ফরিদ আহমেদ

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ২৩:১০

শনিবার বিকেল: বিবর্ণ এক বিচ্যুতিময় বায়োস্কোপ

ঢাকার অভিজাত এলাকা হচ্ছে গুলশান। সেই গুলশানে ছবির মতো সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো। সেটার নাম হলি আর্টিজান বেকারি। এই রেস্টুরেন্টরা বিদেশিদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলো। ২০১৬ সালের জুলাই মাসের এক তারিখে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলাটা ঘটে। আর সেই হামলাটা ঘটেছিলো এই হলি আর্টিজানেই। তখন রোজার মাস। স্বাভাবিকভাবেই ইফতারের পরে সেখানে বেশ ভিড় ছিলো। দেশি বিদেশি লোকজন যখন রাতের খাওয়া খেতে ব্যস্ত, ঠিক সেই পাঁচজন তরুণ জঙ্গি গুলি করতে করতে ঢুকে পড়ে রেস্টুরেন্টের ভিতরে। এরা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য এবং ঢাকার অভিজাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো।

হলি আর্টিজানে প্রবেশ করে বিভিন্ন টেবিলে বসে থাকা বিদেশি নাগরিকদের এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে তারা। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাদের গলায় ও শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতও করে তারা। বাকিদের জিম্মি করে ফেলে তারা।

জঙ্গিরা যখন হলি আর্টিজানে ঢোকে, তখনই পুলিশের দুইজন কনস্টেবল আহত হয়েছিলো। এর পরপরই পুলিশ ঘিরে ফেলে রেস্টুরেন্ট। কিন্তু, জঙ্গিরা দুটো গ্রেনেড ছুড়ে মারে পুলিশের দিকে। এতে গুরুতর আহত হন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এসি রবিউল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তারা।

জঙ্গিদের দমন এবং জিম্মিদের উদ্ধার করার জন্য সিলেট থেকে ঢাকায় উড়িয়ে আনা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিটকে। পুলিশ এবং বিজিবিও সার্বক্ষণিকভাবে ঘিরে রেখেছিলো হলি আর্টিজানকে। ভোরে অপারেশনে নামে প্যারা কমান্ডো ইউনিট। এর নাম দেওয়া হয়েছিলো অপারেশন থান্ডারবোল্ট। সেই অপারেশনে পাঁচ জঙ্গিই নিহত হয়। জীবিত জিম্মিদের উদ্ধার করা হয়।

হলি আর্টিজানের সেই জঙ্গি হামলাকে চলচ্চিত্রে তুলে এনেছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। চলচ্চিত্রটার নাম হচ্ছে 'শনিবার বিকেল'। যদিও তিনি তার চলচ্চিত্র হলি আর্টিজানের উপরে নয় বলে বার বার বলেছেন। তার ভাষ্য হচ্ছে, এটা হলি আর্টিজান থেকে অনুপ্রাণিত মাত্র।

টরন্টোতে গত মাসে হয়ে গেলো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব সাউথ এশিয়া। সেখানে এই ছবিটার প্রদর্শনী ছিলো। যে সিনেপ্লেক্সে ছবিটা দেখানো হচ্ছিলো, সেটা আমার বাসা থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের ড্রাইভিং দূরত্বে। কাছাকাছি দূরত্বের কারণে এমনিতেই হয়তো ছবিটা দেখতে যাওয়া হতো। তবে, সেটার চেয়েও অনেক বেশি আগ্রহ ছিলো ছবিটার বিষয়বস্তুর কারণে। এর বাইরে বাড়তি আরেকটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো এটা জেনে যে এই ছবিটাকে বাংলাদেশের সেন্সরবোর্ড বাংলাদেশে প্রদর্শনের অনুমতি দেয়নি। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের আগ্রহ অপরিসীম। শুধু আমার না, এখানকার বাংলাদেশিদের মধ্যেও বেশ আগ্রহ ছিলো ছবিটা নিয়ে। সেটার প্রমাণ পাওয়া গেলো পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ দেখে।

ছবি নিয়ে কোনো পর্যালোচনা করতে গেলে, আমি সাধারণত অকপটে বলে নেই যে আমি চলচ্চিত্র বোদ্ধা না। একজন সাধারণ দর্শক হিসাবে আমি ছবিটাকে যেভাবে দেখি, সেটাই সাধারণত প্রকাশ করি আমি আমার পর্যালোচনাতে। চলচ্চিত্রের নিজস্ব একটা ভাষা আছে, গভীরতা আছে, আছে অর্থপূর্ণতা। সেগুলো আমার পক্ষে বোঝাটা কঠিন। অতো জ্ঞান আমার নেই। আমি সাদা চোখে আমার কাছে যেটা ভালো লাগ কিংবা মন্দ লাগে, সেটাই বলে দেই। কাজেই, এটাকে কেউ সিরিয়াস মুভি পর্যালোচনা হিসাবে না নিলেই খুশি হবো আমি।

আগেই বলেছি, হলি আর্টিজান অভিজাত গুলশান এলাকার রেস্টুরেন্ট ছিল। যারা রেস্টুরেন্টটাকে সামনাসামনি দেখেছেন বা ছবিতে দেখেছেন, তারা জানেন, অসম্ভব সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো সেটা। অভিজাত এলাকার অভিজাত রেস্টুরেন্ট বলতে যা বোঝায়, হলি আর্টিজান ছিলো ঠিক তেমনই। ফারুকীর 'শনিবার বিকেল' ছবিতেও জঙ্গিরা এক রেস্টুরেন্টে হামলা চালায়। তাদের বস আরবিভাষী একজন সুসজ্জিত ব্যক্তিত্ব। বড় কোনো কোম্পানির সিইও হিসাবে চালিয়ে দেওয়া যাবে তাকে। এমন একজন লোক বাংলাদেশের একটা রেস্টুরেন্টে স্থানীয় জঙ্গিদের সাথে নিয়ে হামলা চালাচ্ছে কেন কে জানে।

শুরুতেই দেখা যায় রেস্টুরেন্টে অনেক বিদেশি অতিথি আছে। তারমানে এটা অভিজাত এলাকার একটা রেস্টুরেন্ট। কিন্তু, এর চেয়ার টেবিল, কিংবা সাজসজ্জা দেখলে সেটা মনে হয় না। কুৎসিত চেহারার কাঠের চেয়ার আর ততোধিক কুৎসিত চেহারার কাঠের উঁচু টেবিল দিয়ে বাংলাদেশের অভিজাত এলাকার কোন রেস্তোরাঁ নিজেদের সাজায় বলে আমার জানা নেই। ঢাকার অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁগুলোর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা বিশ্বমানের হয়।

হলি আর্টিজানের মতো, এখানেও গুলি করতে করতে জঙ্গিরা ঢোকে। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই সব বিদেশিদের এক রুমের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সাথে চলতে থাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি। এরপর সবাইকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে তারা। একজন গর্ভবতী বিদেশি তরুণী তার পেটের বাচ্চার জন্য কেঁদেকেটে জঙ্গিদের কাছে করুণা ভিক্ষা করে। কিন্তু , সেই করুণা জঙ্গিদের কাছ থেকে মেলে না। তাকে গুলি করে মারে জঙ্গিরা। আরেকজন বিদেশি ছেলে, যার নাম হচ্ছে জন, তাকে বলা হয় তার স্ত্রীকে কল দিতে। বিবাহিত নয় বলে সে তার মাকে কল দেয়। মায়ের সাথে কলে থাকা অবস্থাতে তাকে গুলি করে মারে জঙ্গিরা। তাকে মারার নিয়ত এমনিতেই ছিলো জঙ্গিদের। সেখানে খামোখা তাকে দিয়ে মাকে কল করানোর এবং মা কলে থাকা অবস্থায় হত্যা করার কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাই নাই। আতংক তৈরি করার উদ্দেশ্যে হলে সব বিদেশিদেরই বলা উচিত ছিলো পরিবারের কাছে কল দেওয়ার। শুধুমাত্র জনকে একা বেছে নেওয়া হলো কেন জানি না।

বিদেশিদের হত্যা করার পর, সব বাংলাদেশিদের জড়ো করা হয় এক জায়গায়। সব বাংলাদেশি বললে অবশ্য ভুল হবে। একজন ছিলো যার চেহারা সুস্পষ্টভাবে অ-বাংলাদেশি। কিন্তু, জঙ্গিরা তাকেও বাংলাদেশি হিসাবে ধরে নিয়ে জেরা করতে থাকে। তার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পাওয়ায় যখন তাকে জঙ্গিরা মারতে যায়, তখন রেস্টুরেন্টের শেফ জানায় যে সে আসলে বোবা। এই বোবাকে পরে জঙ্গিদের বিদেশি গুরুর সামনে বসিয়ে রাখা হয়। ওখানে যখন তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, তখন বোঝা যায় বোবা হলেও সে কথা শোনে এবং বোঝে। বোবা ব্যক্তিরা কানে শোনে না বলেই জানতাম আমি। এই বোবা সেইদিক থেকে ব্যতিক্রম।

পাঁচ জঙ্গির মধ্যে, তিন জঙ্গিই বেশি লাফঝাঁপ করেছে। এই তিন জঙ্গির চরিত্রে অভিনয় করেছেন কোলকাতার পরমব্রত এবং বাংলাদেশের ইরেশ জাকের ও ইন্তেখাব দিনার। মজার বিষয় হচ্ছে এদের তিনজনেরই বয়স চল্লিশের উপরে। সাধারণত জঙ্গি দলগুলোর ফ্রন্টলাইনের সেনার অল্পবয়সী তরুণ হয়ে থাকে। টিনএজার বা আর্লি টোয়েন্টিজের ছেলেদের ম্যাচুরিটি কিছুটা কম থাকে। সে কারণে এদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা খুব সহজ হয়। হলি আর্টিজানের জঙ্গিদের বয়স বিশ্লেষণ করলেই সেটা বুঝতে পারবেন। এদের সবাই বিশ-বাইশ বছরের ছিলো। তো, এই তিন মধ্যবয়সী জঙ্গি নানাধরনের কর্মকাণ্ড করেছে জিম্মিদের নিয়ে, নিজেদের উগ্রবাদী প্রমাণের জন্য লাফঝাঁপও করেছে তারা। এগুলোর কোনোটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। পরমব্রত কিছুটা পেরেছেন। তার বয়স সেভাবে বোঝা যায়নি। ইরেশ যাকের এবং ইন্তেখাব দিনার বয়স লুকোতে পারেননি। দুজনকেই মধ্যবয়সী বলে মনে হয়েছে। পরমব্রতের ক্ষেত্রে আরেকটা প্রশংসা আলাদা করে করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হবার পরেও বাংলাদেশের কথার টানটাকে তিনি এনেছেন দারুণভাবে। আমি কান পেতে শুনেও তার পূর্ববঙ্গীয় টানে কোনো খুঁত ধরতে পারি নাই। বাকি দুইজনকেই স্রেফ ভাঁড় বলে মনে হয়েছে। অথচ, ইরেশ জাকের এবং ইন্তেখাব দিনার দু'জনেই নামকরা অভিনেতা। এই ছবিতে পুরোপুরি ব্যর্থ দু'জনে। এদের বিদেশি বসের চরিত্র যিনি করেছেন, তার কোনো সুযোগই ছিলো না অভিনয় দেখানোর। জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে পুলিশের অবস্থান দেখা আর মাঝে মাঝে পুলাস পুলাস (পরমব্রতের স্ক্রিন নাম ছিলো পলাশ) তাকে ডেকে নিয়ে কানে কানে কিছু বলাই ছিলো তার একমাত্র কাজ।

যারা জিম্মি হিসাবে ছিলেন, তাদের অবস্থা আরও খারাপ। মামুনুর রশীদ, জাহিদ হাসান কিংবা তিশা কাউকে দেখেই মনে হয়নি যে তাদের সামনে জঙ্গিরা নির্বিকারভাবে মানুষজনকে হত্যা করছে। এতো বড় একটা ভয়ংকর ঘটনা চোখের সামনে দেখার পরে এবং নিজেদের জীবনও যে কোনো সময়ে বিপন্ন হতে পারে সেটা জানার পরেও, এদের কাউকে ভীত সন্ত্রস্ত বলে মনে হয় নাই। এমন রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের মধ্যেও কেউ নামাজ পড়তে চাইছে, কেউ সিগারেট খাওয়ার আবদার করছে, কেউ বা আবার দৃশ্যপটে অনুপস্থিত মায়ের সম্মান বাঁচানোর জন কড়া কড়া কথা বলছে জঙ্গিদের।

ছবির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে পুরো ছবির দেখার পরেও আপনি জঙ্গিদের কোনো মোটিভ আপনি খুঁজে পাবেন না। কী কারণে তারা হামলা চালালো এই রেস্টুরেন্টে? কোন কারণে তারা এতোগুলো নিরীহ বিদেশি লোককে চোখের নিমেষে মেরে ফেললো? জঙ্গিদের নেতা বিদেশি লোকটারই বা উদ্দেশ্য কী? এটা কি ধর্মীয় হামলা ছিলো, নাকি রাজনৈতিক হামলা? এর কোনো কিছুর উত্তর আপনি পাবেন না। মনে হবে, কে সুরা মুখস্থ বলতে পারে আর কে পারে না, কে হিজাব পরে আর কে পরে না, সেটাই হচ্ছে জঙ্গিদের আসল সমস্যা। ফলে, সুরা জানার টেস্ট নেয় তারা সবার, হিজাব পরাতে তিশাকে প্রশংসা করে তারা, আধুনিক পোশাক পরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায় বলে এবং ভয়ের চোটে সুরা বলতে না পারার কারণে তিশার বান্ধবীকে গুলি করে মেরে ফেলে তারা। অথচ, জঙ্গিরা নিজেরাও সবাই আধুনিক পোশাক পরা। কী অদ্ভুত মানসিক বৈকল্য জঙ্গিদের!

পুরো মুভিটাই ফারুকী শুট করেছেন রেস্টুরেন্টের ভিতরে। খোলা জায়গার একটা সিঙ্গেল শটও সেখানে নেই। ফলে, রেস্টুরেন্টের বাইরে পুলিশ, বিজিবি কিংবা সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকাণ্ড আপনি দেখতে পাবেন না এখানে। জঙ্গি এবং জিম্মিদের ভাঁড়ামোই দেখতে হবে পুরোটা সময় জুড়ে। এ রকম বদ্ধ জায়গাতেও শুট করেও অনেক ভালো ছবি করা যায়। তার প্রমাণ হচ্ছে 'টুয়েলভ এ্যাংরি মেন' ছবিটা। 'শনিবার বিকেল' ওই মানের ছবি হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তবে, কথা হচ্ছে কোনো মানেই এটা পৌঁছায়নি আসলে। মঞ্চ নাটকের মতো মনে হয়েছে পাত্রপাত্রীদের চলাফেরা এবং কর্মকাণ্ড। চলচ্চিত্র বলে মনে হয়নি।

আগেই বলেছি, এই ছবিটা বাংলাদেশের সেন্সরবোর্ড বাংলাদেশে প্রদর্শনের অনুমতি দেয়নি। এই ছবিটা মুক্তি পেলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে বলে সেন্সর বোর্ডের একজন সদস্য জানিয়েছিলো বলে আমরা জানি। সেই জানাটা হঠাৎ করেই ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে তথ্য মন্ত্রী হাছান মাহমুদের বক্তব্যের কারণে। তিনি বলেছেন, “ঢাকায় হলি আর্টিজানে যে হামলা হয়েছিল, সেই ঘটনার উপর ভিত্তি করে এই সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে দু’জন পুলিশ অফিসার মারা গেছেন এবং আমাদের পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে জঙ্গিদের দমন করেছিল।

সেন্সর বোর্ডের অভিমত, সেই বিষয়গুলো সিনেমাটিতে আসেনি। সেজন্য এই দৃশ্যগুলো সংযোজন করতে বলা হয়েছে। সেটি তারা কিছুটা করেছে বলে আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু সেটিও যথেষ্ট নয়। তারা আপিল করেছিল। আপিল কর্তৃপক্ষ সিনেমার পরিচালক ও প্রযোজককে জানিয়ে দেবে কী কী সংযোজন করা প্রয়োজন। সেগুলো সংযোজন হলে আমি মনে করি এই সিনেমা রিলিজ করার ক্ষেত্রে যে সমস্যা আছে সেটি কেটে যাবে।”

তথ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য খুবই ঝামেলার একটা বক্তব্য। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী শুরু থেকেই বলে আসছেন, তার ছবি হলি আর্টিজানের ঘটনার উপরে নয়। ওই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। অনুপ্রাণিত একটা চলচ্চিত্রে তিনি হলি আর্টিজানের ঘটনায় দুইজন পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাহসিকতার সাথে মৃত্যুবরণ কিংবা র‍্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনীর বীরত্বকে তুলে ধরতে বাধ্য নন। এমনকি এই ছবি হলি আর্টিজানের ঘটনার উপরে করা হলেও, এগুলো সংযোজন করার বাধ্যবাধকতা তার নেই । একটা চলচ্চিত্রে কী দেখাবেন আর কী দেখাবেন না, সেটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে পরিচালকের উপরে। তিনি তার দৃষ্টিকোণ থেকে সেলুলয়েডের ফিতায় গল্প বোনেন। সেই গল্প আরেকজনের ভাবনার সাথে মিলতেও পারে, আবার নাও মিলতে পারে। এখানে তাকে নির্দেশনা দিয়ে কোনো কিছু সংযোজন করতে বলাটা তার সৃষ্টিশীলতার উপরে অহেতুক হস্তক্ষেপ করা। ফারুকী তার মতো করে 'শনিবার বিকেল' চিত্রায়ন করেছেন। দর্শকরা সেটা ওইভাবেই দেখবে। দেখার পরে তারা তাঁদের মতামত দেবে। ছবিটা কারো ভালো লাগলে, সে প্রশংসা করবে। আর যার কাছে খারাপ লাগবে, সে সমালোচনা করবে। এখানে সেন্সর বোর্ডের কোনো ভূমিকা নেই এর চিত্রনাট্যে সংযোজন আনার। সেন্সরবোর্ড এই দায়িত্ব নিলে ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতা প্রচণ্ড রকমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। সৃষ্টিশীলতার জায়গায় এই ধরনে অযাচিত এবং অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। একজন চলচ্চিত্রকার, ঔপন্যাসিক, কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পীর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত তাদের সৃষ্টিকর্মের ব্যাপারে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ছবিটা দেখে খুব একটা মুগ্ধ না। মুগ্ধ না হবার পরেও, আমার সুস্পষ্ট অভিমত হচ্ছে, এই ছবিতে সেন্সরবোর্ডের হস্তক্ষেপ করার মতো আপত্তিকর কিছু আমি পাইনি। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী হলি আর্টিজানের ঘটনা দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তার মতো করে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সেটা আমাদের কারো কারো কাছে ভালো লাগবে, কারো কারো কাছে ভালো লাগবে না। এর বাইরে এটাতে আপত্তি করার কী আছে আমি জানি না। তিনি তার মতো করে চিত্রনাট্য লিখেছেন, সেটাকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ভবিষ্যতে হয়তো হলি আর্টিজান নিয়ে অন্য কেউ মুভি বানাবে। সেই পরিচালক ভিন্ন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেটাকে দৃশ্যায়ন করবেন। মাথার উপরে আকাশ ভেঙে পড়ার তো কিছু ঘটেনি যে ছবিটাকে আটকে রাখতে হবে বা নির্দেশনা দিতে হবে নানা কিছু সংযোজনের।

'শনিবার বিকেল' অবিকৃতভাবে সেন্সর বোর্ড থেকে মুক্তি পাবে, সেই আশাবাদ রইলো।

ফরিদ আহমেদ: কানাডাপ্রবাসী লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত