মো. আব্দুর রহমান জামিল

০৮ মে, ২০২৩ ০২:০৩

বিশ্ব রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস: অসহায় ও মানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন

৮ মে ২০২৩ বিশ্ব রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো: আমরা যা কিছুই করি সবটা হৃদয় থেকে করি Everything we do comes #from heart। রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জীন হেনরি ডুনান্টের ১৯৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ মে ২০২৩ সোমবার বিশ্বব্যাপী রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে।

১৮২৮ সালের এই দিনে আর্ত মানবতার সেবায় মূর্ত প্রতীক শান্তিতে প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মহামতি জীন হেনরি ডুনান্ট সুইজারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। এ মনীষীর জন্মদিনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার জন্য দিনটিকে বিশ্ব রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের জন্ম হয়েছিল একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রের ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে। ১৮৫৯ সালের ২৪ জুন ইতালির উত্তর প্রান্ত সলফেরিনো নামক গ্রামে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে মানব ইতিহাসের একটি ভয়াবহ ও রক্তাক্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে উভয় দেশের প্রায় ৩ লক্ষাধিক সৈন্য অংশগ্রহণ করে। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৫ ঘন্টাব্যাপী এ যুদ্ধে প্রায় ৪০,০০০ সৈন্য আহত ও নিহত হয়েছিল। আহত সৈন্যরা বিনা চিকিৎসায় উন্মুক্ত প্রান্তরে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে সেবা ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে থাকে।

সেই সময় সুইজারল্যান্ডের এক তরুণ ব্যবসায়ী অর্থাৎ আজকের এ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা জীন হেনরি ডুনান্ট ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য যাচ্ছিলেন। যাত্রাপথে সলফেরিনো পৌঁছে যুদ্ধের মর্মান্তিক ও ভয়াবহ রক্তাক্ত দৃশ্য দেখে ব্যথিত হন। আহত সৈন্যদের অসহায় বেদনার্ত অবস্থা দেখে ডুনান্টের মনকে দুর্বল করে দেয়। তাই তিনি তার ব্যবসা সংক্রান্ত কর্মসূচি বাদ দিয়ে আহত সৈন্যদের সেবা-শুশ্রূষা করে বাঁচিয়ে তোলার জন্য মনস্থির করেন। তিনি ব্যবসায় খাটানোর টাকা স্বেচ্ছায় ঐ এলাকার আশে-পাশের গ্রামবাসীর সহায়তায় আহত সৈন্যদের ৬ দিনব্যাপী ফ্রান্সে ”সারন্ডিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার ডিপার্টমেন্ট” এ স্থানান্তরিত করে সেবা-শুশ্রূষা করতে লাগলেন।

পরবর্তীতে যুদ্ধক্ষেত্রের মর্মান্তিক দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরার জন্য ১৮৬২ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়ে A Memory of Solferino নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। বইটিতে তিনি বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানান এবং প্রস্তাব করেন:
১. স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন ও প্রশিক্ষণ দান
২. যুদ্ধাহতদের সেবা ও শুশ্রূষার জন্য প্রতিটি দেশে একটি সেবা সংস্থা গঠন
৩. একটি অলঙ্ঘনীয় চুক্তির মাধ্যমে নতুন সংস্থার নিরাপত্তা বিধানকল্পে নীতিমালা প্রণয়ন
৪. একজন যুদ্ধাহতকে সবসময় একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনার প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবগুলোর সার কথা ছিল আমরা কি পারি না, প্রতিটি দেশে এমন একটি সেবা সংস্থা গড়ে তুলতে যারা শত্রু মিত্র নির্বিশেষে আহতদের সেবা দেবে।

১৮৬৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে জীন হেনরি ডুনান্ট ৪ জেনেভাবাসী নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে যা কমিটি অব ফাইভ নামে পরিচিত। উক্ত কমিটি একই বছরের অক্টোবর মাসে ডুনান্টের প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে ১৬টি দেশের প্রতিনিধি যোগদান করেন। ১৮৬৩ সালের ২৬ থেকে ২৯ অক্টোবর ৪ দিনব্যাপী এ সম্মেলনে ডুনান্টের প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনার মাধ্যমে গৃহীত হয় এবং রেডক্রস গঠিত হয়। রেডক্রস গঠিত হওয়ার পর কমিটি অব ফাইভকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটিতে রূপান্তরিত করা হয়।

রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এর ৭টি মূলনীতির রয়েছে সেগুলো হলো: মানবতা, পক্ষপাতহীনতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছামূলক সেবা, একতা ও সার্বজনীনতা।

এ সংস্থার সদর দপ্তর একমাত্র নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ড হলেও বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার ব্যাপকভাবে লাভ করছে। সারা বিশ্বে প্রায় ১৯৬টি দেশ রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের সদস্য। শুরুতে এ সংস্থার কাজ নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল যেমন আহতের সেবা ও শুশ্রূষা প্রদান করা। বর্তমানে এ সংস্থা সেবা ও শুশ্রূষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগসহ সমাজ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। যেমন:- ক) দুর্যোগে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম। খ) ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)। গ) স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম। ঘ) যুব রেড ক্রিসেন্ট সহ-শিক্ষা কার্যক্রম। ঙ) অনুসন্ধান কার্যক্রম। চ) রক্তদান কর্মসূচি। ছ) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। জ) রেড ক্রিসেন্ট নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রচার এবং প্রসার প্রভৃতি।

সারাদেশের ন্যায় সিলেট রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটও ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আজীবন সদস্য সংগ্রহ করা, সিলেট রেড ক্রিসেন্ট মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, সিলেট রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স এন্ড মিডওয়াইফারি, ৪ বছর মেয়াদী ব্যাচেলর অফ সাইন্স ইন নার্সিং (বিএসসি ইন নার্সিং) কোর্স ও ২ বছর মেয়াদী পোস্ট বেসিক বিএসসি নার্সিং কোর্স।

মুজিব জাহান রেড ক্রিসেন্ট রক্তকেন্দ্রের মাধ্যমে নিয়মিত রক্তদানে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ, রক্ত সংগ্রহ, রক্ত পরীক্ষা, রক্তের উপাদান পৃথকীকরণ, সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে সরবরাহ, রক্ত পরিসঞ্চালন, থ্যালাসেমিয়া রোগীর সেবা দান, রক্তবাহিত জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান।

এছাড়া যুব রেড ক্রিসেন্ট সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় সরকার অনুমোদিত সকল স্কুল ও কলেজে যুব রেড ক্রিসেন্ট দল গঠন, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সারা বছর অব্যাহতভাবে চলছে। সিলেট জেলায় কেন্দ্রীয় কারাগারে বিদেশী বন্দিদের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়। সিলেট রেড ক্রিসেন্ট মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ও সিলেট ইউনিটের উদ্যোগে ৭ দিন ব্যাপী ইফতার সামগ্রী বিতরণ করা হয়। জাতীয় সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত ৩০০ প্যাকেট ইফতার সামগ্রী (চাল, ডাল তেল, লবণ, চিনি, ছোলা, সুজি, হলুদ, মরিচ, ধনিয়া) গরীব দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করা হয় ও শীতকালীন সময়ে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। জাতীয় সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত নগদ অর্থ, সবজি বীজ, হাইজিন, সেল্টার টুলস, ডিগনিটি কিডস কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিতরণ করা হয় ও ৪৮০টি মডেল ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়।

সিলেট রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. নাসির উদ্দিন খান ও সেক্রেটারি মো. আব্দুর রহমান জামিল ও কার্যকরী পরিষদের সকল সদস্যদের নেতৃত্বে এ অঞ্চলের মানুষ যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি আস্থাশীল এবং রেড ক্রিসেন্ট সিলেট অঞ্চলের আজীবন সদস্যবৃন্দ নিজেদেরকে গর্বিত মনে করে। রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এর নীতিমালাসমূহ সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে পারলে এবং সকলে সচেতন হলে মানবিক মূল্যবোধ সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এ কার্যক্রমকে সকল স্তরে পৌঁছানোর জন্য সমাজের সকল স্তরের ব্যক্তিত্বদের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছি।

  • মো. আব্দুর রহমান জামিল: সেক্রেটারি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সিলেট ইউনিট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত