন- ‘ভাইরে ভাই/ভোট নেওয়ার সময় আইলে/ নেতা সাহেব এসে বলে/ এবার আমি পাশ করিলে/ কাজ করবো গরিবের দায়,/ শেষে দেখা যায় ধনির বাড়ি খাসী খাওয়া/ লাইসেন্স পারমিট দেওয়া,/ নৌকা বাওয়া আর সালাম দেওয়া/ এই দুইটাই গরিবে পায়,/ গরিবের কি মান অপমান দুনিয়ায়।’

করিমপুত্রের সঙ্গে আলাপকালেই চার তরুণ এসে ঢুকেন বাড়িতে। ঢাকা থেকে হাওরে ঘুরতে এসেছেন তারা। এই ফাঁকে আবদুল করিমের বাড়িও দেখে যাওয়া। দেখে যাওয়া যাওয়া যে পরিবেশ থেকে করিম হয়ে উঠেছেন বাউল গানের সম্রাট।

তাদেরই একজন নিয়াজ আহমদ। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। লোকগান করেন। বললেন, ‘করিমের গান আমার খুব পছন্দ। তার জীবনচারণও পছন্দ। তাকে মুর্শিদ হিসেবে গণ্য করি। মুর্শিদ যেখানে শুয়ে আছেন, সেই মাটি দেখতে এসেছি। তার স্পর্শ পেতে এসেছি।’

মাঝেমাঝেই দূরদুরান্ত এমন অনেকে করিমের স্মৃতির খোঁজে ভাটির এই দুর্গম জনপদে আসেন জানিয়ে শাহ নুর জালাল বলেন, ‘যারা আসে তাদের বেশিরভাগই তরুণ। তারা ব্যান্ড, রক, হিন্দি ইংরেজি গান শুনে। আবার বাউল গানও শুনে। কেবল শুনে না বাউলদের সম্পর্কে তারা জানতে চায়। তাই দূরের পথ পাড়ি দিয়ে করিমের ভিটায় আসে।

‘এদের মধ্যেই বাউল আবদুল করিম বেঁচে থাকবেন। ডিশ আর ইন্টারনেট এসে করিমকে ভুলিয়ে দিতে পারবে না। বরং এসবকে ব্যবহার করে করিমের গান আরও বেশি মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে।’

তবে করিমের গানের চর্চা ও প্রসারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ক্ষোভ লোকসংস্কৃতি গবেষক সুমনকুমার দাশের কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দিরাইয়ে একটি আবদুল করিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কাজ শুরু হয়নি।

‘জীবিত থাকতেই করিম নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন ‘করিম সঙ্গীতালয়’। পৃষ্টপোষকতার অভাবে এটিরও কার্যক্রম থেমে আছে। ফলে লোকের মুখে মুখে করিমের গান ছড়িয়ে পরলেও তার গান শেখা বা শুদ্ধভাবে চর্চার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে অনেকক্ষেত্রে গানের কথা ও সুর বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।’

করিমের বাড়ির পাশেই হাওর। তখন হাওরে ডুবে যাওয়া ধান নৌকায় করে কেটে নিয়ে আসছেন কৃষকরা। কণ্ঠে তাদের করিমের গান- ‘বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে...’। হাওর ছেড়ে শহরে ফিরেও সেই একই সুর কানে এল, মাইক্রোবাসের ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে ভেসে আসছে- ‘কেমনে চিনিবো তোমারে...’।

ক্যাবল-ইন্টারেন্টের প্রভাব, বহুবিদ সংস্কৃতির প্রবেশ ও আধিপত্যসহ সত্ত্বেও গ্রাম থেকে শহরে এখনো বেজে চলছে আবদুল করিম।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত